ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রিলায়েন্স ৮০০ কোটি, আদানী ৩শ’ কোটি, আইএফসি ১শ’ কোটি;###;বাংলাদেশের মানব সম্পদের প্রশংসা সবার;###;অবকাঠামো ও যানজট নিয়ে শঙ্কা

বারো শ’ কোটি ডলার ॥ ইনভেস্টমেন্ট এ্যান্ড পলিসি সামিটে প্রতিশ্রুতি

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২৫ জানুয়ারি ২০১৬

বারো শ’ কোটি ডলার ॥ ইনভেস্টমেন্ট এ্যান্ড পলিসি সামিটে প্রতিশ্রুতি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশের অনুকূল বিনিয়োগ পরিবেশ কাজে লাগাতে বিদেশী উদ্যোক্তা ব্যাপক আগ্রহ প্রকাশ করেছে। রবিবার বিনিয়োগ বোর্ড আয়োজিত ‘ইনভেস্টমেন্ট এ্যান্ড পলিসি’ সামিটে বিদেশী উদ্যোক্তারা আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশে ১২০০ কোটি ডলারেরও বেশি বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এর মধ্যে শীর্ষে আছে ভারতীয় শিল্প জায়ান্ট রিলায়েন্স গ্রুপ। এই গ্রুপ আগামী কয়েক বছরে বাংলাদেশে ৮০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের কথা জানিয়েছে। দেশটির অন্যতম বৃহৎ অপর শিল্প আদানী গ্রুপ বাংলাদেশে ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। পাশাপাাশি ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশনও (আইএফসি) বাংলাদেশে নতুন করে আরও এক শ’ কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। এ ছাড়াও ইউনিলিভারসহ দেশে বিদ্যমান অপর বহুজাতিক গ্রুপগুলোও আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের প্রতি আস্থা প্রকাশ করেই দুই দিনের এই সামিটে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছেন। সেই সঙ্গে তারা প্রধানমন্ত্রীর দক্ষ নেতৃত্বেরও প্রশংসা করেছেন। তবে এই বিনিয়োগের পথে তারা অবকাঠামো সমস্যাকে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এখনও বড় বাধা হিসেবে মনে করছেন। তারা বলছেন, রাজধানীর যানজটে নষ্ট হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ কর্মঘণ্টা। কবে নাগাদ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ফোর লেনে উন্নীত হবে কেউ জানে না। আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে সুবিধা পেতে দীর্ঘদিন ধরে গভীর সমুদ্রবন্দর নিয়ে কেবল আশাবাদ শোনা যাচ্ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতির উন্নতি হলেও গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতির কোন লক্ষণ নেই। রবিবার রাজধানীর হোটেল র‌্যাডিসনে শুরু হওয়া দু’দিনের এ বিনিয়োগ সম্মেলনের ‘প্রবৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ : সুযোগ অবারিত’ শীর্ষক প্রথম কর্মঅধিবেশনে এসব কথা বলেন তারা। তাদের মতে, এর বাইরে এদেশে বিনিয়োগ নিরাপদ। মুনাফা বেশি। কোন রকম সমস্যা ছাড়াই বিনিয়োগ থেকে অর্জিত মুনাফাও দেশে ফিরিয়ে নিচ্ছেন বিদেশী উদ্যোক্তারা। অবকাঠামো উন্নয়ন এবং নতুন বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে ব্যবসা শুরুর একটি নীতিমালা ও সহজ পুঁজি সরবরাহের বিষয়টি নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন তারা। সকালে সম্মেলন উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্মেলনে ইউরোপ-আমেরিকাসহ অন্তত ৩০টি দেশের শতাধিক উদ্যোক্তারা অংশ নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব মোঃ আবুল কালাম আজাদ অধিবেশন সঞ্চালনা করেন। উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন মন্তব্যের জবাবে তিনি বলেন, বিনিয়োগের জন্য সহায়ক অবকাঠামোর বিষয়ে সরকার সচেতন আছে। ইতোমধ্যে অনেক অগ্রাধিকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চার লেনের কাজ দ্রুত এগুচ্ছে। রেলপথ উন্নয়নের জন্য অর্থ প্রস্তুত। শীঘ্রই কাজ শুরু হবে। রাজধানীর যানজট নিরসনের একাধিক বড় প্রকল্পের কাজ শুরু হচ্ছে। এর আগে বিষয়ের ওপর মূল প্রবন্ধে বিনিয়োগ আকর্ষণে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা এবং নীতি সহায়তার কথা তুলে ধরেন তিনি। আবুল কালাম আজাদ বলেন, নতুন বিনিয়োগে কোন ক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা ৫ থেকে ৭ বছর পর্যন্ত ট্যাক্স হলিডে সুবিধা পাচ্ছেন। মূলধনী যন্ত্রপাতি এবং কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক ছাড় পাচ্ছেন। আর্থিক সহায়তা হিসেবে কিছু কিছু পণ্য রফতানিতে নগদ সহায়তা, রফতানি উন্নয়ন তহবিল থেকে ঋণসহ অন্যান্য সুবিধা ভোগ করছেন। দেশী-বিদেশী উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, এদেশে বিনিয়োগ করুন, নিরাপত্তা এবং নীতি সহায়তা দেবে সরকার। প্যানেল আলোচক হিসেবে এফবিসিসিআইর সভাপতি মাতলুব আহমাদ বলেন, এদেশে প্রায় সব খাতে বিনিয়োগ উন্মুক্ত। অবকাঠামোর মধ্যে বিদ্যুতের নিশ্চয়তা আছে। তবে বন্দর, গভীর সমুদ্র বন্দরসহ অন্যান্য অবকাঠামো খাতে মনোযোগ দিতে হবে। ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স কর্পোরেশনের (আইএফসি) কান্ট্রিম্যানেজার ওয়েন্ডি জো ওয়ার্নার বলেন, আইএফসি আগামী দুই বছর পর এদেশে বছরে ২০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। বর্তমানে বছরে ৬৪ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে থাকে আইএফসি। এ দেশে সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প বাস্তবায়নে আইএফসি সহযোগিতা দিচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, বিনিয়োগের জন্য সুশাসন এবং সহায়ক পরিবেশ উন্নয়নের পথে এগুচ্ছে বাংলাদেশ। তবে বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আরও দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে নীতির সমন্বয় প্রয়োজন রয়েছে। পুঁজির প্রয়োজনে শেয়ারবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করার কথা বলেন তিনি। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাকের প্রধান নির্বাহী আবরার আনোয়ার বলেন, এদেশে বিনিয়োগ এখন মানবসম্পদ সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে। তাদের ব্যাংকের দুই হাজার কর্মকর্তাদের মধ্যে মাত্র চার জন বিদেশী। এর অর্থ এদেশে মানবসম্পদ উন্নয়ন হয়েছে। সৃজনশীল উদ্যোক্তাও আছে। তবে বর্ধিত অবকাঠামো চাহিদা পূরণের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। তিনিও পুঁজির সংস্থানে শেয়ারবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের পরমার্শ দেন। ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এবং এমডি কামরান বাকর বলেন, ভোক্তা বেশি হওয়ায় ইউনিলিভারের বিনিয়োগের বড় বাজার বাংলাদেশ। এদেশে বিনিয়োগের অভিজ্ঞতার কথায় তিনি বলেন, পনেরো বছর আগে এদেশে ইউনিলিভারের যাত্রা শুরুর পর এখন পর্যন্ত কোন সমস্যায় পড়েনি তার প্রতিষ্ঠান। বিনিয়োগ থেকে অর্জিত মুনাফা দেশে নিয়ে যেতেও কোন সমস্যা হয়নি। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দীন বলেন, উন্নয়নের সঙ্গে মানসম্পদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। বিদেশী মুদ্রা অর্জনের প্রধান মাধ্যম গরিব পোশাক শ্রমিক এবং প্রবাসী শ্রমিকর। এদের উন্নয়নে কিছু করতে না পারলে বর্তমানের উন্নয়নে ধারা ধরে রাখা যাবে না। শিল্পে পুঁজির প্রয়োজনে শেয়ারবাজার উন্নয়নের পরামর্শ দেন তিনি। অধিবেশনের সভাপতির বক্তব্যে বিনিয়োগে বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. এসএ সামাদ বলেন, পুঁজিবাজার নিজেই ইমেজ সঙ্কটে আছে। এটা জুয়ার আসরে পরিণত হয়েছে। এখান থেকে অর্থ সংগ্রহের দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা করে সফল হওয়ার সুযোগ কম। তিনি বলেন, বিনিয়োগ নিবন্ধন থেকে দেশে মুনাফা ফেরত নেয়া পর্যন্ত সব দায়িত্ব বিনিয়োগ বোর্ডের। তবে এর সঙ্গে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত হওয়ায় কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। দেশী বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ বোর্ডের কাছে খুব বেশি সেবা চান না। কারণ, নিজেরা জানেন, কীভাবে কোন প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা পাওয়া যায়। প্রশ্নোত্তর পর্বে অন্যদের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ফারুক সোবহান, একে খান গ্রুপের এমডি সালাহ উদ্দিন কাশেম খান প্রমুখ। শিল্প প্রতিষ্ঠানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের আশ্বাস বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রীর ॥ বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, শিল্প প্রতিষ্ঠানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহ অব্যাহত রাখা হবে। টেকসই উন্নয়নের জন্য জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রাথমিক জ্বালানি নিশ্চিত করতে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিদ্যুত খাতে ৮০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ হয়েছে এবং আরও এক হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ প্রক্রিয়ায় রয়েছে। কিন্তু আমাদের প্রয়োজন ৪০ বিলিয়ন ডলার। ‘ইনভেস্টমেন্ট এবং পিপিপি অপরচুনিটিজ ইন ইকোনমিক জোনস, টেক পার্স, এনার্জি এ্যান্ড পাওয়ার সেক্টরস’ শীর্ষক অধিবেশনে সভাপতিত্বকালে প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে জিডিপির ৩৮ শতাংশ বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে সরকার অনেক অর্থনৈতিক অঞ্চল সৃষ্টি করেছে।
×