ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মানব প্রেমের নবতর বয়ান মহাকালের ‘নীলাখ্যান’

প্রকাশিত: ০৬:১১, ১৭ আগস্ট ২০১৫

মানব প্রেমের নবতর বয়ান মহাকালের ‘নীলাখ্যান’

সাজু আহমেদ ॥ ঢাকার মঞ্চে নতুন নাটক এলে তা দেখার জন্য অনেকটাই হুমড়ি খেয়ে পড়েন দর্শকরা। বিশেষ করে প্রথম সারির কোন নাট্যদল যদি নতুন নাটক মঞ্চে আনে তাহলে তো কথাই নেই। এমন ঘটনাই দেখা গেল সম্প্রতি জাতীয় নাট্যশালার এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে। ১৪ আগস্ট মঞ্চে এসেছে মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়ের নাটক ৩৬তম প্রযোজনা নতুন নাটক ‘নীলাখ্যান’। নাটক দেখার জন্য প্রথম প্রদর্শনীতে দর্শকের উপচেপড়া ভিড় ছিল লক্ষ্যণীয়। এদিন নাটকের টিকেট না পেয়ে অনেককেই ফিরে যেতে দেখা গেছে। আঙ্গিক নির্মাণে নতুনত্ব, সমৃদ্ধ সঙ্গীত এবং শিল্পীদের নান্দনিক ও পরিশ্রমী অভিনয়শৈলীর কারণে নাটকটি দেখে অনেকটাই মুগ্ধ দর্শকরা। আকর্ষণীয় সেট, মনোমুগ্ধকর আলোক প্রক্ষেপণ সব মিলে শিল্পমানসমৃদ্ধ প্রযোজনার গুণে নাটক শেষে দর্শকদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় সিক্ত হলেন নাটকের নির্দেশক ও কলা কুশলীরা। শুধু সাধারণ দর্শকরাই নয় প্রথম প্রদর্শনীতেই নাটকটির আঙ্গিক তথা প্রযোজনাশৈলী নাট্যজনদেরও প্রশংসা কুড়িয়েছে। নাটকটি দেখার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার এ্যান্ড পারফর্মেন্স স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ জামিল আহমেদ বলেন, মহাকালের নতুন এ প্রযোজনাটি প্রশংসা পাওয়ার দাবি রাখে। তবে কিছু কারেকশন করলে এটি একটি ভাল প্রযোজনা হতে পারে। নিঃসন্দেহে এটি দলের অন্যতম একটি প্রযোজনা। নাট্যব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, যে কোন দলের জন্য নতুন প্রযোজনা মঞ্চে আসা মানে একটি আনন্দের বিষয়। সে হিসেবে মহাকাল নতুন নাটক মঞ্চে এনেছে এটা অবশ্যই আনন্দের। তবে নতুন নাটকের প্রথম প্রদর্শনীতে অনেক ভুল-ত্রুটি থাকে। সেদিক থেকে নাটকটি প্রথম প্রদর্শনীতেই মুগ্ধ করতে পেরেছে। তবে এ নাটকের অভিনয়শিল্পীদের চর্চা ‘নীলাখ্যান’ নাটককে আরও সমৃদ্ধ করবে। আমার প্রত্যাশা সামনের প্রদর্শনীগুলো আরও বেশি প্রশংসিত হবে। অহি চৌধুরী নামের এক চাকরিজীবী বললেন, এমনিতেই আমার মঞ্চ নাটক ভাল লাগে। শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় নতুন নাটক দেখার প্রতীক্ষায় থাকি। আজ এ সুযোগে নাটকটি দেখলাম। নাটকটি দেখে আমার মন ভরে গেছে। খুব ভাল লেগেছে নাটকটি। সবার অভিনয় আমার ভাল লেগেছে। তবে নাটকটি দেখে নাট্যকর্মী মিশুক বললেন মহাকালের নতুন এ প্রযোজনাটি ভাল হয়েছে। তবে কাহিনীর উপস্থাপনা এবং স্থান কালভেদে নাটকটির পোশাকটি আমার কাছে কেমন যেন একটু অসঙ্গতি মনে হয়েছে। তবে মোটের ওপর ভাল একটি প্রডাকশন এটি জানালেন তিনি। মানব প্রেমের অমর উপাখ্যান ‘নীলাখ্যান’ নাটকের কাহিনীতে দেখা