ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ন্যায্য কমিশন দাবিতে আটাবের আন্দোলন

এমিরেটস ও মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স ব্যবসায় ধস

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ৯ জানুয়ারি ২০১৬

এমিরেটস ও মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স ব্যবসায় ধস

আজাদ সুলায়মান ॥ ন্যায্য কমিশনের দাবিতে আটাব টিকেট বিক্রি বন্ধ করে দেয়ায় এমিরেটস ও মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের ব্যবসায় ধস নেমেছে। কমতে শুরু করেছে যাত্রী। পরিস্থিতি সামাল দিতে এমিরেটস কিছুটা নমনীয় মনোভাব প্রকাশ করেছে। এতে সুনির্দিষ্টভাবে কোন প্রস্তাব না দেয়ায় আটাব আন্দোলন প্রত্যাহার করতে পারছে না। তবে বৃহস্পতিবার বিকেলে এমিরেটস আটাব-এর দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দিলেও নীরব রয়েছে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স। আজ (শনিবার) থেকে এমিরেটসকে আন্দোলনের বাইরে রাখা হবে বলে জানান আটাব সভাপতি সৈয়দ মঞ্জুর মাহবুুব মোর্শেদ। এদিকে আটাব বলছে, এ আন্দোলন আর এক সপ্তাহ চললে এ দুটো এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ফাঁকা যাবে। সম্ভবত সেটা আঁচ করতে পেরেই তারা আটাব-এর সঙ্গে সমঝোতা করতে আগ্রহী। এ সম্পর্কে আটাব সভাপতি সৈয়দ মঞ্জুর মাহবুব মোর্শেদ জনকণ্ঠকে বলেছেন, এমিরেটস বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশনা মেনে ফুয়েল সারচার্জের সঙ্গে ভাড়ার টাকা যোগ করে কমিশন দিতে রাজি হয়েছে। এ জন্য তারা বৃহস্পতিবার একটি লিখিত আশ্বাস দেয়ায় তাদেরকে আন্দোলনের বাইরে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কিন্তু এখনও মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স থেকে কোন ধরনের আশ্বাস মিলছে না। কবে নাগাদ দাবি পূরণ করবে সেটাও বলছে না। তারা যদি সুনির্দিষ্ট তারিখ বা দিন ক্ষণ নিয়ে কথা বলত তাহলে সেটার ওপর বিশ্বাস রেখে আন্দোলন প্রত্যাহার করা যেত। কিন্তুুু এখন তারা শুধু বলছে, যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি এ দাবি মেনে নেয়া হবে। এ ধরনের আশ্বাসে তো আন্দোলন প্রত্যাহার করা যাচ্ছে না। কারণ ঢাকাসহ দেশব্যাপী খুব কঠিন আন্দোলন চলছে। উল্লেখ্য, পূর্বঘোষণা অনুযায়ী গত পয়েলা জানুয়ারি থেকে এমিরেটস এয়ারলাইন্স ও মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সকে বয়কট করেছে ট্রাভেল এজেন্টদের সংগঠন- এ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব)। এতে রাজধানীসহ দেশব্যাপী সব ট্রাভেলস এজেন্ট একযোগে এমিরেটস ও মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের সব ধরনের টিকেট বুকিং বন্ধ করে দেয়। আটাব দীর্ঘদিন ধরেই এ ধরনের আন্দোলনের হুমকি দিয়ে আসছিল। কিন্তু সেটাকে খুব বেশি আমলে নেয়নি এ দুটো বিদেশী বিমান সংস্থা। এদিকে শুক্রবার হজরত শাহ জালাল বিমানবন্দরে গিয়ে দেখা যায়, এ দুটো এয়ারলাইন্সের চেকইন কাউন্টারে আগের মতো ভিড় নেই। আন্দোলনের আগে এদের ফ্লাইটে যেখানে যাত্রী পূর্ণ থাকত, এখন সেটা দুই-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে একজন এমিরেটস