ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হেমন্তের বৈশিষ্ট্য

অনুভূতিপ্রবণ অভিমানী নিজেকে গোপন রাখে, হৃদয় সুন্দর বিশাল

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২০ অক্টোবর ২০১৫

অনুভূতিপ্রবণ অভিমানী নিজেকে গোপন রাখে, হৃদয় সুন্দর বিশাল

সমুদ্র হক ॥ ভোরের তেরচা রোদ কুয়াশার আঁচল চিরে জলের যে জায়গাটায় ঝিলিক তুলেছে সেখানে এক জোড়া হাঁস সদ্য ¯œান সমাপনে হেমন্তের সুপ্রভাত জানিয়ে দিচ্ছে। এই হেমেন্তই সোনালী ধানের ম ম গন্ধে ভরে ওঠে কৃষকের মন। নবান্নের ঢাকের বাদ্যি বেজে এই উঠল বলে। বাংলার ঋতুর নিসর্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ যে কত বৈচিত্র্যের সুর বেঁধেছেন...। হেমন্তকে লক্ষ্মীর উপমায় টেনে লিখেছেন ‘হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা...’। হেমন্তের শেষ বিকেলের সোনালী আলোয় কোন ললনা চোখ বুজে কবিগুরুর কথাকেই ধ্রুপদীর সুরে আপন হৃদয়ে গেঁথে নিয়ে গেয়ে ওঠে ‘মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতালো দোলে মন দোলে অকারণ হরষে...তাহারে দেখি না যে দেখি না, শুধু মনে মনে ক্ষণে ক্ষণে ওই শোনা যায়...’। এমন সুরে মাধুর্যেই অপরূপ হয়ে ওঠে হেমন্ত। বাংলার ঋতুচক্রে হেমন্ত চতুর্থ। বিশ্বের কোথাও এই ঋতু নেই। হেমন্তের বৈশিষ্ট্য- খুবই অনুভূতিপ্রবণ ও অভিমানী। নিজেকে গোপন রাখে। তবে এর হৃদয়টি সুন্দর ও বিশাল। তাই কষ্টও বেশি। ¯িœগ্ধতার শরতের পর তার আগমন। যখন প্রকৃতির শারদীয় পালা শেষ হয় না। আকাশে সাদা মেঘের ভেলা সরিয়ে হালকা কুয়াশার প্রলেপ দিতেই শরত সুরের রাগিনী ধ্রুপদ লয়ে মিটি মিটি হেসে এগিয়ে যায়। ধরণীকুলকে দ্বন্দ্বের মধ্যে ফেলে, এ শরত না হেমন্ত। অভিমানে হেমন্ত কখনও রেগে ধূলি উড়িয়ে কখনও লুকিয়ে কেঁদে বৃষ্টি ঝরিয়ে দিনপঞ্জি দেখতে বলে। ওদিকে শিশির ঝরিয়ে শীতও একটু এগিয়ে আসতে চায়। হেমন্তের আঙিনায় শরতের খানিকটা বেদখল আর সীমানা অতিক্রম করে শীতের অনুপ্রবেশে অনেকটাই আকুল হয়ে পড়ে। তারপরও ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরির খেলায় ত্রিতালে নেচে উঠে হেমন্ত উচ্ছ্বাসে মাতিয়ে দেয় ভুবন। হেমন্তই প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়ে অন্ন যোগায়। কৃষকের উঠান ভরে ওঠে। হাঁড়িতে চড়ে নতুন চালের ভাত, ফিরনি পায়েস। এনে দেয় নবান্ন। উৎসবের ঢেউ আছড়ে পড়ে। বঙ্গীয় ব দ্বীপের নবান্নের এই দেশে ঘুঘু ডাকা ছায়ায় ঢাকা মায়াভরা গ্রামে