ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আলোচনা সভায় দাবি

দ্রুত সময়ের মধ্যে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২০ জানুয়ারি ২০১৬

দ্রুত সময়ের মধ্যে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করতে হবে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের দাবিতে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ২৪ বছরের আন্দোলনে প্রত্যাশার চেয়ে প্রাপ্তি অনেক। মাত্র ৬ বছরে ২১ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্ন হয়েছে। ’৭৫-এ হারিয়ে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমাজের সর্বস্তরে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ২৪ বছর পূর্বে অসুস্থ শরীর নিয়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেরিয়েছিলেন। তার আন্দোলনের এ স্পৃহা দেখে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরে আসে। শহীদ জননীর এ আন্দোলন কোন রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ থেকে নয়। অন্দোলনে প্রত্যাশার চেয়ে প্রাপ্তি বেশি হলেও জঙ্গীবাদের উৎসমুখ বন্ধ হয়নি। নিষিদ্ধ করা সম্ভব হয়নি জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি। মঙ্গলবার রাজধানীর ডব্লিউভিএ মিলনায়তনে একাত্তরের ঘাতক দালল নির্মূল কমিটি আয়োজিত ‘শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলনের দুই যুগ : প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। এ সময় বক্তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে অপরাধী সংগঠন হিসেবে তাদের বিচার দাবি করেন। জামায়াত-শিবিরের অর্থিক প্রতিষ্ঠান ও তাদের সম্পদ বাজেয়াফত করে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের মধ্যে বণ্টন করে দেয়ার তাগিদ দেন কেউ কেউ। বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলামের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আয়েশা খানম, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহ-সভাপতি শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, সারাদেশে অসুস্থ শরীর নিয়ে শহীদ জননী যেভাবে ছুটে বেরিয়েছিলেন তা তরুণ সমাজের মধ্যে সাড়া জাগায়। প্রথমবার তরুণরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কাজ করতে শুরু করে। প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য চাপ নিয়ে সরকারকে যুদ্ধাপরাধীর বিচার করতে হচ্ছে। কোন প্রতিশোধ স্পৃহা নয়, আমাদের যে দায় আছে; এই বিচারের মাধ্যমে আমার সে দায় স্বীকার করে নিচ্ছি। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা ধরেই নিয়েছিলাম এ জয় পরম ও আত্মস্বীকৃত। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি কাজ চালিয়ে গেছে। তারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। আজ যখন বিচার প্রায় শেষ হচ্ছে, তখনও আমরা আত্মসন্তুষ্টিতে ভুগছি। কিন্তু তারা বিচারের বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা ও কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এ সময় তিনি সরকারকে উদ্দেশ করে বলেন, বহু দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে, তারচেয়ে বাংলাদেশে যে বিচার হচ্ছে, তা অনেক সুষ্ঠু ও ন্যায়পরায়ণÑ তা সবাইকে জানাতে হবে। অনুষ্ঠানে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, দুই যুগ একটি লক্ষ্য নিয়ে লেগে থাকা অনেক কঠিন কাজ। কবি গুরু বলেছিলেনÑ আমরা শুরু করি কিন্তু শেষ করি না। দুটো ক্ষেত্রে তার এ উক্তি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ও ’৭৫ পরবর্তী সময়ে হারিয়ে যাওয়া চেতনা পুনরুদ্ধারে আমরা সক্ষম হয়েছি। এই দুই ক্ষেত্রে তার উক্তি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করা নিয়ে জনমনে সংশয় ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, সমাজের অনেকে বিশ্বাসই করতে পারেনি সরকার বিচার করবে। সাকার বিচার হবে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়াই সম্পূর্ণ সুষ্ঠুভাবে অপরাধীদের সাজা কার্যকর করা সত্যিই অবিশ্বাস্য। এ এক অভূতপূর্ব অর্জন। তথ্যমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর সময়ে ১২ হাজার যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা করা হয়েছিল। সেই তালিকা ধরে সবার বিচার সম্পন্ন হলে বাঙালীর অভ্যন্তরে কোন যুদ্ধাপরাধী থাকবে না। তালিকা প্রকাশ করে তা প্রত্যেক জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সাটিয়ে দেয়া হলেÑ ওই জেলা ও উপজেলার মানুষ চিনবে কারা কারা অপরাধী। পাকিস্তানী ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর ব্যাপারেও আমরা কাজ করছি। ইনু বলেন, পাকিস্তান, জামায়াত ও বিএনপি বাংলাদেশের শত্রু। বিএনপি এখন আধা জামায়াতে রূপান্তর হয়েছে। তাদের বলব এই আধা জামায়াত না থেকে পুরো জামায়াত হয়ে যান! যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সাফল্য প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, এই বিচারের মাধ্যমে জয় বাংলার ধ্বনি পুনরায় রণধ্বনি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হত্যা-খুন করে কোনদিন পার পাওয়া যায় নাÑ তাও প্রমাণিত। এ ছাড়া পাকিস্তানের প্রতি খালেদার অন্ধ প্রেমের পর্দাও ফাঁস হয়েছে। বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, কেবল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নয়, জামায়াত নিষিদ্ধ এবং তাদের বিচারও করতে হবে। ট্রাইব্যুনালে তাদের বিচার করতে পারে। শহীদ জননীর এ আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সাফল্য গণজাগরণ, মানুষের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরায় ছড়িয়ে পড়া। সাম্প্রতিক বিভিন্ন হামলার ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আইএস এর দাবি যতই অসার হোক না কেন; তাদের মতাদর্শের লোকরাই দেশের নানা স্থানে এ হামলা চালিয়ে যাচ্ছেÑ তা প্রমাণিত। অথচ শিক্ষানীতির মূল বিষয় বাস্তবায়িত হচ্ছে না বা হতে পারছে না। দেশে এখনও জঙ্গীবাদের অর্থায়নও বন্ধ হয়নি। জঙ্গীদের অর্থের সঙ্গে বহুলোক যুক্ত। সরকার বিষয়টি নজরে নিলেও কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিতে পারছে না। নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুলের সঞ্চালনায় সূচনা বক্তব্য রাখেন সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির। ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীর বিচারে দাবিতে প্রতীকী গণবিচারের সিদ্ধান্তের কঠিন সমালোচনা করে শাহরিয়ার কবির বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে সরকারী লোকেরাও বিভ্রান্তি তৈরি করছে। নৌমন্ত্রী হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিলেন সোহরাওয়ার্দীতে প্রতীকী বিচার করবেন। বর্তমান সময়ে তা প্রাসঙ্গিক নয়। তখন সরকার দাবি না মানায় বাধ্য হয়ে গণআদালত করতে হয়েছিল। যেখানে ট্রাইব্যুনালে প্রকৃত বিচার হচ্ছে সেখানে প্রতীকী বিচারের সুযোগ নেই। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাফল্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ৬ বছরে ২১ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্ন হয়েছে। এটা অনেক বড় প্রাপ্তি। তবে এ সাফল্য অর্জনে দীর্ঘ দুই যুগ আমাদের লড়াই-সংগ্রাম করতে হয়েছে। ২৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়েছিল। জেল-জুলুম ছাড়াও অনেককে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল।
×