ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বেপরোয়া গাড়ি চালনাই দুর্ঘটনার মূল কারণ ;###;৫০ ভাগই দায়ী চালকরা ষরাস্তা কম, গাড়ি বেশি ;###;প্রতিদিন নামছে তিন শতাধিক নতুন গাড়ি

সড়কে নিত্য ঝুঁকি ॥ গত বছর দুর্ঘটনা প্রাণ কেড়েছে ৫ হাজার

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১৮ জানুয়ারি ২০১৬

সড়কে নিত্য ঝুঁকি ॥ গত বছর দুর্ঘটনা প্রাণ কেড়েছে ৫ হাজার

রাজন ভট্টাচার্য ॥ আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী রাজধানীর রাস্তায় সর্বোচ্চ দুই লাখ ১৬ হাজার গাড়ি চলতে পারে। অথচ দিনেই নামছে ৩১৭টি নতুন পরিবহন। নগরীতে চলা মোট গাড়ির সংখ্যা প্রায় সাড়ে নয় লাখ। এমন বাস্তবতায় গত বছরে ঢাকা জেলায় সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে রাজধানীতে মারা গেছেন ২২৭ জন। গোটা রাজধানীতে দাবড়ে বেড়াচ্ছে দেড় লাখের বেশি ফিটনেসহীন গাড়ি। অবৈধ চালকের পরিসংখ্যান কারও হাতে নেই! সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ৫০ ভাগই দায়ী চালকরা। তাছাড়া দুর্ঘটনার মামলায় ৮৩ ভাগ আসামিকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয় না। বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো ও চালকদের প্রশিক্ষণ না থাকাই সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, অনেক চালক আছেন যাদের জেব্রা ক্রসিং সম্পর্কে ধারণা নেই। এই ক্রসিংয়েও গাড়ি থামে না! তাই রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় পথচারী নিহতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাত বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি নগরীর দুর্ঘটনাপ্রবণ ৫১টি ব্ল্যাক স্পটের সুপারিশ। একাধিক নগর কর্তৃপক্ষ থাকায় এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। এজন্য সংশ্লিষ্ট সকলকেই দায়ী বলে মনে করেন তারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফুটপাথ ও রাস্তা দখলমুক্ত করা, ট্রান্সপোর্ট কমিশন গঠন, যথাযথ আইন প্রয়োগ ও কোম্পানির মাধ্যমে গাড়ি চালানোসহ চালক-যাত্রী-পথচারীদের সচেতন করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আসবে। রাজধানী যেন গাড়ির হাট ॥ সত্যিই আশ্চর্যের কথা। রাজধানীজুড়েই গাড়ি আর গাড়ি। কোথাও যেন ফাঁকা নেই। একেতো অপরিকল্পিত নগরায়ন, সঙ্গে যোগ হয়েছে রাস্তা সঙ্কট। আন্তর্জাতিক নিয়মে ২৫ ভাগ রাস্তার স্থলে আছে ছয় থেকে সাত ভাগ। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক বেদখলে। তার ওপর আবার কত গাড়ি চলবে এরকম কোন পরিকল্পনা নেই। পরিসংখ্যান বলছে, ৩১৭টি গাড়ি প্রতিদিন নামছে এই নগরীতে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাইভেটকার। অথচ আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী রাজধানীর সড়কগুলোতে ২ লাখ ১৬ হাজার যানবাহন চলতে পারে। দেশে নিবন্ধিত প্রাইভেটকারের ৭৫ শতাংশ চলছে রাজধানীতে। অথচ এসবে যাতায়াত করছে মাত্র ৮ ভাগ যাত্রী। এছাড়া ঢাকায় ব্যক্তিনির্ভরতার কারণে কোম্পানিভিত্তিক বাস ব্যবসা গড়ে উঠছে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বেসরকারীভাবে বাস নেটওয়ার্ক গড়ে কোম্পানির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দ্রুত আন্তর্জাতিক মানদ-ে রাজধানীতে গণপরিবহন বৃদ্ধির পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিআরটিএ’র জুলাই মাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকায় নিবন্ধিত বিভিন্ন ধরনের গাড়ি রয়েছে ৯ লাখ ৩৮ হাজার। এর মধ্যে বাস ও মিনিবাস রয়েছে ৩৩ হাজার ২৮টি নিবন্ধিত। কিন্তু পরিবহন সমিতিগুলোর হিসাবে দেখা গেছে, ঢাকায় চলাচল করছে ৪ হাজার বাস। ঢাকায় দিনে অন্তত ৬ লাখ মানুষ নানা প্রয়োজনে আসছেন। যুক্তরাজ্যের লন্ডনে একটি বাস ঘণ্টায় ১৮ কিলোমিটার অতিক্রম করে। ঢাকায় গতি ঘণ্টায় মাত্র ৭ কিলোমিটার। ২০১৩ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা যায়, ঢাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি। তাই দিনে অন্তত ২১ লাখ ট্রিপের প্রয়োজন। কিন্তু যানজটে ২১ লাখের তিন ভাগের এক ভাগ ট্রিপও হচ্ছে না। সমীক্ষা অনুযায়ী, রাজধানীর প্রতি ৩ হাজার যাত্রী যাতায়াতের জন্য বাস ও মিনিবাস আছে মাত্র ১টি। তারা জানান, রাজধানীর অটোরিক্সাগুলোর এক-তৃতীয়াংশ অচল। গণপরিবহন সঙ্কটের বিপরীতে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। ঢাকায় ৩ লাখ ৬০ হাজার মোটরসাইকেল, ২ লাখ ১৪ হাজার ৯৮৭টি প্রাইভেটকার রয়েছে। রাজধানীর সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিকার প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এ্যাক্সিডেন্ট রিসার্স ইনস্টিটিউটের (এআরআই) অধ্যাপক মোহাম্মদ মাহাবুব আলম তালুকদার জনকণ্ঠকে বলেন, সঙ্কট সমাধানে সবার আগে একটি টান্সপোর্ট কমিশন গঠন করা জরুরী। তাদের কাজ হবে পরিবহন নিয়ন্ত্রণ করা। গণপরিবহন বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, পরিবহনের মান উন্নত হলে মানুষ গাড়িতে চলাচল করবে। পথচারীর সংখ্যা কমবে। পাশাপাশি যানজটও নিয়ন্ত্রণে আসবে। কারণ রাজধানীতে গাড়িচাপায় পথচারী নিহতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য সবার গাফিলতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে এ্যাক্সিডেন্ট রিচার্স ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে ঢাকাসহ সারাদেশের ব্ল্যাক স্পটগুলো চিহ্নিত করার পর কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। মহাসড়কে ব্ল্যাক স্পট সমস্যা সমাধানে মন্ত্রণালয় কিছু উদ্যোগ নিলেও ঢাকায় ৫০টির বেশি স্পট আগের অবস্থাতেই রয়েছে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশন, মহানগর পুলিশ থেকে শুরু করে ঢাকায় অনেক কর্তৃপক্ষ থাকায় এসব সমস্যার সমাধান হয়নি। কিন্তু সিটি গবর্নমেন্ট পদ্ধতি চালু থাকলে এসব সমস্যা অনেক আগেই সমাধান হতো। স্বাভাবিক গতিতে গাড়ি চলাচল করলে রাজধানীতে আরও বেশি সড়ক দুর্ঘটনা হতোÑ এ কথা উল্লেখ করে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, প্রতিটি উন্নত শহরে নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান গাড়ি চালায়। আমাদের দেশে এরকম কোন সিস্টেম নেই। ইচ্ছেমতো গাড়ি নামানো হচ্ছে। চালকরা দক্ষ নয়। সবাই সতর্ক হয়ে গাড়ি না চালানোর কারণে দুর্ঘটনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আইন প্রয়োগ না হওয়াও সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। দুর্ঘটনা রোধে চালকদের ওভারটেকিং বন্ধের পরামর্শ দেন তিনি। এছাড়াও দুই সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ফুটপাথ দখলমুক্ত করার কার্যক্রম সফলভাবে শেষ হলে সড়ক দুর্ঘটনা আরও কমে আসবে বলেও মনে করেন তিনি। রাজধানীর ৫১ স্পট ॥ দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট ঢাকা নগরীর ৫১টি পয়েন্টকে দুর্ঘটনার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে ২০০৯ সালে তালিকা পাঠানো হয় যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে। এরপর পেরিয়ে গেছে প্রায় সাত বছরের বেশি সময়। অথচ কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এসব পয়েন্টের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে যাত্রাবাড়ী, ফার্মগেট, মতিঝিল, মৎস্যভবন, সোনারগাঁও, বিজয় সরণি, শনিরআখড়া, জসিমউদ্দীন রোড ক্রসিং, শাহবাগ, সায়েদাবাদ ও জিপিও মোড়। প্রতিষ্ঠানটির মতে, ঢাকায় দুর্ঘটনা এবং দুর্ঘটনার কারণে প্রাণহানি বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ ফিটনেসহীন যানবাহন ও প্রশিক্ষণহীন গাড়িচালক। ৫০ ভাগ দুর্ঘটনায় দায়ী চালকরাই ॥ দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, ৫০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকরা। ৪৯ ভাগ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ছিল বাসচালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানো। চালকদের ওপর করা জরিপে দেখা গেছে, চালকদের ৮১ ভাগ প্রশিক্ষণ ছাড়া, শুধু ওস্তাদদের কাছ থেকে শিখেই চালক বনে যান। চালকদের ৪৮ ভাগই মাধ্যমিক বা সমমানের শিক্ষিত। চালকদের সবাই অধিক রোজগারের জন্য অতিরিক্ত পরিশ্রম করেন। জরিপে দেখা গেছে, ৯ থেকে ১২ ঘণ্টা গাড়ি চালান ৪৮ ভাগ চালক। ১৯ ভাগ চালক গাড়ি চালান ১৩ থেকে ১৬ ঘণ্টা। রাজধানীতে দুর্ঘটনা কত ॥ ২০১৫ সালে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার লোক মারা গেছে বলে পরিসংখ্যান জানিয়েছে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা), যা আগের বছরের চেয়ে দেড় হাজার কম। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে নিসচা’র চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ২০১৫ সালে সারাদেশে ২ হাজার ৬২৬টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। ২০১৫ সালে ঢাকা জেলায় সবচেয়ে বেশি মানুষ দুর্ঘটনায় নিহত হন। এ সংখ্যা ৩৫৯। এর মধ্যে রাজধানীতেই নিহত ২২৭ জন। সবচেয়ে কম ২৮ জন মারা যান কুষ্টিয়া জেলায়। এছাড়াও বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির গেল বছরের পরিসংখ্যান বলছে, সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় সাড়ে ৮ হাজার মানুষ মারা গেছেন। সংস্থার হিসাব বলছে, ২০১৫ সালে সারাদেশে ৬ হাজার ৫৮১টি ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ৮ হাজার ৬৪২ জন নিহত হন; আহত হন ২১ হাজার ৮৫৫ জন। ২০১৫ সালে যাত্রী, চালক ও পরিবহন শ্রমিক মিলে ৩০ হাজার ৪৯৭ জন সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন। সংবাদ সম্মেলনে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরে যাত্রীকল্যাণ সমিতি। এগুলো হলো- ট্রাফিক আইন ও মোটরযান আইন সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, গীর্জা ও গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করা। জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশ থেকে হাট-বাজার অপসারণ করা ও ফুটপাথ দখলমুক্ত করা। রোডসাইন ও জেব্রা ক্রসিং আঁকা, চালকদের পেশাগত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা; তাদের বিশ্রাম ও কর্মবিরতির সুযোগ দেয়া, বিদ্যমান মোটরযান আইন যুগোপযোগী করা ও গাড়ির ফিটনেস সনদ দেয়ার পদ্ধতি ডিজিটাল করা প্রভৃতি। রাজধানীতে দেড় লাখ ফিটনেসহীন গাড়ি ॥ সবখানেই দাবড়ে বেড়াচ্ছে ফিটনেসহীন পরিবহন। এসব পরিবহন নিয়ন্ত্রণে কাগুজে উদ্যোগ থাকলেও বাস্তবে নেই। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে ফিটনেস গাড়ির সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ। রাজধানীতে গত বছরের জুলাই পর্যন্ত রেজিস্ট্রেশন করা প্রায় ৯ লাখ গাড়ির মধ্যে ১ লাখ ৫৯ হাজার ৬৫১টি গাড়িই ফিটনেসহীন। মৃত্যুদূত অবৈধ চালকরা ॥ বাংলাদেশে নিবন্ধিত মোটরযানের সংখ্যার তুলনায় সনদধারী চালক প্রায় ১০ লাখ কম বলে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন। সম্প্রতি সংসদে মন্ত্রী এ তথ্য তুলে ধরে বলেন, লাইসেন্সবিহীন চালকের সঠিক পরিসংখ্যান সরকারের কাছে নেই। মন্ত্রী বলেন, সারাদেশে লাইসেন্সধারী গাড়িচালকের সংখ্যা ১৫ লাখ ৪৮ হাজার ৪৬৫ জন। অন্যদিকে রেজিস্ট্রেশন করা মোটরযানের সংখ্যা ২৪ লাখ ৪ হাজার ১১৪টি। ভুয়া লাইসেন্সধারী চালক ও মোটরযানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের চিঠি দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ বাস-ট্রাক এ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান রমেশ চন্দ্র ঘোষের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিশৃঙ্খল চালকরাই সড়ক দুর্ঘটনার জন্য একমাত্র দায়ী। তিনি বলেন, বেপরোয়া গাড়ি চালানো বন্ধ করতে হবে।
×