ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

মনোয়ার হোসেন

উদ্দীপ্ত সংস্কৃতির বছর

প্রকাশিত: ০৭:৫০, ১ জানুয়ারি ২০১৬

উদ্দীপ্ত সংস্কৃতির বছর

সময়ের স্রোতধারায় বিদায় নিল আরেকটি বছর। উদ্ভাসিত হলো নববর্ষের নতুন সূর্যোদয়। এখন প্রশ্ন জাগে, কেমন কেটেছে রাজধানীবাসীর বিদায়ী বছর ২০১৫। ভাল-মন্দ অনেক ঘটনাই ঘটেছে যানজট ও জনজটের এই যান্ত্রিক শহরে। তবে সব নেতিবাচকতাকে ছাপিয়ে ইতিবাচক রূপ পেয়েছে ঢাকার সংস্কৃতি অঙ্গন। বছরজুড়েই সংস্কৃতির শাণিত শক্তি উজ্জীবিত রেখেছে এই নগরকে। শত বিড়ম্বনার মাঝেও নাগরিক মন খুঁজে নিয়েছে মননের প্রশান্তি। সংস্কৃতির স্বতঃস্ফূর্ততায় উগ্রবাদের বিরুদ্ধে প্রকাশিত হয়েছে প্রতিবাদী উচ্চারণ। বছরজুড়ে আর্ট গ্যালারিগুলোয় শোভা পেয়েছে চিত্রশিল্পীর আঁকা ছবি কিংবা ভাস্করের গড়া ভাস্কর্যসহ বহুমাত্রিক শিল্পকর্ম। মাঠে-ময়দানে অথবা মিলনায়তনে বসেছে সঙ্গীতাসর নয় তো আবৃত্তিসন্ধ্যা। শিল্পকলার নাট্যশালার মঞ্চগুলোয় অসংখ্য নাট্য প্রদর্শনীর পাশাপাশি অনুষ্ঠিত হয়েছে নাটককেন্দ্রিক বেশকিছু উৎসব। বিগত নবেম্বর মাসে সংস্কৃতিবান শহরবাসী যেন হয়ে উঠেছিল নিশাচর পাখি। সন্ধ্যা পেরিয়ে সারা রাত জেগে ভোর অবধি ভেসে বেরিয়েছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সুরসুধায়। পাঁচ রাত ধরে চলা উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবের সুর-তাল ও লয়ের খেলায় সমর্পিত হয়েছে হাজার হাজার সঙ্গীতানুরাগী। ধ্রুপদী সঙ্গীতের শুদ্ধতায় অবগাহনের জোয়ারে জেগে উঠেছিল শহুরে মানুষের মানবিক বোধ। ওস্তাদ জাকির হোসেনের তবলার তালে মুগ্ধতার ঘোর নিয়ে রাতজাগা অবসাদের বদলে আনন্দ নিয়ে ফিরেছে আপন গৃহে। প-িত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশির সুরে তোলপাড় হয়েছে হাজার মানুষের অন্তরাত্মা। উপমহাদেশের ওস্তাদ, প-িত, গুরু ও বিদুষীরা অনবদ্য সব পরিবেশনা শহরে ছড়িয়েছে স্নিগ্ধতার আমেজ। বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব ছাড়াও গোটা বছরে স্মরণীয় হয়ে ওঠা নবেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে তিনটি আন্তর্জাতিক সঙ্গীত উৎসব। দেশের লোকসঙ্গীতের নবজাগরণের পূর্বাভাস নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্ট। সুরের নেই কোন সীমারেখা- এমন বার্তা দিয়ে হয়েছে জ্যাজ এ্যান্ড ব্লুজ মিউজিক ফেস্টিভ্যাল। সঙ্গীতের তীর্থভূমিতে পরিণত হওয়া শহরে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে সাম্প্রদায়িক শক্তির উসকে দেয়া নিরাপত্তাজনিত শঙ্কা। দেশের শিল্পীদের সঙ্গে প্রাচ্য ও পশ্চিমা বিভিন্ন দেশের নামজাদা শিল্পীরা শঙ্কাহীন চিত্তে অংশ নিয়েছেন এসব সঙ্গীতাসরে। এ মাসেই বৈশ্বিক সাহিত্যের উদ্যাপনে অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকা লিট ফেস্ট। দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান সাহিত্যক-শিল্পী, শিল্প-সমালোচক, প্রকাশক, নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীসহ নানা ভুবনের বরেণ্য ব্যক্তিরা অংশ নিয়েছেন এ উৎসবে। