ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শেষ হচ্ছে বিশ্ব এজতেমার দ্বিতীয় পর্ব

আজ আখেরি মোনাজাত তুরাগ অভিমুখে মানুষের ঢল

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১৭ জানুয়ারি ২০১৬

আজ আখেরি মোনাজাত তুরাগ অভিমুখে মানুষের ঢল

ফিরোজ মান্না/মোস্তাফিজুর রহমান টিটু/নুরুল ইসলাম, টঙ্গী থেকে ॥ আম বয়ানের মধ্য দিয়ে বিশ্ব এজতেমা চলছে। আজ রবিবার আখেরি মোনাজাত। আর এই মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েত ৫১তম বিশ্ব এজতেমার দ্বিতীয় পর্ব। আখেরি মোনাজাত শুরু হবে সকাল ১০টা থেকে সাড়ে এগারটার মধ্যে। মোনাজাতের আগে অনুষ্ঠিত হবে হেদায়তি বয়ান। তবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বি দিল্লীর হযরত মাওলানা সা’দ আহমেদের আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করার কথা রয়েছে। মোনাজাতে বাংলাদেশসহ সারা দুনিয়ার মানুষের সুখ, শান্তি ও কল্যাণ কামনা করে দোয়া করা হবে। বিদেশী মেহমান নিবাসের পূর্ব পাশে বিশেষ মোনাজাত মঞ্চ থেকে রবিবার সকালে শুরু হবে আখেরি মোনাজাত। আখেরি মোনাজাতে ২০ থেকে ২৫ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি অংশ নিবেন বলে আয়োজকদের ধারণা। আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে শনিবার সকাল থেকেই টঙ্গী শহর এবং এজতেমাস্থলে বিভিন্ন এলাকা থেকে ধর্মপ্রাণ মানুষের স্রোত নামে। টঙ্গী অভিমুখী বাস, ট্রাক, ট্রেন, লঞ্চসহ বিভিন্ন যানবাহনে মানুষের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। টঙ্গীর তুরাগ তীরে বিশ্ব এজতেমায় আগত লাখ লাখ মুসল্লির পদভারে মুখরিত হয়ে উঠেছে। রবিবার আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত মানুষের এ ঢল অব্যাহত থাকবে। এবারের এজতেমার শেষ দফায় ১৬ জেলার মুসল্লি ২৯ খিত্তায় অবস্থান নিয়ে ইবাদত বন্দেগীতে অংশ নেন। বিশ্ব এজতেমার আয়োজক কমিটির সদস্য প্রকৌশলী মোঃ গিয়াস উদ্দিন বলেন, বিগত বছরগুলোতে বিশ্ব এজতেমা ময়দানে যৌতুকবিহীন বিয়ে অনুষ্ঠিত হতো। কিন্তু এবার তা হয়নি। এজতেমা ময়দানে যৌতুকবিহীন বিয়ে অনুষ্ঠিত হলে তা কেবল এই ময়দানে আসা তাবলিগী সদস্যরা ও মুসল্লিরা জানতে পারেন। এলাকার লোকজন এমনকি অনেক স্বজনরাও তা জানতে পারেন না। ফলে ওই বিয়ের আকর্ষণ কমে যায়। এজন্য এবার থেকে এজতেমা ময়দানে যৌতুকবিহীন বিয়ের জন্য তালিকা ভুক্ত হলেও তাদের নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে ওই বিয়ের আয়োজন করতে বলা হয়েছে। তাই এবার মাঠে ওই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা থাকবে না। বিশ্ব এজতেমার অন্যতম আকর্ষণ ছিল যৌতুকবিহীন বিয়ে। সম্পূর্ণ শরীয়ত মেনে তবলীগের রেওয়াজ অনুযায়ী এজতেমার দ্বিতীয় দিন (শনিবার) বাদ আছর এজতেমার বয়ান মঞ্চের পাশেই যৌতুকবিহীন বিয়ের আসর বসতো। কনের সম্মতিতে ও তার অনুপস্থিতিতে বর এবং কনে পক্ষের লোকজনের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হতো ওই বিয়ে। বিয়েতে মোহরানা ধার্য করা হতো ‘মোহর ফাতেমী’র নিয়মানুযায়ী। এ নিয়ম অনুযায়ী মোহরানার পরিমাণ ধরা হয় দেড় শ’ তোলা রুপা বা তার সমমান অর্থ। দ্বিতীয় পর্বের এজতেমার দ্বিতীয় দিন শনিবার ফজরের নামাজের পর থেকে বয়ান করেছেন ভারতের মাওলানা মোঃ খোরশেদ আলম। এসময় বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা মোঃ জাকির হোসাইন। পাশাপাশি ইংরেজী, উর্দুসহ বিভিন্ন ভাষায় তরজমা করা হয়। এছাড়া বাদ জোহর ভারতের মাওলানা মোঃ ফারুক হোসেন, বাদ আছর ভারতের মাওলানা মোঃ ইউসুফ ও বাদ মাগরিব- ভারতের হযরত মাওলানা মোঃ শওকত আলী বয়ান করেছেন বলে জানান বিশ্ব এজতেমার মুরব্বি