ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এবার পুলিশী নির্যাতনের শিকার হলেন সিটি কর্পোরেশন কর্মকর্তা

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ১৬ জানুয়ারি ২০১৬

এবার পুলিশী নির্যাতনের শিকার হলেন সিটি কর্পোরেশন কর্মকর্তা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ব্যাংক কর্মকর্তার পর এবার পুলিশী নির্যাতনের শিকার হলেন ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের এক কর্মকর্তা। ভুল বোঝাবুঝি থেকে ঘটনাটি ঘটেছে বলে পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তাদের দাবি। যদিও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ভুল বোঝাবুঝির পাশাপাশি ঘটনার জন্য পুলিশের বাড়াবাড়ি দায়ী। ব্যাংক কর্মকর্তাকে নির্যাতনের পর পরই পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক এবং ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বার বার পুলিশ সদস্যদের সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিচ্ছেন অথচ ওসব নির্দেশ থোরাই কেয়ার করছে পুলিশ সদস্যরা। শুক্রবার সকালে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানাধীন মীরহাজীরবাগ এলাকায় ঘটে যাওয়া ঘটনা বিষয়ে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শক বিকাশ চন্দ্র দাশ (৪৫) পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম তদারকি করতে মোটরসাইকেলযোগে মীরহাজীরবাগে যান। সেখানে যাত্রাবাড়ী থানার এসআই আরশাদ হোসেন আকাশের নেতৃত্বে সাদা পোশাকের একটি পুলিশ দল দায়িত্ব পালন করছিল। পুলিশ সদস্যরা মোটরসাইকেলযোগে ও হেঁটে এলোমেলো চলাচল করতে দেখে বিকাশকে ডাক দেয়। এ সময় পুলিশ সদস্যরা নিজেদের পুলিশ সদস্য বলেও জোরে জোরে হাঁকডাক দিচ্ছিলেন। কিন্তু বিষয়টি বিকাশ সম্ভবত বিশ্বাস করতে পারেননি। কারণ অনেক সময় ছিনতাইকারীরাও পুলিশ পরিচয়ে কৌশলে এভাবেই ডেকে ছিনতাই করে থাকে। এমন ভাবনা থেকেই বিকাশ সাদা পোশাকের পুলিশকে ছিনতাইকারী ভেবে মোটরসাইকেল নিয়ে দ্রুত নিরাপদ জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা করেন। এতে পুলিশ সদস্যদের বিকাশের ওপর সন্দেহ বেড়ে যায়। পুলিশ সদস্যরাও বিকাশকে অপরাধী ভেবে আটক করার জন্য দ্রুত তৎপর হয়ে ওঠেন। আর বিকাশ পুলিশ সদস্যদের ছিনতাইকারী ভেবে দ্রুত নিরাপদ জায়গায় চলে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পুলিশ সদস্যরা বিকাশকে অপরাধী ভেবে দ্রুত আটক করতে এক পর্যায়ে বিকাশকে ধাওয়া করেন। এতে বিকাশ ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েছেন বলে পুরোপুরি নিশ্চিত বলে মনে করেন। শেষ পর্যন্ত ধাওয়া করে পুলিশ বিকাশকে ধরে ফেলে। পুলিশ সদস্যরা নিজেদের পরিচয় দেয়। বিকাশ পুলিশ সদস্যদের ছিনতাইকারী ভেবে জোরে ডাক চিৎকার দিতে থাকেন। পুলিশ কর্মকর্তা আকাশ রাগের মাথায় বিকাশের মাথায় লাঠি দিয়ে সজোরে আঘাত করেন। তখন বিকাশ মোটরসাইকেলসহ পড়ে যান। এ সময় অন্য পুলিশ সদস্যরাও বিকাশকে মারধর করেন। মারধরের এক পর্যায়ে বিকাশ নিজের পরিচয় দেন। এবার পুলিশ বিকাশকে সিটি কর্পোরেশনের ভুয়া কর্মকর্তা বলে আরও বেশি সন্দেহ করতে থাকে। এরপর আবার মারধর করা হয় বিকাশকে। শেষ পর্যন্ত বিকাশের পরিবারের লোকজন ও পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে হাজির হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। বিকাশকে দ্রুত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের ২০১ নম্বর ওয়ার্ডের ১১ নম্বর বেডে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে বিকাশকে। মেডিক্যাল সূত্র বলছে, বিকাশের মাথায় গুরুতর কোন আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তবে পায়ে ও হাতের বিভিন্ন জায়গায় এবং শরীরে জখমের চিহ্ন রয়েছে। বিকাশ পরিবারের সঙ্গে ঢাকার দয়াগঞ্জের বাসায় বসবাস করেন। যাত্রাবাড়ীর থানার ওসি অবনী শংকর কর বলছেন, ছিনতাইকারী প্রতিরোধে পুলিশের ওই দলটি গঠন করা হয়েছে। ছিনতাই সাধারণত ভোরে হয়। ঘটনাস্থলটিও ছিনতাইপ্রবণ। সাদা পোশাকে থাকা পুলিশ সদস্যরা বিকাশকে ডাক দেন। বিকাশ পুলিশ সদস্যদের ছিনতাইকারী ভেবে সরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এতে