ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ তৌহিদুল ইসলাম

সাগরদাঁড়ির মধুপল্লী

প্রকাশিত: ০৩:৩২, ৮ জানুয়ারি ২০১৬

সাগরদাঁড়ির মধুপল্লী

মধুপল্লীর নাম শুনলেই মনে হতে পারে স্থানটি মধুর উৎপাদন অথবা বিক্রয় কেন্দ্র। কিন্তু যশোরের সাগরদাঁড়ির মধুপল্লী মৌচাক থেকে সংগৃহীত কোন মধু পাওয়ার জন্য খ্যাত নয়। বাংলা সাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক, মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতিবিজড়িত পৈত্রিক বাড়ি হিসেবে স্থানটি সকলের কাছে পরিচিত। বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি, ক্ষণজন্মা এই মহাপুরুষ প্রায় দু শ’ বছর ধরে তার জন্মস্থান সাগরদাঁড়ি গ্রামকে বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী সব মানুষের কাছে পরিচিত করেছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত আত্মীয় ও বন্ধুদের কাছে ‘মধু’ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। তার নামানুসারে এ গ্রামের তার পৈত্রিক বাড়িটিই এখন মধুপল্লী। তাই তো স্থানটি এক নজর দেখার জন্য দেশী-বিদেশী অসংখ্য পর্যটক, গবেষক ও সাধারণ দর্শনার্থী এখানে ভিড় জমায়। বিশেষ করে শীতকালে দর্শনার্থীদের ভিড় অনেক বেড়ে যায়। প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে মহাকবির জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে তার স্মরণে এখানে সরকারী-বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত সপ্তাহব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মধুমেলায় হাজারো মানুষের আগমন ঘটে। এ সময় স্থানটি দেশী-বিদেশী কবি-সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী, সাংবাদিকসহ হাজারো মধুপ্রেমিকের মিলনমেলায় পরিণত হয়। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের আওতাভুক্ত এ বাড়িটির আয়তন প্রায় সাড়ে চার একর। যশোর শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে এবং কেশবপুর উপজেলা শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত এ মধুপল্লীর পূর্ব ও পশ্চিম পাশে সরু ধারায় বয়ে গেছে কপোতাক্ষ নদ। মাইকেল মধুসূদন দত্তের পৈত্রিক বাড়িতে ৫টি পুরনো দালানে মোট ৩১টি কক্ষ রয়েছে। বাড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়ে কবির আবক্ষ মূর্তি। বাড়ির উঠানে জমিদার বাড়ির ঠাকুরঘর। এখানে একটি ছোট মিউজিয়ামে দর্শনার্থীদের পরিদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে কবির পারিবারিক কিছু আসবাবপত্র ও ব্যবহার্য জিনিসপত্র। এগুলোর মধ্যে রয়েছে কবির ব্যবহৃত একটি গ্রামোফোন, পাথরের বাটি, পরিবারের ব্যবহৃত লোহার সিন্দুক, স্টিলের বাক্স, অলঙ্কার খচিত কাঠের আলমারি, কাঠের খাট, কবির কিছু চিত্র, কিছু মুদ্রিত লেখার ফটোকপি ইত্যাদি। এ ক্যাম্পাসের মধ্যে রয়েছে ঘাট বাঁধানো একটি বড় ও একটি ছোট পুকুর। সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য কিছু ফলদ ও ঔষধি গাছ রোপণ করে তৈরি করা হয়েছে মধু উদ্যান। এখানে কালের সাক্ষী হয়ে আছে কবির বাবা জমিদার রাজনারায়ণ দত্তের আমলের কিছু আমগাছ। জেলা পরিষদ ডাক বাংলোর সামনেই রয়েছে কবির সমসাময়িক ও স্মৃতিবিজড়িত বাদাম গাছ। এর পেছনেই রয়েছে তার স্মৃতিময় বিদায়ঘাট, যেখানে মধুসূদন কলকাতা থেকে স্ত্রী হেনরিয়েটা, সন্তান মেঘনাদ মিল্টন দত্ত ও শর্মিষ্ঠাকে নিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। কিন্তু বাবা রাজনারায়ণ দত্ত তাকে মা জাহ্নবী দেবীর সঙ্গে দেখা করতে দেননি। জনশ্রুতি আছে তিনি মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এখানে চৌদ্দ দিন ধরে অবস্থান করেন। এ বাড়িতে একটি লাইব্রেরি আছে যেখানে মধুকবির রচনা সমগ্রসহ, বিভিন্ন ধরনের দেশী-বিদেশী পাঠ্যপুস্তক দর্শনার্থীদের পড়ার জন্য রাখা হয়েছে। এই বাড়িটি ঘিরে গড়ে উঠেছে স্কুল, কলেজ, পর্যটন মোটেল, পার্ক, মধুসূদন একাডেমিসহ বিভিন্ন ফুল ও ফলের গাছ। সেখানে শে^তপাথর দিয়ে লেখা আছে মাইকেল মধুসূদনের কবিতার পঙ্ক্তি ‘দাঁড়াও পথিকবর জন্ম যদি তব বঙ্গে তিষ্ঠ ক্ষণকাল।’ এ সবই পর্যটকদের আকর্ষণ করে। মহাকবির জন্মভিটার আঙ্গিনায় জানুয়ারি মাসে আয়োজিত মধু মেলায় কয়েক শ’ স্টল বসে। সেখানে কুটিরশিল্প, মৃৎশিল্প, বস্ত্রশিল্প, কারুপল্লীর কাঠের জিনিসপত্রসহ গ্রামীণ ও কৃষি পণ্যের সমাহারের পাশাপাশি লোকজ মেলার সব পণ্যই দেখা যায়। মেলার মাঠের পাশ দিয়ে বাংলার ঐতিহ্যবাহী যাত্রা, সার্কাস, পুতুল নাচ, যাদু প্রদর্শনী ইত্যাদি স্থান পায়। এছাড়া মেলার সময় এখানে প্রতিদিন বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নাটক মঞ্চস্থ করা হয়। এ সময় পর্যটকরা মধুসূদনের জন্মস্থান ও মেলা উভয়ই উপভোগ করতে পারেন। সে কারণে এ এলাকা মধুভক্তদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে। মহাকবির পৈত্রিক বাড়িটির অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কবির জন্মজয়ন্তীতে ১৯৯৭ সালে সাগরদাঁড়িকে একটি আধুনিক পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করার ঘোষণা দেন। সে সময় পুরনো দালানগুলোর সংস্কারসহ পিকনিক কর্নার, অতিথিশালা, কুঠিরের আদলে গেট, দুটি অভ্যর্থনা কেন্দ্র ও একটি মঞ্চ নির্মাণসহ মধুপল্লীতে আগত দর্শনার্থীদের চলাচলের সুবিধার জন্য পাথওয়ে নির্মাণ, গাড়ি পার্কিং সেড, কাস্টোডিয়ান কোয়ার্টার, কর্মচারী কোয়ার্টার এবং বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ করা হয়। ২০০১ সালে এলাকার তৎকালীন সংসদ সদস্য ও শিক্ষামন্ত্রী এ এস এইচ কে সাদেক মধুপল্লীর স্মৃতিফলক উন্মোচন করেন। তবে সে সময় সম্পূর্ণ নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করা সম্ভব হয়নি। পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য ২০১৬ সালকে পর্যটন বর্ষ হিসেবে উদযাপনের ঘোষণা করেছে সরকার। যে কোন দেশের পর্যটন শিল্পের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে প্রতœতত্ত্ব নিদর্শনসমূহের সংরক্ষণ ও আকর্ষণীয় প্রচারের মাধ্যমে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট করা। এদিক থেকে অনেক প্রতœতাত্ত্বিক স্থাপনার মতো মধুপল্লীও এ দেশের পর্যটন ও বিনোদনের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময়ী। এ নিদর্শনটি দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে। কবির পৈত্রিক বাড়ি ও স্মৃতি সংরক্ষণ এবং দর্শনার্থী ও পর্যটকগণকে বস্তুগত সুযোগ-সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে ‘মধুপল্লী’ স্থাপনের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করা অত্যন্ত জরুরী। পর্যটক ও দর্শনার্থীদের জন্য স্থানটি আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে সাগরদাঁড়িতে কপোতাক্ষ নদের ওপর ব্রিজ নির্মাণ, কপোতাক্ষের তীর পাথর দিয়ে বাঁধা, রাস্তাঘাট সংস্কার, মিনি চিড়িয়াখানা স্থাপনসহ আধুনিক পিকনিক স্পটের অবকাঠামো নির্মাণ করা যেতে পারে। সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তিগত ও বেসরকারী উদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসলে মধুপল্লীটি দেশী ও বিদেশী পর্যটকদের জন্য হয়ে উঠতে পারে অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্থান। লেখক : সিনিয়র তথ্য অফিসার, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়
×