ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সাতক্ষীরায় ১৭ বছরেও প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়িত হয়নি

সাড়ে ১২শ’ ভূমিহীন উচ্ছেদ আতঙ্কে

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ৪ মে ২০১৫

সাড়ে ১২শ’ ভূমিহীন উচ্ছেদ আতঙ্কে

মিজানুর রহমান, সাতক্ষীরা ॥ জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে খাসজমিতে বসবাসরত ভূমিহীনদের মাঝে স্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়ার প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ১৭ বছরেও বাস্তবায়ন করেনি স্থানীয় প্রশাসন। এই জমিতে বসবাসরত ভূমিহীনদের উচ্ছেদ মামলায় একজন সরকারী আইনজীবীকে জমির রিসিভার নিয়োগ দেয়ার পর এই জমি দখল প্রক্রিয়া নিয়ে এখন ভূমিহীনদের মাঝে উচ্ছেদ আতঙ্ক বিরাজ করছে। আজ সোমবার এই উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে এমন আশঙ্কায় ভূমিহীনদের মাঝে উত্তেজনা এখন চরমে। জমি রক্ষায় ভূমিহীনরা গঠন করেছে উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। এদিকে দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া ইউনিয়নের নোড়া চারকুনি আবাদে প্রায় সাড়ে ৬শ’ একর সরকারী খাস জমিতে বসবাসরত সাড়ে ১২শ’ ভূমিহীন পরিবার উচ্ছেদ প্রক্রিয়া বন্ধ রাখার দাবিতে জেলা ভূমিহীন সমিতির পক্ষ থেকে রবিবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে জরুরী ফ্যাক্স বার্তায় আবেদন জানানো হয়েছে। আবেদনে এই খাসজমির রিসিভার বাতিল, জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে বসবাসরত ভূমিহীনদের মাঝে খাসজমি স্থায়ী বন্দোবস্ত প্রদান, হাইকোর্টের আদেশ বাস্তবায়নসহ ’৯৮ সালে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নের দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন এলাকায় বসবাসরত ভূমিহীন নারী-পুরুষ। খাস জমির অধিকার নিয়ে ’৯৮ সালে সাতক্ষীরার দেবহাটা কালিগঞ্জে গড়ে ওঠে ভূমিহীনদের আন্দোলন। সে সময় প্রশাসন ও ভূমিদস্যুদের নির্যাতনে ও পুলিশের গুলিতে ভূমিহীন জায়েদা নিহত হওয়ার পর উত্তাল হয়ে ওঠে সাতক্ষীরা। খাস জমি পাওয়ার এই অধিকারের প্রতি দেশজুড়ে সমর্থন মেলে। ভূমিহীনদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে সে সময়ে বিরোধী দলসহ সকল রাজনৈতিক দলের প্রধানরা সাতক্ষীরায় এসে জনসভা করে ভূমিহীনদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। উত্তাল সাতক্ষীরাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাতক্ষীরার কালিগঞ্জে এসে জনসভায় খাস জমিতে বসবাসরত সকল ভূমিহীনদের জমি প্রদানের ঘোষণা দেন। এছাড়া চিংড়িঘের হিসেবে ব্যবহৃত খাস জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে কৃষি খাস জমিতে রূপান্তরিত করে স্থানীয় ভূমিহীনদের মাঝে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রদানের ঘোষণা দেন। এই জমি দখল নিয়ে ১৯৯৮ সালের ১০ মে দেবহাটা-কালিগঞ্জের ভূমিহীন জনপদে প্রথম হামলা করে ভূমিদস্যুরা। ২৭ জুলাই দ্বিতীয় দফায় প্রশাসনের সহযোগিতায় হামলা ও গুলি হলে ভূমিহীন নেত্রী জায়েদা নিহত হন। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরদাশ, রাশেদ খান মেননসহ বিভিন্ন দলের শীর্ষ নেতারা সাতক্ষীরার ভূমিহীন জনপদে এসে ভূমিহীনদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। আন্দোলনের উত্তাপ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার এক পর্যায় ১৯৯৮ সালের ১৮ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেবহাটার দেবিশহর ফুটবল মাঠে জনসভায় জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে (বিশেষ জলমহলকে কৃষি খাস জমিতে রূপান্তরিত করে) স্থানীয় ভূমিহীনদের মাঝে স্থায়ী বন্দোবস্ত প্রদানসহ সকল দাবি বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন। ভূমিহীনরা জানায়, ’৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া প্রতিশ্রুতি দেবহাটা ও কালিগঞ্জের ৯টি গ্রামে বাস্তবায়ন হলেও অজ্ঞাত কারণে দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া ইউনিয়নের নোড়া চারকুনি এলাকার জমি ভূমিহীনদের মধ্যে বন্দোবস্ত দেয়া হয়নি। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ও ঘোষণা বাস্তবায়নে স্থানীয় প্রশাসনের দীর্ঘসূত্রতার কারণে ভূমিদস্যুরা ফের ভূমিহীনদের উচ্ছেদে সক্রিয় হয়ে ওঠে। গত ২৩ নবেম্বর দেবহাটার কোড়া গ্রামের জনৈক আব্দুল মান্নান ও পূর্ব নলতা গ্রামের গাজী আনসার আলী নোড়া চারকুনির ৬৪৮.৭২ একর সরকারী খাস জমি থেকে ভূমিহীনদের উচ্ছেদ করে রিসিভার নিয়োগ দেয়ার জন্য সাতক্ষীরা যুগ্ম জেলা জজ (দ্বিতীয়) আদালতে মামলা দায়ের করে। ২৪ নবেম্বর সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারক জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য এ্যাডভোকেট গাজী লুৎফর রহমান উক্ত জমির রিসিভার নিয়োগ করেন এবং ওই জমি থেকে বেআইনী দখলকারীদের উচ্ছেদের জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেন। আদালতের এ আদেশের পর সেখানে বসবাসরত সাড়ে ১২শ’ ভূমিহীন পরিবারের মধ্যে উচ্ছেদ আতঙ্ক বিরাজ করছে। এদিকে, জেলা যুগ্ম জজ আদালতের এই আদেশের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরা জেলা জজ আদালত এবং হাইকোর্টে পৃথক দুটি রিভিশন মামলা দায়ের করা হয়েছে ভূমিহীনদের পক্ষে। এই মামলাগুলো বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে। অপরদিকে, গত ১৫ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা জেলা জজ আদালতের সরকারী কৌঁসলী এ্যাডভোকেট গাজী লুৎফর রহমানের অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ করেছে জেলা ভূমিহীন সমিতি। দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। সাতক্ষীরা যুগ্ম জেলা জজ আদালত সম্প্রতি ওই খাস জমিতে সাতক্ষীরা জজ আদালতের সরকারী কৌঁসুলীকে (জিপি) রিসিভার নিয়োগ করে তাকে জমি বুঝে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় ভূমিহীন জনপদ আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। বসবাসরত ভূমিহীনদের উচ্ছেদ করতে গেলেই সেখানে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা করছে এলাকাবাসী। ভূমিহীন সমিতির নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
×