ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তারেকের আয়ের খোঁজে দুদক

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ৮ জানুয়ারি ২০১৬

তারেকের আয়ের খোঁজে দুদক

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিএনপির সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান তারেক রহমানের যাবতীয় সম্পদ ও আয়ের উৎস অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বুধবার কঠোর গোপনীয়তায় অনুষ্ঠিত দুর্নীতি দমন কমিশনের সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। বৃহস্পতিবার দুদকের একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। অনুসন্ধানের দায়িত্ব পেয়েছেন দুদকের উপ-পরিচালক মোঃ হারুনুর রশিদ। বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের লন্ডনে অবস্থানকালে ব্যয় ও আয়ের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন উঠলে দুদকের পক্ষ থেকে এমন সিদ্ধান্ত হয়। যদিও বিষয়টি সর্ম্পকে দুদকের কেউ আনুষ্ঠানিক কোন বক্তব্য দেননি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আয় না থাকলেও তারেক রহমান পরিবার নিয়ে লন্ডনে বিলাসী জীবনযাপন করছেন। প্রতিমাসে খরচ হচ্ছে কমপক্ষে ৪ হাজার পাউন্ড। যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৫ লাখ টাকার সমান। কিনেছেন ২টি বিলাস বহুল দামি গাড়ি। এসব অর্থের উৎস সর্ম্পকে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। সূত্র বলছে, যেখানে পাকিস্তানের সাবেক সামরিক শাসক ইস্কান্দর মির্জাকে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে লন্ডনেই হোটেলের ম্যানেজার, উগা-ার ইদি আমিনকে সৌদি আরবে ঝাড়ুদার, ইরানের রেজা শাহ পাহলবী প্রচ- অর্থকষ্টে জীবনযাপন করেছেন, সেখানে বিনা রোজগারে তারেক রহমান কিভাবে বিলাসী জীবনযাপন করছেন তা নিয়ে চলছে বিস্তর আলোচনাÑসমালোচনা। তারেক রহমানের বিলাসী জীবনযাপনের জন্য ব্যয় হওয়া অর্থ কিভাবে কোথা থেকে আসছে তা নিয়ে খোদ যুক্তরাজ্যেও ব্যাপক গুঞ্জন চলছে। সম্প্রতি ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়ে অনেকটা প্রকাশ্যেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি। প্রকাশ্যে ঘোরাফেরার কারণেই প্রকাশ পেয়ে গেছে তার বিলাসী জীবনযাপনের তথ্য। যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক জনমত ম্যাগাজিনের ৪৬ সংখ্যায় প্রকাশিত এক বিশেষ প্রতিবেদনেও এমন তথ্য জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে মোট ২৫টি মামলা রয়েছে। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রয়েছে ১৪টি মামলা। ২০০৭ সালে এসব মামলা দায়ের হয়। ২০০৯ সালে একটি মামলা প্রত্যাহার করা হয়। ৪টি মামলা উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে। জীবনে আর রাজনীতি করবেন না এমন মুচলেকা দিয়ে তারেক রহমান চিকিৎসা সেবা গ্রহণের জন্য প্যারোলে মুক্তি পান। ২০০৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর চিকিৎসার জন্য প্যারোলে মুক্তি পেয়ে তারেক রহমান লন্ডনে যান। চিকিৎসা নিতে থাকেন লন্ডনের ওয়েলিংটন হসপিটাল থেকে। বসবাস শুরু করেন লন্ডনেই। এদিকে