যায় বেদিয়ার সর্দার জহরের বিষ জয় সাধনায় মনসা দ্বারা কাম নিষিদ্ধের আভাসে প্রত্যাখ্যাত ভালবাসার মানুষ বিন্তী রানী আড়ালি বিলে রাশি রাশি সাদা শাপলার বনে আত্মহত্যা করে। বেদিয়া বহরে বেড়ে ওঠা সাপে কাটা মান্দাস ভাসা বালিকা চন্দনের চুলের আড়ে বিন্তীর সুরভী পায় জহর। নারী নিষিদ্ধ বলে এ বালিকা বেড়ে ওঠে বালকের বেশে। যাকে সন্তান জ্ঞান করেছিল ঋতুমতি হয়ে ওঠার পর তার প্রতি প্রবল রতি অনুভব করে জহর। বেদিয়া দলে তাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয় বিচিত্রমুখী সঙ্কট। চন্দনের যুবা সাজে তাকে প্রেম নিবেদন করে মৌটুসী আর চন্দন ঠোঁটে মালতী ফুলের লাল ডলে ঝুমরোর সামনে দাঁড়ায়। বেদিয়াদের উৎসবে চন্দনের নারিত্ব উন্মোচন হলে দলের অতিপ্রাকৃত বৃদ্ধ ঘণ্টাবুড়ো বেদিয়া দল ও জহরকে তিনটি অনিবার্য ভবিতব্যের ঘোষণা দেয় ‘ভবিতব্যের তিনরূপ কহি যে ভাতের পাতিল নেবার জন্য জলে ডুবেছে বিন্তী- তা অন্যরে দিতে চেয়ে পতিত হবি তুই। অথবা তোর আচরে বিন্তীর অনুগামী হবে চন্দনে। আর যদি না হয় তা-তবে আছে তৃতীয়জন তার হবে মৃত্যু। মৃত্যু অনিবার্য তবে তা কার হবে তোর কার্যকরণ হবে স্থির। সামগ্রিক দৃশ্যকাব্যে ক্ষণে ক্ষণে তিনটি ভবিতব্য ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল হয়ে ওঠে। যাকে পিতা মানে তাকে পতি মেনে নিতে পারে না চন্দন। চন্দন ভালবাসের ঝুমরোকে। তবে ঝুমরোর জন্য জহরের ঝাঁপিতে আছে দাঁত না ভাঙা পোষা সাপ। শাওনের অখ- চাঁদের সাঁঝ বেলায় আকাশজুড়ে যেন মনসার নীল মুখচ্ছবি ভেসে ওঠে। জহরের অন্তরে তখন বাজে চন্দন। যাকে পরাতে চেয়েছিল গাঢ় নীল রঙের ফতুয়া। সে ক্ষণে একশতম সাপের দংশন নেবে জহর মন্ময় নীলের দোলাচলে সে চিত্রল ফণায় টোকা দিয়ে সাপটিকে ক্রোধমত্ত করে তোলে। এক সময় দংশন করে ঝুমরোকে। তবে ঝুমরোর প্রতি চন্দনের ভালবাসা দেখে বিষ চুষে নেয় জহর। এক সময় নিজেই দংশন নেয় জহর। ভালবাসার জন্য আত্মত্যাগ করে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘সাপুড়ে’ গল্প অবলম্বনে ‘নীলাখ্যান’ নাটকটি রচনা করেছেন অধ্যাপক আনন জামান। নির্দেশনা দিয়েছেন ড. ইউসুফ হাসান অর্ক। অভিনয় করছেন পলি বিশ্বাস, মনামী ইসলাম কনক, লিঠু ম ল, জেরিন তাসনীম এশা, কোনাল আলী, চৈতী সাথী, তনু ঘোষ, আমিনুল আশরাফ, আসাদুজ্জামান রাফিন, মোহাম্মদ আহাদ, শিবলী সরকার, শাহরিয়ার হোসেন পলিন, ইয়াছির আরাফাত, তৌহিদুল রহমান শিশির, ইকবাল চৌধুরী, জাহিদুল কামাল চৌধুরী দিপু, মোঃ শাহনেওয়াজ ও মীর জাহিদ হাসান। নাটকের মঞ্চ, সুর সংযোজন ও আবহসঙ্গীত পরিকল্পনায় ইউসুফ হাসান অর্ক, আলোক পরিকল্পনায় ঠা ু রায়হান, পোশাক পরিকল্পনায় ড. সোমা মমতাজ, কোরিওগ্রাফি জেরিন তাসনিম এশা, প্রপস পরিকল্পনা ও নির্মাণ হাসনাত রিপন, রূপসজ্জা শিল্পী শুভাশীষ দত্ত তন্ময়, পোস্টার ও স্মরণিকা ডিজাইন পংকজ নিনাদ, মঞ্চ ব্যবস্থাপক জাহিদ কামাল চৌধুরী এবং প্রযোজনা অধিকর্তা মীর জাহিদ হাসান।
×