ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বইছে সমালোচনার ঝড়

এবার ব্যাপক অসঙ্গতি আর ভুলে ভরা বিসিএসের প্রশ্নপত্র

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১০ জানুয়ারি ২০১৬

এবার ব্যাপক অসঙ্গতি আর ভুলে ভরা বিসিএসের প্রশ্নপত্র

বিভাষ বাড়ৈ ॥ প্রশ্নপত্র ফাঁস না হলেও ব্যাপক অসঙ্গতি আর ভুলে ভরা প্রশ্নের কারণে বিতর্কের মুখে পড়েছে ৩৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা। ব্যাপক কড়াকড়ির মধ্যে শুক্রবার সকাল সাড়ে নয়টা থেকে সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এ পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন দুই লাখ ১১ হাজার ৩২৬ চাকরি প্রার্থী। কেন্দ্রে সুষ্ঠু পরিবেশে পরীক্ষা হলেও বেশ কয়েকটি প্রশ্নে অসঙ্গতি ও ভুল ধরা পড়েছে। বেশ কয়েকটি প্রশ্নে বানান ভুলের কারণে উত্তর দিতে পারেননি পরীক্ষার্থীরা। মুঠোফোনসর্বস্ব এ যুগে গড়নরষব চযড়হব বানান লিখতেও করা হয়েছে ভুল। বড় ধরনের বিতর্ক উঠেছে প্রশ্নের সঙ্গে সঠিক উত্তর যুক্ত না করা নিয়ে। বহু প্রশ্নে চারটি উত্তরের মধ্যে যেগুলো দেয়া হয়েছে তার একটিও সঠিক নয়। বিসিএসের মতো একটা পরীক্ষায় এভাবে প্রশ্নপত্রে ব্যাপক অসঙ্গতি ও ভুলের কারণে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে পরীক্ষার্থীদের মাঝে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বইছে সমালোচনার ঝড়। পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে। প্রশ্নপত্র প্রণয়নের এই ভুলের দায়ভার যেন তাদের ওপর না পড়ে সে বিষয়ে পিএসসি কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা। বিসিএসের মতো দেশের সর্বোচ্চ ক্যাডার সার্ভিস পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ভুল থাকাকে অপ্রত্যাশিত ও লজ্জাজনক বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্টরা। পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকার ১০৭টিসহ বিভাগীয় শহরের যে ১৬২ কেন্দ্রে পরীক্ষা হয়েছে তার প্রতিটি কেন্দ্রেই প্রশ্ন হাতে পেয়ে অনেক পরীক্ষার্থী রীতিমতো কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। অনেক কেন্দ্রেই পরীক্ষার্থীরা তাৎক্ষণিক বিষয়টি হল পরিদর্শকদের জানালেও তারা এর কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। প্রশ্ন প্রণয়নের এই ভুলের জন্য কেন্দ্রে পরীক্ষার্থীদের মূল্যবান সময় নষ্ট হয়েছে। প্রশ্নপত্র পর্যালোচনা করেও পরীক্ষার্থীদের অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। চার নম্বর সেটের (দোলনচাঁপা) ১৮৬ নম্বর প্রশ্নটিতে গড়নরষব চযড়হব বানান লিখতে ভুল করা হয়েছে। সেখানে লেখা হয়েছে ‘গড়নরষব চড়হব।’ প্রশ্নটি এমন ছিল : গড়নরষব চড়হব-এর কোনটি রহঢ়ঁঃ ফবারপব নয়? প্রশ্নটি দেখে প্রায় সকলেই বুঝতে পেরেছেন যে বানান লিখতে ভুল হয়েছে। কিন্তু এটি নিশ্চিত হতে না পেরে অধিকাংশ প্রার্থীই উত্তর দেননি। যেহেতু ভুল উত্তরে নম্বর কাটা যায় তাই অনেক পরীক্ষার্থীই ঝুঁকি নিতে চাননি। রাজধানীর শুক্রাবাদে অবস্থিত নিউ মডেল বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যায় অনার্স ও মাস্টার্স করা রাজীব। প্রশ্নের অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলছিলেন, প্রশ্নে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট যেমন ছিল, তেমনি বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা, মুক্তিযুদ্ধ, বুদ্ধিজীবী হত্যা কিছুই বাদ যায়নি। এ বিষয়টি ভাল ছিল। কিন্তু এত ভুল যে বহু পরীক্ষার্থী প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সময় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছেন। প্রশ্নের ভুলের কারণে অনেক পরীক্ষার্থী বেশ কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই হল ছেড়েছেন। মোবাইল ফোন বানানে ভুল থাকার