ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দলছুট সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে বিএনপি জোট

প্রকাশিত: ০৫:০৩, ৯ জানুয়ারি ২০১৬

দলছুট সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে বিএনপি জোট

শরীফুল ইসলাম ॥ বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এখন শরিকদের নিয়ে সঙ্কটে আছে। বিশেষ করে জোটের দীর্ঘদিনের শরিক ইসলামী ঐক্যজোটে বিএনপির সঙ্গ ত্যাগ করায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তবে ওই দলের প্রভাবশালী শীর্ষ নেতা চলে যাওয়ার পর ডামি নেতা দিয়ে শীর্ষ পদ পূরণ করে জোটে ২০ দলের সংখ্যা ঠিক রাখা হলেও এতে রাজনৈতিকভাবে যে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে তা কাটিয়ে উঠতে হিমশিম খাচ্ছে। ১৯৯৯ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার করতে বিএনপি, জামায়াত, এইচএম এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি ও মুফতি ফজলুল হক আমিনীর নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্যজোট মিলে চারদলীয় রাজনৈতিক জোট গঠিত হয়। শুরুতেই এ জোট রাজনৈতিক মাঠে এক্যবদ্ধ কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে নিজেদের শক্তি প্রদর্শনে সক্ষম হয়। তবে স্বল্প সময়ের মধ্যেই জোট থেকে এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি বেরিয়ে গেলে চারদলীয় জোট প্রথমবারের মতো হোঁচট খায়। অবশ্য এরশাদের জাতীয় পার্টির এক সময়ের মহাসচিব নাজিউর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন বিজেপির যোগদানের মধ্য দিয়ে চারদলীয় জোট অটুট থাকে। এরপর সরকারবিরোধী আন্দোলনের পাশাপাশি ২০০১ সালের নির্বাচনে জোটগতভাবে অংশ নিয়ে বিপুল বিজয়ের মধ্য দিয়ে তারা সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু জোটগতভাবে নির্বাচন করেও বিএনপি ও জামায়াত ছাড়া অন্য দুই দলকে মন্ত্রিত্ব না দেয়ায় এ দুটি দল কিছুটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতা ত্যাগের পর ভিন্ন রাজনৈতিক পেক্ষাপটে চারদলীয় জোট তাদের অতীত কর্মকা- নিয়ে ব্যাপক সমালোচিত হয়। ওয়ান-ইলেভেনের পর রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে এ জোট। এ পরিস্থিতিতে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবি হয় চারদলীয় জোটের। বিপুল বিজয়ের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট। এর পর আওয়ামী লীগের শাসনামলে ২০১১ সালে নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলনে গতি আনতে চারদলীয় জোটের পরিসর বাড়িয়ে ১৮ দলীয় জোট গঠন করে বিএনপি। এ জোট ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করায় আবারও রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ জোট। এ নির্বাচনের পর কাজী জাফর আহমদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির যোগদানের মধ্য দিয়ে তা ১৯ দলীয় হয়েছিল। পরে সাম্যবাদী দলের একাংশ যোগ দিলে তা হয় ২০ দল। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২০ দলীয় জোট অংশ না নেয়ার প্রতিবদে ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে এ জোট থেকে প্রথমে বের হয়ে যান শেখ আনোয়ারুল হক নেতৃত্বাধীন ন্যাপ ভাসানী। আর ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান শেখ শওকত হোসেন নীলু ২৪ আগস্ট সংবাদ সম্মেলন করে ২০ দলীয় জোট ত্যাগের ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে ওই জোট থেকে বেরিয়ে আসেন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) মহাসচিব আলমগীর মজুমদার। ২৫ সেপ্টেম্বর ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করে আসা শীর্ষ নেতারা আরও ক’টি দলের শীর্ষ নেতাকে নিয়ে নতুন রাজনৈতিক জোট এনডিএফ গঠন করেন। এতে শেখ শওকত হোসেন নীলু চেয়ারম্যান এবং আলমগীর মজুমদার মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। এ জোটের অন্য দলগুলো হচ্ছে ২০ দলীয় জোট থেকে সরে আসা মুসলিম লীগ (জোবাইদা কাদের-আতিক), বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি (আবদুর রশিদ প্রধান), লেবার পার্টি (সেকান্দর আলী)। শওকত হোসেন নীলুর নেতৃত্বাধীন জোট এনডিএফে ২০ দলীয় জোট থেকে আসা