বিভিন্ন মামলার শুনানিতে তারেক রহমান আদালতে উপস্থিত না হওয়ায় আদালত তারেক রহমানকে পলাতক বিবেচনা করে তাঁর জামিন বাতিল করে দেন। বর্তমানে তারেক রহমান বিধিমোতাবেক পলাতক আসামি। তারেক রহমান লন্ডনে যাওয়ার পর থেকেই এনফিল্ড টাউন ও সাউথ গেট নামক এলাকা দুটির মাঝামাঝি যুক্তরাজ্য বিএনপির প্রভাবশালী নেতা কমর উদ্দিনের কেনা একটি বিলাস বহুল বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। লন্ডনে দীর্ঘ সময় বসবাসের সুযোগ করে নিতে তারেক রহমান ২০০৮ সালেই লন্ডন থেকে বার এট ল ডিগ্রী (ব্যারিস্টার) সম্পাদনের উদ্যোগ নেন। তারেক রহমান বাংলাদেশী গ্রাজুয়েট। যে কারণে ব্রিটেনের নিয়মানুযায়ী তাকে প্রথমেই লন্ডনের কোন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রী অর্জন করতে হবে। তিনি ব্যাচেলর ডিগ্রী অর্জন করতে ব্যর্থ হন। এক্ষেত্রে কোন রাজনৈতিক সুবিধাও পাননি তিনি। সাউথ ব্যাঙ্ক ইউনিভার্সিটি এবং কুইন মেরী ইউনিভার্সিটিতে তারেক রহমান লন্ডনের ব্যাচেলর ডিগ্রী ছাড়াই বার-এট-ল করার উদ্যোগ নিলে ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ তারেক রহমানকে সরাসরি ফিরিয়ে দেয়। এরপর থেকে অনেকটা স্থায়ীভাবেই কমর উদ্দিনের বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। কমর উদ্দিন বাড়িটি ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বরে কিনে নেন। বাড়িটির মাসিক মর্টগেজ দিতে হতো ৩৩৫ পাউন্ড। যা বর্তমানে ২২০ পাউন্ডে নেমে এসেছে। মর্টগেজের টাকাও তারেক রহমানকে দিতে হয় না। কমর উদ্দিন উল্টো তারেক রহমানের বাড়ির খরচও চালাতেন। লন্ডনে যাওয়ার পর কমর উদ্দিন তাঁর ব্যক্তিগত জাগুয়ার গাড়িটি তারেক রহমানকে দিয়ে দেন। মাসিক ৮শ’ পাউন্ড বেতনে গাড়িটির চালক হিসেবে নিয়োগ পান শরীফুল ইসলাম। পরে তারেক রহমান ক্যাব্রিজ হিথ রোড থেকে ২টি গাড়ি কিনেন। এর মধ্যে একটি বিএমডব্লিউ সেভেন সিরিজের। অপরটি অডি। তারেক রহমান নিজের গাড়িতে করে প্রায়ই মেয়ে জাইমাকে স্কুল থেকে আনার জন্য গাড়িচালকের সঙ্গে স্কুলে যেতেন। মাঝে মধ্যেই তিনি পরিবার নিয়ে বাসার নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা করতেন পন্ডার্স এ্যান্ডের টেসকো দোকান থেকে। কেনাকাটায় সহায়তা করতেন কমর উদ্দিনের রেস্টুরেন্টের কয়েকজন বিশ্বস্ত কর্মচারী। প্রায় প্রতিদিনই রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আসত তারেক রহমানের পরিবারের জন্য। প্রতিমাসে লেক সাইড ও ব্লু ওয়াটার এবং সেন্ট্রাল লন্ডনের সেলফ্রিজেস থেকে শপিং করতেন। এছাড়া সেলফ্রিজেসের হোম এক্সেসরিজেও যেতেন। সেলফ্রিজ ও ব্লু ওয়াটার যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বিলাসবহুল এবং ব্যয় বহুল শপিং মল। মূলত ব্রিটেনের ধনীরাই সেখানে কেনাকাটা করে থাকেন। এছাড়া তারেক রহমান প্রায়ই সপরিবারে উডগ্রিন সিনে ওর্য়াল্ডে সিনেমা দেখতেন। মাঝেমধ্যে আপ্টন পার্কের বলিনেও সিনেমা দেখতেন। তিনি লন্ডনের বিএনপির প্রাক্তন নেতা কমর উদ্দিনের মেয়ের বিয়েতে হাজির হন। সেখানে তাঁকে ছড়ি হাতে দেখা যায়। কমর উদ্দিনের মৃত্যুর পরও বিলাসী জীবনযাপন করছেন তারেক রহমান। বর্তমানে তিনি বসবাস করছেন কিংসটনে। এ এলাকার ৩Ñ৪ বেডরুমের বাসার মাসিক ভাড়া ১২শ’ থেকে ৫ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত। সি ব্যান্ডের বাসার জন্য কাউন্সিল ট্যাক্স ১৪৭৪ পাউন্ড ৬৭ পেন্স। বিদ্যুত গ্যাসসহ ইউটিলিটি বিল নূ্যূনতম ১৫০ পাউন্ড। পরিবারের যাতায়াত খরচ ন্যূনতম একশ’ পাউন্ড। এছাড়া লন্ড্রি, পোশাক, সংবাদপত্র, মোবাইল ও টেলিফোন বিলসহ আরও ন্যূনতম ৭ থেকে ৮শ’ পাউন্ড খরচ আছে। সব মিলিয়ে ন্যূনতম ৪ হাজার পাউন্ড খরচ রয়েছে তারেক রহমানের। বিগত প্রায় ৮ বছর ধরে লন্ডনে বসবাস করছেন তিনি। দীর্ঘ সময়ে তিনি কোন অর্থনৈতিক কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত নন। স্ত্রী ডাঃ জুবাইদা গুলশান আরাও কিছু করেন না। উপরন্ত মেয়ে জাইমা লন্ডনে পড়াশুনা করছে। সাধারণত বাইরে বের না হলেও মেয়েকে স্কুল থেকে আনার জন্য প্রায়ই চালকের সঙ্গে বাইরে যান। সম্প্রতি তিনি ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছেন। এদেশে তারেক রহমান ও তাঁর মা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বেশ কয়েকটি ব্যাংক এ্যাকাউন্ট জব্দ করা আছে। সে সুবাদে তারেক রহমানের একমাত্র বৈধ রোজগার হিসেবে তাঁর মা খালেদা জিয়ার বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে সংসদের বেতন। বেতনের টাকা দিয়ে তারেক রহমানের এমন বিলাসী জীবনযাপনের জন্য ব্যয় হওয়া একাংশ মেটানো সম্ভব নয়। অথচ পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইস্কান্দর মির্জা ক্ষমতাচ্যূত হয়ে লন্ডনে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন। লন্ডনে বসবাসকালে তিনি প্রচ- অর্থকষ্টে পড়েন। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে একটি হোটেলের ম্যানেজার হিসেবে চাকরি করতে হয়েছে। ইস্কান্দর মির্জাকে দারুণ অর্থ কষ্টে নিঃস্ব হয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। উগা-ার ইদি আমিনকে সৌদি আরবে ঝাড়ুদারের চাকরি করে জীবন নির্বাহ করতে হয়েছিল। অথচ তারেক রহমান লন্ডনে বিলাসী জীবনযাপন করছেন। বিলাসী জীবনযাপনের জন্য ব্যয় হওয়া অর্থ পাচার করা অর্থ বলে অভিযোগ উঠেছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড়ছেলে তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের সহযোগিতায় সিঙ্গাপুরে ২০ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার টাকা পাচার করেছেন। ইতোমধ্যেই পাচার করা অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকে ফেরত আনা হয়েছে। এছাড়া তারেক রহমানের বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যে ৬ কোটি ১ লাখ ৫৭ হাজার টাকা পাচার করার অভিযোগ রয়েছে। বিদেশে অবৈধভাবে অর্থপাচারের অভিযোগে তারেক রহমান ও গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের বিরুদ্ধে ঢাকার বিশেষ আদালতে তথ্য প্রমাণ দাখিল ও স্বাক্ষীদের জবানবন্দী ভিত্তিতে চার্জ গঠন হয়েছে। যদিও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা সময় আবেদন করেছেন। বিষয়টি বিচারাধীন। যদিও তারেক রহমান ও গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের অর্থপাচারের বিষয়টি বিদেশের আদালতে প্রমাণিত হয়েছে।
×