বিষয়টি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে এ চাকরি প্রার্থী বলেন, ‘বিসিএসের মতো এত বড় পরীক্ষায় এ ধরনের ভুল দুঃখজনক। বর্তমানে দেশের সিংহভাগ মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। এতে ইন্টারনেট ব্যবহার করে ব্যবহারকারীদের বড় একটা অংশ। এ ধরনের ভুল মেনে নেয়া যায় না। ওএমআর শীট নিয়েও তৈরি হয়েছে জটিলতা। ওএমআর শীটে (উত্তর প্রদানের জন্য সরবরাহ করা শীট) প্রশ্নপত্রের কোড আগে থেকেই পূরণ থাকায় বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে অনেককে। সরকারী তিতুমীর কলেজ কেন্দ্রের পরীক্ষার্থী জসীম বলছিলেন, ওএমআর শীটে আগে থেকে প্রশ্নপত্রের কোড ফিল-আপ ছিল। যখন আমাকে প্রশ্নপত্র সরবরাহ করা হলো, তখন দেখি ওএমআর শীটে ফিল-আপ করা কোড আর প্রশ্নপত্রের কোড মেলে না। এমন পরিস্থিতিতে অনেককেই পড়তে হয়েছে। নির্ধারিত সময় না পাওয়ার অভিযোগও করেন জসীম। এদিকে সবচেয়ে বড় ধরনের বিতর্ক উঠেছে বহু প্রশ্নের সঙ্গে সঠিক উত্তর যুক্ত না করা নিয়ে। প্রশ্নে চারটি উত্তরের মধ্যে যেগুলো দেয়া হয়েছে তার একটিও সঠিক নয়। আবার কয়েকটি প্রশ্নে ভুল শব্দ বাছাই করতে বলা হলেও যেসব শব্দ দেয়া আছে তার সবগুলোই সঠিক। চার নম্বর সেটের (দোলনচাঁপা) ১৩৩ নম্বর প্রশ্নে বলা হয়েছে- বর্তমানে ঘঅগ-এর সদস্য সংখ্যা কত? উত্তরে দেয়া আছে ক) ৩৩, খ) ১৫, গ) ৭৭, ঘ) ২১। অথচ এর সঠিক উত্তর হবে ১২০। সঠিক উত্তর প্রশ্নেই নেই। ফলে পরীক্ষার্থীরা অনেকেই প্রশ্নের উত্তর দেননি। রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ কেন্দ্রের পরীক্ষার্থী আকবর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছিলেন, কারা যে বিসিএসের প্রশ্ন করেন? এই ব্যক্তিদের ধরা উচিত। পিএসসির অবস্থান কি হবে তা জানানো উচিত। এত বড় পরীক্ষায় এসে যদি এমন হয় তাহলে আর কোন পরীক্ষায় মান থাকবে। এত বড় পরীক্ষায় এ ধরনের ভুল উদ্বেগজনক। ১৮২ নম্বর প্রশ্নের ছিল ভুল। এই প্রশ্নে বলা হয়, দুটি সমান্তরাল রেখা কয়টি বিন্দুতে ছেদ করে? উত্তর দেয়া আছে-ক) ৪, খ) ২, গ) ৮, ঘ) ১৬। এখানেও নেই সঠিক উত্তর। পরীক্ষার্থীদের একজন ইমরুল বলছিলেন, দুটি সমান্তরাল রেখা কখনই একে অপরকে ছেদ করে না। এটা যারা জানে না তারা কিভাবে বিসিএসের প্রশ্ন করে? এ প্রশ্ন হলেও বলা উচিত ছিল যে, কোনটি নয়। তার না করে যা হয়েছে তা হলো হতাশাব্যঞ্জক ঘটনা। বিষয়টি ভালভাবে তদন্ত করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার বলে দাবি এ পরীক্ষার্থী। দোলনচাঁপা সেটেরই ১৪৩ নম্বর প্রশ্নে ভুল করা হয়েছে। এখানে বানান ভুলের কারণে ভুল হওয়ার ভয়ে উত্তর দেননি অনেক পরীক্ষার্থী। এখানে বলা হয়, জীব জগতের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর রশ্মি কোন্টি? উত্তরে ক) আলফা রশ্মি, খ) বিটা রশ্মি, গ) গালা রশ্মি, ঘ) আল্ট্রাভায়োলেট রশ্নি। সঠিক উত্তর গামা রশ্মি হলেও লেখা হয়েছে ‘গালা রশ্মি’। গামার স্থলে গালা লেখায় হয় নিজের মতো বুঝে এটাতেই অনেকে উত্তর দিয়েছেন। আবার কি দিলে কি হয় তা ভেবে উত্তর দেননি যদি নম্বর কাটা যায় এই ভয়ে। আরেকটি প্রশ্নে লেখা হয়েছে সরকারের বড় অর্জন কোনটি। চারটি অর্জনের কথা বলা হলেও তার প্রত্যেকটিই সরকারের অর্জন। পিএসসির এক কর্মকর্তা বলছিলেন, বড় অর্জন কোনটি এমসিকিউতে এটা কোন প্রশ্ন হতে পারে না। এটা তো একেক জনের কাছে একেক রকম হবে। বাংলা বিষয়ে একটি প্রশ্নে বলা হয়েছে, গ্রামের প্রাধান্য পেয়েছে কোন প্রবন্ধে? যে চারটি প্রবন্ধের কথা বলা হয়েছে তার প্রত্যেকটিতেই প্রাধান্য পেয়েছে গ্রাম। এমন অসংখ্য ভুলে ভরা প্রশ্নে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরীক্ষার্থীরা। বিসিএসের মতো দেশের সর্বোচ্চ ক্যাডার সার্ভিস পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ভুল থাকাকে অপ্রত্যাশিত ও লজ্জাজনক বলে মন্তব্য করছেন শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্টরা। শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান বলছিলেন, ভুল সংশোধনযোগ্য। তবে বড় ভুল কোনভাবেই কাম্য নয়। তাই এটা যাতে না হয় সেজন্য অবশ্যই যোগ্য ব্যক্তিদের দিয়ে কাজ করা উচিত। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবীর বলছিলেন, বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ভুল হওয়াটা খুবই অনাকাক্সিক্ষত। প্রত্যাশিত নয়, মেনেও নেয়া যায় না। এখানে যারা কাজ করেন তারা সতর্কভাবে কাজ করলে এ ধরনের ভুল হওয়ার কথা নয়। ভবিষ্যতে এ ধরনের ভুল যাতে আর না হয় সেজন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আরও সতর্কভাবে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি। তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, এটা তো পরিষ্কার যে বা যারাই প্রশ্ন করুক তারা মনোযোগ দিয়ে কাজটা করেননি। মডারেশন যারা করেছেন তারাও মনোযোগ দেননি। আসলে কি অনেকেই প্রশ্ন করেন যারা ঠিকভাবে তার উত্তরই জানেন না। আমি আমার কর্মজীবনেও দেখেছি অনেকেই আছেন প্রশ্ন করবেন বলে এগিয়ে আসেন। কিন্তু তিনি যে প্রশ্নটা করবেন তার সঠিক উত্তর তিনিই জানেন না। বিসিএসের মতো এটা পর্যায়ে এমন ভুল মানা যায় না। এদিকে প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক হলেও কোন পরীক্ষার্থীর বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে না বলে আশ্বস্ত করেছেন পিএসসির চেয়ারম্যান ইকরাম আহমেদ। শনিবার সন্ধ্যায় তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা অবশ্যই বিষয়টি দেখব। যদি এমন হয় হবে নিয়ম অনুসারে প্রার্থীদের স্বার্থ রক্ষা করেই সিদ্ধান্ত নেব। আগেও দু’একবার এমন হয়েছে প্রতিবারই প্রার্থীদের স্বার্থ রক্ষা করেই সিদ্ধান্ত হয়েছে। এবারও আমি আশ্বস্ত করছি, এ নিয়ে চিন্তার কোন কারণ নেই। কেউ যাতে সামান্যতম ক্ষতির মুখে না পড়েন তাই করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, আসলে সিস্টেম অনুসারেই প্রশ্ন বাইরে থেকে করা হয়। বাইরেই সিলগালা হয়। আমরা দেখতে পারিনা পরীক্ষার আগে। এটা নিয়ম। আজ রবিবার অফিস খোলার পর প্রশ্ন ভালভাবে দেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে বলেছেন পিএসসির এক সদস্য। তিনিও নিয়মের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, প্রশ্নে ভুল হলেও পরীক্ষার্থীদের পক্ষেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। প্রশ্নে ভুল হলে সেই নম্বরগুলো বাদ দিয়েই মূল্যায়ন করা হবে। যারা এ প্রশ্ন করেছেন এবং যারা মডারেশন করেছেন তদন্তসাপেক্ষে তাদের কালো তালিকাভুক্ত করা হবে। এই ব্যক্তিরা পরবর্তীতে আর এ কাজ করতে পারবেন না। এর আগে গত ৩১ মে ৫৪২ সাধারণ ক্যাডারসহ দুই হাজার ১৮০ পদে নিয়োগের লক্ষ্যে এ বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পিএসসি। এরপর ১৪ জুন সকাল দশটা থেকে ২৩ জুলাই সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত চলে অনলাইনে আবেদন কার্যক্রম। ৩৬তম বিসিএসে সাধারণ ক্যাডারে মোট পদ রয়েছে ৫৪২। এর মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারে ২৫০, পুলিশ ক্যাডারে ১২০, কর ক্যাডারে ৪৩, তথ্য ক্যাডারে ৩৭। সমবায় ক্যাডারে ২২, পররাষ্ট্র ক্যাডারে ২০, আনসার ক্যাডারে ১৯, নিরীক্ষা ও হিসাব ক্যাডারে ১৫, খাদ্য ক্যাডারে সাতটি, ইকোনমিক ক্যাডারে চারটি, ডাকে দুটি এবং পরিবার পরিকল্পনা ক্যাডারে একটি পদ রয়েছে। কৃষি ক্যাডারে ৩৯৭ ও স্বাস্থ্য ক্যাডারে ১৮৭সহ প্রফেশনাল বা কারিগরি ক্যাডারে মোট পদ রয়েছে ৭৪০। এ ছাড়া বিসিএস সাধারণ শিক্ষায় ৮৭১, সরকারী শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজের জন্য ২৩ ও কারিগরি কলেজগুলোর জন্য চারটি পদ রয়েছে। গত ৩৫ বিসিএসর মতো এবারও প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয় ২০০ নম্বরে।
×