ইঞ্জিনিয়ার মোঃ গিয়াস উদ্দিন। শনিবার বিশ্ব এজতেমার দ্বিতীয় দিনে দেশ-বিদেশী আগত মুরব্বিগণ তবলীগের ছয় ওছুলের মধ্যে দাওয়াতে দ্বীনের মেহনতের উপর গুরুত্বারোপ করে বয়ান করেন। এজতেমার প্যান্ডেলের উত্তর-পশ্চিমে তাশকিলের কামরা স্থাপন করা হয়েছে। বিভিন্ন খিত্তা থেকে বিভিন্ন মেয়াদে চিল্লায় অংশ গ্রহণেচ্ছু মুসল্লিদের এ কামরায় আনা হচ্ছে এবং তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। পরে কাকরাইল মসজিদের তবলিগী মুরব্বিদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এলাকা ভাগ করে তাদের দেশের বিভিন্ন এলাকায় তবলিগী কাজে পাঠনো হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালত ॥ এজতেমাস্থলের আশপাশে বিভিন্ন খাবার দোকান ও হোটেলে শুক্রবার থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের একাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে ভেজাল খাবার পরিবেশন ও বিক্রির দায়ে বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে মোট ১ লাখ ৯৬ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হযেছে। এজতেমাস্থলে মোট ১০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হচ্ছে। গাজীপুরের ১৪ জনসহ বিভিন্ন জেলার মোট ২৪ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ওইসব আদালত পরিচালনা করছেন। বিদেশী মুসল্লি ॥ পুলিশ কন্ট্রোলরুম সূত্র জানায়, এজতেমার দ্বিতীয় পর্বে এ পর্যন্ত (শনিবার) জর্ডান, লিবিয়া, আফ্রিকা, লেবানন, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, আমেরিকা, তুরস্ক, ইরাক, সৌদি আরব, ভারত, পাকিস্তান, ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের ৯৬টি দেশের ৬ হাজার ৫১৮ জন মুসল্লি এজতেমায় অংশ নিয়েছেন। বিভিন্ন ভাষাভাষী ও মহাদেশ অনুসারে এজতেমা ময়দানে বিদেশী মেহমানদের জন্য মোট ৩টি তাঁবু নির্মাণ করা হয়েছে। বিদেশী তাঁবুতে রান্নার জামাতের জিম্মাদার মোঃ নূরুল ইসলাম জানান, মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র ও ধর্মমন্ত্রীসহ ২২জনের মালয়েশিয়ান টিম টঙ্গীর বিশ্ব এজতেমায় যোগ দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার রাতে তারা এজতেমা ময়দানে মালয়েশীয় তাঁবুতে অবস্থান নেন। তবে গাজীপুরের পুলিশ বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি। আখেরি মোনাজাতে ভিআইপিরা অংশ নেবেন ॥ বিশ্ব এজতেমার দ্বিতীয় পর্বের আখেরি মোনাজাতে মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য, সংসদ সদস্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, সরকারী-বেসরকারীসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বিভাগের কর্মকর্তাগণ মোনাজাতে অংশ নেবেন। এজতেমা ময়দানে আইজিপি’র ব্রিফিং ॥ পুলিশের মহা পরিদর্শক একেএম শহীদুল হক শনিবার দুপুরে টঙ্গীতে বিশ^ এজতেমা পরিদর্শন করেছেন। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের জানান, এজতেমা শেষে যে সকল বিদেশী মুসল্লি আরও ৪০ দিন বা তার চেয়েও বেশি সময় বাংলাদেশে অবস্থান করবেন তাদের পর্যবেক্ষণে রাখা হবে এবং তাদের নিরাপত্তাও দেয়া হবে। তাদের অনুরোধ করা হয়েছে তারা যে এলাকায় চিল্লায় যাবেন সে তালিকা যেন পুলিশকে দেয়া হয়। সে এলাকায় পুলিশ তাদের নিরাপত্তা দিবে এবং তাদের পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। তারা যদি পল্লী এলাকায়ও যান তবুও আমাদের পুলিশ তাদের নিরাপত্তা দিবে এবং পর্যবেক্ষণে রাখবে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা এবং সিটি কর্পোরেশনের এক কর্মকর্তাকে পুলিশ কর্তৃক নির্যাতন প্রসঙ্গে বলেন, পুলিশ একটি বিরাট আইন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। পুলিশ যদি ন্যূনতম অপরাধ করে তা আমরা আমলে নেই। তাদের প্রতি ন্যূনতম অনুকম্পা দেখানো হয় না। যত ঘটনাই ঘটেছে তাদের শাস্তি দেয়া হয়েছে। চার্জশীট দেয়া হয়েছে। সাজা হয়েছে। সাধারণ পাবলিক যে অপরাধ করে পুলিশ যদি সে অপরাধ করে তাহলে তার চেয়ে বেশি শাস্তি আমরা দেই। বিশেষ ট্রেন ॥ এবারের বিশ্ব এজতেমার দ্বিতীয় পর্বের আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে আখাউড়া, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন রুটে ২৯টি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এজতেমা উপলক্ষে এসব ট্রেনে অতিরিক্ত বগি সংযোগ করা হয়েছে। এছাড়া আখেরি মোনাজাতের আগে ও পরে সকল ট্রেন টঙ্গী স্টেশনে যাত্রা বিরতি করবে। টঙ্গী রেলওয়ে জংশন সূত্রে জানা গেছে, দ্বিতীয় পর্বের ১৫ জানুয়ারি হতে ১৭ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাত পর্যন্ত টঙ্গী থেকে জামালপুর, আখাউড়া, লাকসাম রুটসহ কয়েকটি বিশেষ ট্রেন চলবে। রবিবার আখেরি মোনাজাতের দিন টঙ্গী থেকে ঢাকা, লাকসাম, আখাউড়া, ময়মনসিংহ এবং ঈশ্বরদীরুটে একাধিক বিশেষ ট্রেন যাতায়াত করবে। আখেরি মোনাজাতের পরের দিন টিকেটধারী মুসল্লিরা যাতে উঠতে পারেন সেজন্য সকল ট্রেন টঙ্গী স্টেশনে যাত্রা বিরতি দেবে। এছাড়া এজতেমায় আগত যাত্রীদের কথা বিবেচনায় রেখে টঙ্গী রেলওয়ে জংশনে অতিরিক্ত টয়লেট ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। মোনাজাতের দিন চলবে শাটল বাস ॥ গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ জানান, শনিবার রাত ১২টা থেকে রবিবার আখেরি মোনাজাতের দিন বিকেল পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরের ভোগড়া বাইপাস মোড় থেকে কুড়িল বিশ্বরোড, সাভারের বাইপাইল থেকে আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত এ্যাম্বুলেন্স ও পুলিশের গাড়ি ছাড়া সাধারণ যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। সেজন্য মুসল্লিদের যাতায়াতের সুবিধার্থে আখেরি মোনাজাতের দিন রবিবার ভোর থেকে গাজীপুরের ভোগড়া বাইপাস মোড় এলাকা থেকে এজতেমাস্থল পর্যন্ত মুসল্লিদের সুবিধার্থে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে অর্ধশত বিআরটিসি বাস ও ব্যক্তি মালিকানাধীন (এজতেমার স্টিকার লাগানো) শাটল বাস চলাচল করবে। যেসব স্থানে গাড়ি পার্কিং নিষেধ ॥ মহাখালি ক্রসিং থেকে টঙ্গী হয়ে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত মহাসড়কের দু’পাশ, আব্দুল্লাহপুর থেকে বাইপাইল, প্রগতিসরণির মধ্যবাড্ডা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রগতিসরণির’ সড়কের দুই পাশ। যেসব পথে গাড়ি চলবে ॥ শনিবার রাত ১১টার পর থেকে গাজীপুরের ভোগড়া বাইপাস থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, আশুলিয়া-বাইপাইল, কামারপাড়া, স্টেশন রোড থেকে মীরের বাজার পর্যন্ত সকাল গাড়ি চলাাল বন্ধ থাকবে। বিকল্প পথ হিসেবে ময়মনসিংহ ও সিলেট থেকে যারা ঢাকা যাবে তাদের ভোগড়া বাইপাস থেকে মীরের বাজার হয়ে কাঁচপুর দিয়ে অতিক্রম করতে হবে। আবার যারা রাজশাহীসহ উত্তর বঙ্গথেকে ঢাকা যাবে তারা নবীনগর-চন্দ্রা কিংবা আশুলিয়া-বাইপাইলের ধৌড় ব্রিজ হয়ে বেড়িবাঁধ দিয়ে অতিক্রম করতে বলা হয়েছে। মোনাজাতের দিন ঢাকা থেকে এজতেমাস্থলগামী মুসল্লিদের ট্রঙ্গী ব্রিজ পরিহার করে আব্দুল্লাহপুর-আশুলিয়া সড়ক ধরে হেঁটে এজতেমা ময়দানের পশ্চিমপাশ দিয়ে ভাসমান সেতু দিয়ে ময়দানের ভেতরে প্রবেশের নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন গাজীপুর ট্রাফিক বিভাগের সহকারী পুলিশ সুপার সাখাওয়াত হোসেন।
×