কর্মকর্তা জানান, আন্দোলন চলছে মাত্র ৮দিন ধরে। এখনই এর রেশ মিলবে না। এয়ারলাইন্স ব্যবসায় সাধারণত বুকিং বন্ধ রাখার পরিণাম তাৎক্ষণিক চোখে পড়ে না। সপ্তাহ দুয়েক পর সেটা বেঝিা যায়। এখনও যে যাত্রী আসছে সেগুলোর বুকিং দেয়া ছিল অন্তত মাসখানেক আগে। জানুয়ারির প্রথম দিন থেকে বুকিং বন্ধ করার পর এমিরেটস ও মালয়েশিয়ান এয়ারের টিকেট বিক্রি কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। প্রতিদিন গড়ে কম করে হলেও এক কোটি টাকা বিক্রি কমেছে। তবে এ দুটো এয়ারলাইন্সের প্রতিনিধিরা এ সব বিষয় অস্বীকার করেছেন। তারা দাবি করছেন, ট্রাভেল এজেন্টস ছাড়াও অনলাইনে টিকেট বেচাকেনা হচ্ছে। জানতে চাইলে এমিরেটস প্রতিনিধি ইসমাইল হোসেন ও মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের সফিউল কথা বলতে রাজি হননি। এদিকে আন্দোলনের কারণ সম্পর্কে আটাব সভাপতি সৈয়দ মঞ্জুর মাহবুব মোর্শেদ জানান, অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলো। কোম্পানিগুলোর ‘ফুয়েল সারচার্জের’ ট্যাক্স কারসাজিতে একদিকে যেমন ট্রাভেল এজেন্টরা কমিশন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, অন্যদিকে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এ নিয়ে ট্রাভেল এজেন্সিগুলো বার বার অভিযোগ তুললেও কানে নিচ্ছে না কেউ। এ জন্যই পূর্বঘোষণা অনুযায়ী পয়েলা জানুয়ারি থেকে এমিরেটস এয়ারলাইন্স এবং মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সকে বয়কট করেছে ট্রাভেল এজেন্টদের সংগঠন এ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব)। জানা যায়, এ সব এয়ারলাইন্স, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং সিভিল এভিয়েশন দফায় দফায় মিটিং করলেও কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের বিমানবন্দরে বর্তমানে দেশী-বিদেশী মিলিয়ে মোট ৩৪টি এয়ারলাইনের বিমান ওঠানামা করছে। এর মধ্যে ২২টি বিদেশী ও পাঁচটি দেশী এয়ারলাইন যাত্রী বহন করছে। এ ছাড়া সাতটি কার্গোবাহী এয়ারলাইনও ব্যবসা করছে এখানে। ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট এ্যাসোসিয়েশন আইএটিএ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে বিদেশী এয়ার সংস্থাগুলো বছরে গড়ে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা আয় করে। মূলত টিকিট বিক্রি ও কার্গো ভাড়া থেকে এই আয় হয়ে থাকে। নিয়ম অনুযায়ী ভ্রমণ শুল্ক, এম্বারকেশন শুল্ক, এয়ারপোর্ট ট্যাক্স বাদ দিয়ে পুরো আয়ের ওপর সরকারী কর ও ট্রাভেল এজেন্টকে কমিশন দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু এয়ারলাইন্সগুলো তা না করে বছরে গড়ে মাত্র দেড় হাজার কোটি টাকার ওপর সরকারী কর ও ট্রাভেল এজেন্টদের কমিশন দিচ্ছে। বাকি ৩ হাজার কোটি টাকা ফুয়েল সারচার্জের (ওয়াইকিউ/ওয়াইআর) নামে নিয়ম-বহির্ভূতভাবে বিদেশে পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে। সেই হিসাবে সরকার ও দেশীয় ট্রাভেল এজেন্সিগুলো বছরে গড়ে ৩০০ থেকে ৩৫০ কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। আটাব জানায়, বাংলাদেশ থেকে ঢাকা মালয়েশিয়া-ঢাকা রুটের ৩৪ হাজার টাকা মূল্যের একটি রাউন্ড