পুলিশ বিকাশকে অপরাধী বলে সন্দেহ করে আটক করতে ধাওয়া করে। ধাওয়ার মুখে বিকাশ মোটরসাইকেলসহ পড়ে যান। এ সময় পুলিশ বিকাশকে ধরে ফেললে অপ্রীতিকর ঘটনাটি ঘটে। খবর পেয়ে পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা এবং বিকাশের পরিবারের লোকজন সেখানে উপস্থিত হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। ঘটনাটি নিছক ভুল বোঝাবুঝির কারণে হয়েছে বলে দাবি করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের ওয়ারী জোনের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার নুরুল আমিন। তিনি বলছেন, সাদা পোশাকে থাকা পুলিশ সদস্যরা বিকাশকে থামার সংকেত দেয়ার সূত্রধরেই ঘটনাটি ঘটে। পুলিশ বিকাশকে অপরাধী ভাবে আর বিকাশ সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্যদের ছিনতাইকারী ভাবে। যে কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যদের গাফিলতি থাকলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, পুলিশ নিজেদের পরিচয় দিয়েই বিকাশকে থামার জন্য ইশারা দেন। ইশারা দেয়ার পর এক পর্যায়ে বিকাশ মোটরসাইকেল নিয়ে থামেন। থামার পর এসআই আকাশ লাঠি দিয়ে বিকাশের মাথায় আঘাত করলে মোটরসাইকেলসহ তিনি পড়ে যান। এরপর পুলিশ সদস্যরা বিকাশকে মারধর করেন। পরে বিকাশের স্বজনরা এবং পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা সেখানে হাজির হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। এর আগে গত ৯ জানুয়ারি রাত এগারোটার দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের যোগাযোগ ও প্রকাশনা বিভাগের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বী মোহাম্মদপুর থেকে কল্যাণপুরের বাসায় ফেরার পথে পুলিশী নির্যাতনের শিকার হন। মোহাম্মদপুর এলাকার একটি এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে বের হচ্ছিলেন ওই ব্যাংক কর্মকর্তা। এ সময় আচমকা পেছন থেকে এক পুলিশ তার শার্টের কলার চেপে ধরেন। ব্যাংক কর্মকর্তার কাছে ইয়াবা আছে বলে ওই পুলিশ সদস্য অভিযোগ তোলেন। ব্যাংক কর্মকর্তা পুলিশ সদস্যের এমন অভিযোগে রীতিমতো হতভম্ব। এ নিয়ে পুলিশ সদস্যের সঙ্গে ব্যাংক কর্মকর্তার বাগ্বিত-া শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত ওই পুলিশ সদস্য ব্যাংক কর্মকর্তাকে টেনে হিঁচড়ে এসআই মাসুদ শিকদারের কাছে নিয়ে যান। এসআই মাসুদও ব্যাংক কর্মকর্তার কাছে ইয়াবা আছে বলে অভিযোগ তোলেন। এমন দাবি ভিত্তিহীন বলে জানালে ব্যাংক কর্মকর্তাকে পুলিশের টহল গাড়িতে তুলে নেয় এসআই মাসুদ। এরপর ব্যাংক কর্মকর্তা নিজের পরিচয়পত্র দেখান। পরিচয় পাওয়ার পর ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন এসআই মাসুদ। টাকা দিতে অস্বীকার করলে ব্যাংক কর্মকর্তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করে বেড়িবাঁধে ফেলে রাখার হুমকিও দেন এসআই মাসুদ। নির্যাতনের একপর্যায়ে খবর পেয়ে সহকর্মী ও পরিচিতরা ঘটনাস্থলে গেলে ব্যাংক কর্মকর্তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। এমন ঘটনা ফাঁস হয়ে গেলে রীতিমতো হৈচৈ পড়ে যায়। এসআই মাসুদকে প্রত্যাহার করা হয়। এমন ঘটনার সূত্রধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্বনর ড. আতিউর রহমান জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হককে চিঠি দেন। বৃহস্পতিবার নওগাঁয় এক অনুষ্ঠানে পুলিশপ্রধান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাকে মারধরের অভিযোগে প্রত্যাহার হওয়া এসআই মাসুদ শিকদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। একই দিন ডিএমপি সদর দফতরে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, কোন পুলিশ সদস্যের ব্যক্তির দায় পুলিশ বাহিনী নেবে না। ব্যক্তিগত অপরাধের দায় ব্যক্তিকেই নিতে হবে। পুলিশ বাহিনী নেবে না। এসআই মাসুদের কর্মকা- পুরো পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করেছে। মাসুদ শিকদারের ঘটনায় গোটা পুলিশ বাহিনী বিব্রত হয়েছে। এ রকম দু’একজনের জন্য পুরো পুলিশ বাহিনীর দুর্নাম হয়। পুলিশ সম্পর্কে মানুষের মনে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়। যা কোনভাবেই কাম্য নয়।
×