মিলন তিথির ভরা চাঁদ ওঠে পশ্চিমের মধ্য গগনে। এমনই নিসর্গের রাতে আঙিনায় বসে কৃষাণ-কৃষাণী অপার মধুময়তা। তার আগে হেমন্ত সন্ধ্যায় গাঁয়ের বধূ ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসা কৃষককে পিঁড়িতে বসতে দিয়ে আদরের পরশ বুলিয়ে দেয়। হেমন্তের সকাল ও গোধূলি বেলা বিছিয়ে দেয় কুয়াশার পাতলা চাদর। এ সময় বয় মৃদু-মন্দ শীতল হাওয়া। কুয়াশাও তো মেঘ, নিচে নেমে আসে। কয়েক দিন আগের ভ্যাবসা গরম আর বিরামহীন বারিধারা ভুলে যায় মানুষ। যেন স্বস্তির পরশ এনে দেয় হেমন্ত। এ সময়টায় গ্রামের পথে পা বাড়ালে চোখে পড়বে চারিদিকে আমন ধানের সবুজের প্রান্তর। ক্ষেতের ভেতরে কৃষক বসে উপরি ঘাস তুলে পরিচর্যা করছে। দিনমান কাজ সেরে আকাশ পানে চেয়ে ধারণা করে কেমন থাকবে আবহাওয়া! অকারণে বিপর্যয় নেমে আসবে না তো! এখন তো কিছুই বলা যায় না। জলবায়ুর পরিবর্তনের পালা শুরু হয়েছে বিশ্বময়। ঋতুর সময় ঠিক থাকছে না। এই রোদ তো এই বৃষ্টি। সকল ঋতুই এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। শরতের কাশবন কখনও হেমন্তও অতিক্রম করে। এখনও গোধূলি বেলার হলদেটে আলোয় কাশবনে শ্বেতশুভ্র পালক হাতে নিয়ে মেতে ওঠে কোন রমণী। পৌরাণিক আখ্যানে বর্ষায় নদী তীরে কৃষ্ণের বাঁশির সুরে তন্ময় হয়ে রাধা ছুটে গিয়েছিল নীপবনে। ‘এসো নীপবনে ছায়াবীথি তরে এসো করো ¯œান নবধারা জলে...’ বর্ষার এমন সুরের ঝর্ণাধারা প্রকৃতিতে পাল্টে গিয়ে হেমন্তে কৃষ্ণের বাশির সুরে রাধা কাশবনে গিয়ে নেচে উঠলেও বুঝি অবাক হওয়ার কিছু নেই। এমনই ভাবে প্রকৃতির পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। হেমন্তে নদীর শান্তরূপ আরেক নিসর্গ। বর্ষায় যে ঢেউ উথাল পাথাল হয়ে তীরে ধাক্কা দিয়ে কখনও ভেঙ্গেও দেয় সেই নদী কত শান্ত তবে সুপ্ত নয়। বয়ে চলে নিরবধি...সেই ঢেউয়ে রাতে চাঁদের প্রতিলিপি ছন্দের দোলায় ধরা দেয়। এ সময়ে পদ্মা পাড়ে গেলে সুর ভেসে আসে ‘পদ্মার ঢেউ রে মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা যা রে...’। ঋতু পরিবর্তনের ধারায় এমনই হেমন্ত এসেছে। কবিগুরুর কথায় ‘হায় হেমন্তলক্ষ্মী তোমার নয়ন কেন ঢাকা- হিমের ধন ঘোমটাখানি ধূমল রঙে আঁকা/সন্ধ্যাপ্রদীপ তোমার হাতে মলিন হেরি কুয়াশাতে, কণ্ঠে তোমার বাণী যেন করুণ বাষ্পে মাখা...আপন দানের আড়ালেতে রইলে কেন আসন পেতে আপনাকে এই কেমন তোমার গোপন করে রাখা...’। এমন হেমন্তেই শুভ সকাল আর শুভ সন্ধ্যা জানায় প্রকৃতি...।
×