উপরোক্ত দলগুলো ছাড়াও রয়েছে ভাসানী মঞ্চ (মমতাজ চৌধুরী), তৃণমূল ন্যাপ ভাসানী, জাগদল ও ইনসাফ পার্টি (শহীদ চৌধুরী)। এ জোটের কর্মসূচীতে ২০ দলীয় জোট সম্পর্কে বিষোদগার করায় রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিএনপি জোট। সর্বশেষ ৭ জানুয়ারি ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে দীর্ঘ ১৭ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে আসেন ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ নেজামীসহ দলটির অধিকাংশ সিনিয়র নেতা। যদিও দলটির সিনিয়ার ভাইস চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট আব্দুর রকিবকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করে ইসলামী ঐক্যজোটের একটি ক্ষুদ্র অংশ ২০ দলীয় জোটে থাকার ঘোষণা দিয়ে এ জোটের দলের সংখ্যা অটুট রাখে। অবশ্য একইভাবে ২০ দলীয় জোট ছেড়ে আসা সব দলেরই অন্য নেতাদের শীর্ষ পদে বসিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া জোটে দলের সংখ্যা ঠিক রেখেছেন। জানা যায়, একের পর এক শীর্ষ নেতারা বিএনপির সঙ্গ ছাড়ার পর জোড়াতালি দিয়ে ২০ দলীয় জোট অটুট রাখা হলেও এ জোট দিন দিন কাগুজে বাঘে পরিণত হচ্ছে। এ জোটে ২০টি দল থাকলেও বিএনপি ও জামায়াত ছাড়া অন্য কোন দলের দেশব্যাপী পরিচিতি নেই। তাই এই নামসর্বস্ব দলগুলোকে নিয়ে জোটবদ্ধ কোন কর্মসূচী দিয়ে আগের মতো আর কর্মসূচী সফল করতে পারছেন না খালেদা জিয়া। তাই আপাতত বিএনপি এককভাবেই কর্মসূচী চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দল জামায়াত যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এছাড়া সরকারের তরফ থেকে এ বছরের মধ্যেই এ দলটিকে রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের বেশ ক’জন শীর্ষ নেতার ফাঁসি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে দলটির এখন চরম দুরবস্থা। দলের অধিকাংশ নেতা গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ২০ দলীয় জোটের অন্য দলগুলোরও দুরবস্থা। এ কারণেই ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ২৩৪ পৌরসভা নির্বাচনে জোটের শরিক দলগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেয়নি বিএনপি। আর শরিক দলগুলোও বিএনপির পক্ষে আগের মতো শক্ত অবস্থান নিয়ে মাঠে নামেনি। তাই পৌরনির্বাচনে ভরাডুবি হয় বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের। এতে যখন দেশের রাজনীতিতে বিএনপি জোটের চরম দুর্বলতা প্রকাশ পায় ঠিক তখনই ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ নেজামীর নেতৃত্বে দলটির অধিকাংশ সিনিয়র নেতা ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করেন। আরও ক’টি দল তাদের অনুসরণ করে সরে যাওয়ার প্রহর গুনছে বলে জানা গেছে। এদিকে ২০ দলীয় জোটের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিরও এখন চরম দুরবস্থা। কেন্দ্রীয় কমিটিসহ দলের সর্বস্তরে কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও তা পুনর্গঠন করতে পারছে না দলটি। আর ক্ষমতা থেকে অনেক দূরে সরে আসায় এবং বার বার আন্দোলন করে ব্যর্থ হওয়ায় দলটি এখন থমকে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া দলের অধিকাংশ প্রভাবশালী নেতার বিরুদ্ধে মামলা, কোন কোন নেতা কারাগারে এবং কেউ কেউ পলাতক থাকায় সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে বিএনপি। নিজেদের দুর্বলতার পাশাপাশি জোটের শরিক দলগুলোও দুর্বল হয়ে পড়ায় সামনে এগিয়ে যাওয়ার গতি পাচ্ছে না বিএনপি। আর এ কারণেই এবার পৌরসভা নির্বাচনের পর কোন কর্মসূচী দেয়নি বিএনপি বা ২০ দলীয় জোট। তবে এটি নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে ধীরগতিতে সামনে এগিয়ে যাওয়ার কৌশল বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন দলকে নিয়ে জোট গঠন করা হয়। কিন্তু জোটের কোন শরিক দলের শীর্ষ নেতা চলে গেলেও যদি অন্য নেতারা থেকে যান তাহলে সাময়িক কিছু ক্ষতি হলেও এক সময় ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যায়। তবে জোটে কে কখন যাবে বা আসবে তা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে কেউ আসবে আর কেউ যাবে এমনটিই হয়। আর সব রাজনৈতিক দলের সময় সব সময় সমান যায় না।
×