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরেও রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্তে অনুষ্ঠিত হয়েছে নানা আনুষ্ঠানিকতা। বিজয় দিবস উদ্্যাপনে সঙ্গীতানুষ্ঠান, আবৃত্তিসন্ধ্যা, নাটকের মঞ্চায়ন, চিত্রকর্ম প্রদর্শনী, চলচ্চিত্র প্রদর্শনীসহ রকমারি অনুষ্ঠানমালায় উদ্দীপ্ত হয়েছে শহর। প্রতিটি পরিবেশনায় স্মরণ করা হয়েছে একাত্তরের শহীদদের। উচ্চারিত হয়েছে বীর বাঙালীর বিজয়গাথা। স্বাধীনতার মাস মার্চে খুলে দেয়া হয়েছে একাত্তরে সুখ স্মৃতিময় ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা জাদুঘর। বিদায়ী বছরে সংস্কৃতি ভুবনে নগরবাসীর অন্তর ও মননে দাগ কেটেছে তেমন কিছু বিশেষ আয়োজন নিয়ে সাজানো হয়েছে এ প্রতিবেদন। যাপিত জীবনে আনন্দের উল্টো পিঠেই বিচরণ করে বেদনা। সেই সূত্রে বছরটিতে আমরা হারিয়েছি ভাষাশহীদদের স্মারক শহীদ মিনারের রূপকার কিংবদন্তি ভাস্কর নভেরা আহমেদ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাদায়ী গানের গীতিকবি নয়ীম গহর, চিত্রশিল্পী আসমা কিবরিয়াস, পটচিত্রশিল্পী রঘু নাথহ বেশ ক’জন বরেণ্য ব্যক্তিত্বকে। প্রয়াত সেই বরেণ্যজনরাও স্মরিত হয়েছেন এ লেখায়। অবসাদের উজ্জীবন বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব ॥ এদেশের ধ্রুপদী সঙ্গীতের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারে চতুর্থবারের মতো অনুষ্ঠিত হয়েছে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব। ইতোমধ্যেই বিশ্ববাসী জেনে গেছে এ উৎসবের কথা। কারণ, শিল্পীর সংখ্যা ও বিপুুলসংখ্যক শ্রোতার অংশগ্রহণ এবং ব্যাপ্তির বিবেচনায় এটি পরিণত হয়েছে উপমহাদেশ তথা বিশ্বের সর্ববৃহৎ উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবে। আর্মি স্টেডিয়ামে পঞ্চরজনীর আসরটির সূচনা হয় ২৭ নবেম্বর। উচ্চাঙ্গের সুর-তাল ও লয়ের মাধুর্যে শ্রোতা-দর্শককে বিমোহিত করা সঙ্গীতাসরটি শেষ হয় পয়লা ডিসেম্বর। ৫০ ঘণ্টার এই সুরপরিভ্রমণটি নাগরিক জীবনের উজ্জীবন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। চতুর্থতম আসরে সর্বোচ্চ উদ্দীপনা ছড়িয়েছেন বিশ্ববরেণ্য তবলাবাদক ওস্তাদ জাকির হোসেন। প্রথমবারের মতো উৎসবে অংশ নিয়ে মাতিয়েছেন শ্রোতা-দর্শককে। ৩০ ডিসেম্বর মধ্যরাতে বেজে ওঠা তার তবলার বোলে উৎসব আঙিনা ভেসেছে আনন্দের প্লাবণে। সফেদ চুলের শিল্পীর দুই হাতের দশটি আঙুল যেন জাদুর কাঠির মতো ঘুরে বেড়ায় তবলার বুকে। মেঘের গর্জন থেকে শুরু করে বৃষ্টি ঝরিয়ে দেন তবলার তালে। এছাড়াও অলস ও