টিকিট ক্রয় করলে ওই এয়ারলাইন্স ফুয়েলচার্জ কেটে নেয় ১৫ থেকে ১৭ হাজার টাকা। এ ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স ওই টিকিটের মোট ভাড়ার মাত্র ১৭ হাজার টাকার ওপর সরকারী কর ও ট্রাভেল এজেন্টদের কমিশন দেয়। আর বাকি অর্ধেক টাকা কোনো ধরনের শুল্ক ছাড়াই তাদের দেশে চলে যায়। গলাকাটা টিকিটের দাম পরিশোধ করতে হয় সাধারণ ক্রেতাদেরও। গত ডিসেম্বরে বিমান মন্ত্রণালয়কে আটাবের দেয়া একটি চিঠির মাধ্যমে এই পুরো বিষয়টি সবার নজরে আসে। এরপরই ফুয়েল সারচার্জের অবৈধ কারসাজি বন্ধ করে টিকিটের সম্পূর্ণ ভাড়া ও কার্গো ভাড়ার ওপর সরকারী কর এবং ট্রাভেল কমিশন প্রদানের জন্য এয়ারলাইন্স সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়। কিন্তু এখনও মন্ত্রণালয়ের এই নির্দেশ কার্যকর করেনি কোন এয়ার সংস্থা। ফলে প্রথম ধাপে অপেক্ষাকৃত বেশি অভিযুক্ত এমিরেটস এয়ারলাইন্স এবং মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সকে বয়কট করেছে আটাব। এর পরের তালিকায় আছে টার্কিস এয়ার, কাতার এয়ারলাইন্স এবং সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স। এমন কি সারচার্জের বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার পর বেবিচকের পরিচালক (ফ্লাইট সেফটি) গ্রুপ ক্যাপ্টেন নাজমুল আনামকে আহ্বায়ক করে ৬ সদস্যের যে কমিটি করা হয় সে কমিটির সুপারিশও কার্যকর হয়নি। কমিটির সুপারিশের পর অনুষ্ঠিত এক উচ্চপর্যায়ের সভায় টিকিটের মূল ভাড়া থেকে ফুয়েল সারচার্জ বাদ দিয়ে কর ও কমিশন নির্ধারণ করা হয়েছিল। একই সঙ্গে যেসব বিদেশী এয়ারলাইন্স দেশের সিদ্ধান্ত মানবে না তাদের অপারেশন স্থগিত করারও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু রহস্যজনকভাবে তা কার্যকর হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, বিমান মন্ত্রণালয় ও বেবিচকের কিছু শীর্ষ কর্মকর্তার যোগসাজশে বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলো এই অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে আটাব সাধারণ সম্পাদক আসলাম খান জনকণ্ঠকে বলেন, ৭৫ ভাগ এয়ারলাইন্সই নিয়মবহির্ভূতভাবে সারচার্জের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছে। এতে প্রকৃত কমিশন থেকে বঞ্চিত হচ্ছি আমরা। আর রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। কার্যকর সমাধানে দ্রুত সরকার বা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। আটাব সভাপতি সৈয়দ মঞ্জুর মাহবুব মোর্শেদ জনকণ্ঠকে বলেন, এ দুটো এয়ারলাইন্স গত এক সপ্তাহে বড় ধরনের ব্যবসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এমিরেটস প্রতিদিন গড়ে কমপক্ষে ৪ থেকে ৫শ’ টিকেট বিক্রি করত বাংলাদেশে। এ আন্দোলনের কারণে এক-চতুর্থাংশ টিকেটও বিক্রি করতে পারেনি। শুধু অনলাইনে কত আর বিক্রি হয়? এটা আচ করতে পেরেই তারা দ্রুত দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দেয়। কিন্তু মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স এখনও আন্দোলন নিয়ে কোন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। দাবি না মানা পর্যন্ত আটাব তাদের টিকিট বিক্রি ও বুকিং বন্ধ রাখবে।
×