চতুর দুই বন্ধুর কথোপকথন, ঝমাঝম ট্রেনের শব্দ, ঘোড়দৌড়ের শব্দ শোনান তবলার তালে তালে। কিংবদন্তি বাঁশরিয়া প-িত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশির সুরে শেষ হয় উৎসব। পয়লা ডিসেম্বরে শ্রোতারা বিভোর হয়ে শুনেছে তার বাঁশির সুর। ভোরের উষালগ্নে শেষ রাতে মঞ্চে আসেন শিল্পী। পাঞ্জাবির ওপর গলায় মালা জড়িয়ে চৌরাসিয়া শুরু করেন তার বাঁশির বাদন। সুরের মোহময়তায় নির্ঘুম শ্রোতার ক্লান্তি দূর করে অন্তরে বইয়ে দেন অপার্থিব আনন্দময়তা কিংবা মায়াবি বিহ্বলতা। বরেণ্য চিত্রশিল্পী কাইয়ূম চৌধুরীকে উৎসর্গকৃত উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবের তৃতীয় রাত ২৯ নবেম্বর বিশ্ববরেণ্য ধ্রুপদী শিল্পীদের পাশাপাশি আসর মাতিয়েছেন দেশের শিল্পীরাও। চতুর্থতম উৎসবে ওস্তাদ, প-িত, বিদুষী ও গুরুরা নানা পরিবেশনায় উজাড় করে উপস্থাপন করেছেন আপন শৈলী ও কারুকার্য। মোহাবিষ্ট কণ্ঠসঙ্গীতের সঙ্গে ঝঙ্কার তুলেছে সেতার, সরোদ, সন্তুর, বেহালা, মৃদঙ্গম ও বাঁশির মধুময় শব্দধ্বনি কিংবা উচ্চাঙ্গের অপরূপ নৃত্যশৈলী। উৎসবে অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশ ও ভারতের প্রায় ২০০ শিল্পী। লোকসঙ্গীতের নবজাগরণে ঢাকা ফোক ফেস্ট ॥ দেশের লোকসঙ্গীতের নবজাগরণের প্রত্যাশায় নবেম্বরে অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্ট। শেকড়সন্ধানী সুরের আবাহনে আর্মি স্টেডিয়ামে তিন রাত ধরে চলেছে এ উৎসব। ১২ নবেম্বর সূচনা হয়ে শেষ হয়েছে ১৪ নবেম্বর। সময়ের হিসেবে প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা করে ২৪ ঘণ্টার সঙ্গীতাসরটি এক আঙিনায় জড়ো করেছে ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষকে। লোকজ আঙ্গিকের কণ্ঠসঙ্গীতের সঙ্গে যন্ত্রসঙ্গীত ও লোকনৃত্যের উপস্থাপনা উৎসবকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। এতে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, চীন ও আয়ারল্যান্ডের লোকগানের খ্যাতিমান শিল্পী ও সাধকরা। মেরিল নিবেদিত উৎসবের যৌথ আয়োজক ছিল মাছরাঙা টেলিভিশন ও সান ইভেন্টস। এ উৎসব মাতিয়েছেন দেশবরেণ্য শিল্পী লালনসম্রাজ্ঞী ফরিদা পারভীন, নন্দিত লোকসঙ্গীত শিল্পী মমতাজ, পাকিস্তানের বিখ্যাত দুই শিল্পী আবিদা পারভীন ও সাঁই জহুর, ভারতের পাপন ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। কণ্ঠের মায়া আর বাণীর সম্মিলনে এদিনের উৎসব আঙিনায় সুরের মায়ায় বিরহের বীজ বুনে দেন বারী সিদ্দিকী। এছাড়া উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ছিলেন ভারতের জনপ্রিয় বাউলশিল্পী শিল্পী পবন দাস বাউল, এদেশের নিরীক্ষাধর্মী লোকগানের দল জলের গান, আইরিশ শিল্পী নিয়াভনি কারা ও তার দল এবং ভারতের জনপ্রিয় লোকসঙ্গীতশিল্পী পার্বতী বাউল। সাহিত্যের উদ্্যাপনে ঢাকা লিট ফেস্ট ॥ সাহিত্যের উদ্্যাপনে নবেম্বরে অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকা লিট ফেস্ট। সাহিত্য মানেই নিছক মনের খোরাক মেটানোর উপাদান নয়। ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্র ও সমাজের বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি নিয়েই এগিয়ে যায় সাহিত্যের গতিধারা। সেই বাস্তবতায় বিশ্বব্যাপী গজিয়ে ওঠা উগ্রবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী উচ্চারণে উচ্চকিত হয়েছে এই আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসব। সেই সঙ্গে দেশের সাহিত্যকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার প্রয়াসে ছিল নানা আয়োজন। ১৯ থেকে ২১ নবেম্বর পর্যন্ত তিন দিনের এ উৎসবের ভেন্যু ছিল বাংলা একাডেমি। ‘সারাবিশ্ব বাংলাদেশকে সাহিত্য সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে চিনুক’ প্রতিপাদ্যে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর ১৪ দেশের আড়াই শ’ লেখক-সাহিত্যিক-সাংবাদিক, ইতিহাসবিদ, প্রকাশক ও অভিনয়শিল্পীর অংশগ্রহণে উৎসব হয়েছি আলোকিত। এর মধ্যে ছিলেন ১৪ দেশের ৬০ আমন্ত্রিত সাহিত্যিক। সাহিত্যের অনুরাগী নোবেলজয়ী মার্কিন চিকিৎসাবিজ্ঞানী হ্যারল্ড ভারমাসের উপস্থিতি বাড়িয়েছে এই সাহিত্য আসরের মর্যাদা। সাহিত্যের এ উৎসবের দেশের খ্যাতিমান লেখকদের পাশাপাশি শামিল হয়েছেন নানা অঙ্গনের আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। তাদের মধ্যে ছিলেন ভারতে জনপ্রিয় নারীবাদী লেখক শোভা দে এবং একই দেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক নয়নতারা শেহগাল, ব্রিটিশ সাংবাদিক ও টেলিভিশন উপস্থাপক জন স্নো, কিউবান শীর্ষ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখক ইয়োস, কেনিয়ার শিশু সাহিত্যিক ও বক্তা মুথোনি গ্যরল্যান্ড, ফিলিস্তিনী কবিঘাসান জাকতা প্রমুখ। বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ জার্নাল ওয়াসাফিরিতে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সংখ্যার প্রকাশনা অনুষ্ঠিত হয় এ উৎসবে। এ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের লেখকদের লেখা। দেশের সাহিত্যিকদের বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার লক্ষ্যে ঢাকা ট্রান্সলেশন সেন্টারের ‘লাইব্রেরি অব বাংলাদেশ’ নামের গ্রন্থাগার উদ্বোধন হয়। এই ট্রান্সলেশন সেন্টার থেকে প্রকাশিত হয়েছে সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক ও সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের বইয়ের ইংরেজী অনুবাদ। এই ফেস্টের আয়োজন করে যাত্রিক। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় সহযোগী আয়োজক হয়েছে বাংলা একাডেমি। জ্যাজ এ্যান্ড ব্লুজ মিউজিক ফেস্টিভ্যাল ॥ সুরের ভুবনে হারিয়ে যায় প্রাচ্য ও পশ্চিমের সীমারেখা। সীমানাহীনতার সেই সুর ধরে রাজধানীতে অনুষ্ঠিত হয়েছে জ্যাজ এ্যান্ড ব্লুজ মিউজিক ফেস্টিভ্যাল। ৫ থেকে ৭ নবেম্বর পর্যন্ত বিজয় সরণির সামরিক জাদুঘর মাঠ উদ্দীপ্ত হয়েছে জ্যাজ ও ব্লুজ ঘরানার গান এবং যন্ত্রসঙ্গীতের সুর মূর্ছনায়। প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে মাঝরাত পর্যন্ত নানা স্বাদের গান শোনা শহুরে শ্রোতারা শামিল হয়েছেন এ উৎসবে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ভারত, ব্রাজিল ও বাংলাদেশের শিল্পীরা অংশ নিয়েছেন এ সঙ্গীত সম্মিলনে। সঙ্গীত আসরটির আয়োজন করে ব্লুজ কমিউনিকেশন্স। এ উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ছিল সত্তরের দশক থেকে বিশ্বব্যাপী জ্যাজ সঙ্গীতে শ্রোতাকে মোহাবিষ্ট করে রাখা ব্রিটিশ সঙ্গীতশিল্পী জন ম্যাকলাফলিন ও তার দল ফোর্থ ডাইমেনশন। ম্যাকলাফলিনের গিটারের সুরে শ্রোতারা খুঁজে নিয়েছেন প্রাণের স্পন্দন। গিটারের বাজনার সঙ্গে নিজের কণ্ঠে শোনান গান। এই সঙ্গীতাসরে শ্রোতাদের মান রাঙিয়েছে ভারতের শিল্পী বসুন্ধরা বিদ্যালুর, পিয়ানোনির্ভর যুক্তরাষ্ট্রের ব্যান্ডদল শাই মায়েস্ত্রে ট্রায়ো, ভারতের দার্জিলিংয়ের জনপ্রিয় জ্যাজ শিল্পী লুইস ব্যাঙ্কস, যুক্তরাষ্ট্রের স্বনামধন্য দল কিং বেবি, ফ্রান্সের জ্যাজ শিল্পী চায়না মোজেস, ব্রাজিলের গানের দল এসড্রাস নোগুয়েরা কোয়ার্টেট এবং বাংলাদেশের আইয়ুব বাচ্চু ও তার দল এবি ব্লুজ। আট দেশের শিল্পীর সম্মিলনে সুফি ফেস্ট ॥ তারা সবাই অধ্যাত্মবাদ বা ভক্তিমূলক গানের চর্চা করেন। সুফি গানে নিবেদিত এমন আট দেশের শিল্পীদের সম্মিলনে জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে তিন দিনের সুফি ফেস্ট ঢাকা ২০১৫। সরকারবিরোধী অবরোধের নামে সহিংসতার মাঝেও স্বস্তির সুবাতাস ছড়িয়েছে এই সঙ্গীতায়োজনটি। ২৭ থেকে ২৯ জানুয়ারির এ উৎসবে অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশের রব ফকির, শফি ম-ল, অর্ণবের পাশাপাশি ভারতের জাবেদ আলী, মনোয়ার মাসুম ও পাকিস্তানের রাহাত ফতেহ আলী খানের মতো বিখ্যাত শিল্পীরা। এছাড়া এ সঙ্গীতাসরে শামিল হয়েছে মিসর, ব্রাজিল, তিউনিসিয়া, ডেনমার্ক ও স্পেনের সুফিসাধক ও দল। একক গানের সঙ্গে ছিল আট দেশের ১৫ দল ও শিল্পীর পরিবেশনা। খুলে গেল স্বাধীনতা জাদুঘর ॥ স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন ২৫ মার্চ খুলে দেয়া হয় ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভূগর্ভস্থ স্বাধীনতা জাদুঘর। স্বাধীনতা স্তম্ভ ও স্বাধীনতা জাদুঘর মিলে একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সংশ্রয় লাভ করেছে ঢাকাবাসী। স্তম্ভ ও জাদুঘর বহন করছে একাত্তরের স্মৃতিগাথা। স্তম্ভের পাকা চাতালের চারপাশে রয়েছে কৃত্রিম জলাশয়। স্বাধীনতা সংগ্রামকে ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে একটি দেয়ালচিত্র। জাদুঘরের উপরিভাগে রয়েছে একটি আধুনিক মিলনায়তন। স্বাধীনতা স্তম্ভটি বস্তুত ১৫০ ফুট উচ্চ একটি গ্লাস টাওয়ার। এ টাওয়ারের পাদদেশে স্থাপিত আলোকরশ্মি বিচ্ছুরিত হয় ৫ কিলোমিটার উর্ধে অবধি। স্বাধীনতা জাদুঘরে প্রাচীনকাল থেকে বাঙালী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস আলোকচিত্রের মাধ্যমে ১৪৪ প্যানেলে উপস্থাপন করা হয়েছে। রয়েছে পাকিস্তান সেনাহিনীর ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণের টেবিলের অনুকৃতি। রাখা হয়েছে লাইট এ্যান্ড সাউন্ড শোর ব্যবস্থা। মৈত্রীর বন্ধনে গঙ্গা-যমুনা উৎসব ॥ ২০১৫ সালে নাট্যাঙ্গনের আলোচিত আয়োজন ছিল গঙ্গা-যমুনা নাট্য ও সাংস্কৃতিক উৎসব। বিচিত্র বিষয়ভিত্তিক বাংলাদেশ ও ভারতের ১৮ মঞ্চনাটক দিয়ে সাজানো হয় মৈত্রীর বন্ধনের উৎসবটি। ৪ থেকে ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল হল ও এক্সমেপরিন্টাল থিয়েটার হলে মঞ্চস্থ নাটকগুলো মাতিয়েছে নাট্যপ্রেমীদের। বিদায়ী বরেণ্য ব্যক্তিত্বরা ॥ আনন্দের উল্টো পথে চলা বেদনার নিয়তিতে বছরটিতে চিরবিদায় নিয়েছেন ভাষাসঙ্গীতদের স্মৃতিভূমি শহীদ মিনারের রূপকার ভাস্কর নভেরা আহমেদ, একুশে পদকজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাতা চাষী নজরুল, চিত্রশিল্পী আসমা কিবরিয়া, কণ্ঠশিল্পী ফরিদা ইয়াসমিন, কবি ওমর আলী, পটচিত্রশিল্পী রঘু নাথসহ এদেশের শিল্পী ও সংস্কৃতিতে নিবেদিত করা বেশ কয়েকজন বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। এই গুণীজনদের কর্মগুণ এদেশের ইতিহাসে রেখে গেছে তাদের মননের অনুভব। বাংলাদেশের নাগরিক না হয়েও এদেশকে ভালবেসেছিলেন গীতিকবি গোবিন্দ হালদার। একাত্তরে মুক্তিসংগ্রামের খরস্রোতা সময়ে তিনি লিখেছিলেন ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল রক্ত লাল’, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা’র মতো কালজয়ী গান। ১৭ জানুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় মেয়ের বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন এদেশের পরম সুহৃদ এই গীতিকার। এছাড়াও ২০১৫ সালে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন কবি ওমর আলী, ভাষাসংগ্রামী তোফাজ্জল হোসেন ও পটচিত্র শিল্পী রঘুনাথ। অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকে ফেরার পথে নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন মুক্তমনা বিজ্ঞান লেখক ও ব্লগার অভিজিত রায়। একইভাবে মৌলবাদী জঙ্গীদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন সৃজনশীল ও মুক্তচিন্তার সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্নবান তরুণ প্রকাশক আরেফিন দীপন।
×