ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন ও অর্জন ম্লান করতে এ দুই সংগঠনে ঢুকে পড়েছে কিছু সুযোগসন্ধানী ;###;এসব দুর্বৃত্ত দমন করার এখনই সময় নেতৃত্বের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই এ দুই সংগঠনে

লাগামহীন ছাত্রলীগ যুবলীগ! ॥ নেপথ্যে কারা-

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ২০ এপ্রিল ২০১৫

লাগামহীন ছাত্রলীগ যুবলীগ! ॥ নেপথ্যে কারা-

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ ফের ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের ভূমিকায় ছাত্রলীগ-যুবলীগ! শাসক দলের এ দুটি সংগঠন সরকারের সকল অর্জন ধ্বংস করার মিশনে নামলেও নিয়ন্ত্রণ করার কেউ নেই। বিএনপি-জামায়াত জোটের গত তিন মাসের ভয়াল নাশকতা-সন্ত্রাস শক্তহাতে নিয়ন্ত্রণ করে আওয়ামী লীগের নেতারা যখন নির্ভার, ফুরফুরে মেজাজে। বিএনপি-জামায়াত জোটকে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত এবং শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে দেশকে মুক্ত করে যখন তিন সিটি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী করতে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক নেতারা ব্যতিব্যস্ত, ঠিক তখনই অদৃশ্য হাতের ইশারায় ফের বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ছাত্রলীগ-যুবলীগ। শুধু সরকারের অর্জনকেই ম্লান নয়, সিটি নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটের হাতিয়ার হিসেবেই যেন মাঠে নেমেছে সংগঠন দুটি। গত এক সপ্তাহে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আর খুনোখুনির ঘটনায় সরকারকে অনেকটাই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে। দলটির সব পর্যায়ের নেতাদের মুখে এখন একই প্রশ্ন- আদর্শহীন ছাত্রলীগ-যুবলীগ নামধারী এরা কারা? কারোর পরোয়া নেই। কারও নিয়ন্ত্রণই যেন মানছে না ছাত্রলীগ-যুবলীগের ব্যানারে অনুপ্রবেশকারী সুযোগ সন্ধানীরা। ছাত্রলীগ কিংবা যুবলীগ নামধারী এসব দুর্বৃত্তদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় যেন নিয়মে পরিণত হতে চলেছে। প্রান্ত থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সবখানেই ছাত্রলীগ ও যুবলীগে একই চিত্র। যুবলীগ অতটা না হলেও ছাত্রলীগের ব্যানারে অনুপ্রবেশকারীদের বেপরোয়া, লাগামহীন সন্ত্রাস ক্রমেই সর্বব্যাপী হয়ে উঠছে। হঠাৎ করেই সংগঠন দু’টির বিতর্কিত কর্মকা-ের পর সর্বত্রই বলাবলি হচ্ছে- সরকারের সব অর্জন গ্রাসকারী ছাত্রলীগ-যুবলীগ নামধারী দুর্বৃত্তদের শক্তহাতে নিয়ন্ত্রণ কবে হবে? ছাত্র নামধারী দুর্বৃত্তদের শুধু দমন নয়, সারাদেশে আধিপত্য, প্রভাবপ্রতিপত্তি বজায় রাখতে ছাত্রলীগ-যুবলীগকে ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহারকারী মন্ত্রী-নেতা-এমপি বা নেপথ্যের নায়কদেরও চিহ্নিত করা হোক। ছাত্রলীগের কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত মেয়াদোত্তীর্ণ সকল কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে মেধাবী ছাত্রদের হাতে তুলে দেয়া হোক ঐতিহ্যবাহী এ ছাত্র সংগঠনটির নেতৃত্ব। অন্যথায় আওয়ামী লীগের সব অর্জনই ব্যর্থ হতে বাধ্য। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসার পরে হঠাৎ করেই কেন ছাত্রলীগ-যুবলীগ নামধারী দুর্বৃত্তরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, এ নিয়ে চিন্তার বলিরেখা ফুটে উঠেছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের। বিশেষ করে তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এসব ঘটনার কোন প্রভাব পড়ে কি না, তা নিয়ে দলটির উচ্চ পর্যায়ের দুশ্চিন্তাও ফুটে উঠেছে। ইতোপূর্বে অনুষ্ঠিত চার সিটি নির্বাচনের সময়ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের ভ্রাতৃঘাতী সন্ত্রাসী কর্মকা- আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের পরাজয়ে অনেকটাই ভূমিকা রেখেছিল। এখন তিন সিটি নির্বাচনের সময় হঠাৎ করেই সরকার দলের প্রার্থীদের বিজয় নস্যাত এবং সরকারের বিশাল অর্জনগুলো ধ্বংস করতে ছাত্রলীগ-যুবলীগ নামধারীদের দেশের বিভিন্নস্থানে সন্ত্রাসী কর্মকা- ও খুনোখুনিতে লিপ্ত হয়েছে। এসব ঘটনায় বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হাত কিংবা সরকারকে পরিকল্পিতভাবে হেয় করতেই ঘটানো হচ্ছে কি না, তা ইতোমধ্যে খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে দলটির উচ্চ পর্যায়ের নেতারা। গত কয়েক দিনে হঠাৎ করেই হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, বুয়েট, রংপুর মেডিক্যাল কলেজ, কুমিল্লাসহ বিভিন্নস্থানে গোলাগুলি, গুলিবিদ্ধ হয়ে তিন ছাত্রের মৃত্যু, সংঘাত-সংঘর্ষ, শিক্ষকদের ওপর চড়াও, যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগের তীর খোদ সরকারী দলের ভাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ ও সহযোগী সংগঠন যুবলীগের দিকে। রাজধানীর চৌধুরীপাড়ায় ঝিলের মধ্যে দোতলা টিনশেড ঘর নির্মাণ করে ভাড়া দেয়া এবং ওই টিনশেড বাড়ি দেবে গিয়ে ১২ জনের প্রাণহানির ঘটনার সঙ্গেও ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের এক নেতার সংশ্লিষ্টতাও প্রকাশ পেয়েছে। সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব ঘটনায় সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোটের গত মাসের হরতাল-অবরোধের মতো একটা ভয়াল ও শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে দক্ষভাবে দেশকে মুক্ত করার ঘটনায় দেশের জনগণের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নেতারাও নির্ভার ও স্বস্তির মেজাজে ছিলেন। দ্বিতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগের কৌশলী রাজনীতির কাছে আন্দোলনে ব্যর্থ ও পরাজিত হয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট যখনই অনেকটাই অস্তিত্বের সঙ্কটে। তাঁদের মতে, রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সিটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে রাজপথে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে বিএনপি-জামায়াত জোট। তিন সিটি নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের পেট্রোলবোমা, ভয়াল নাশকতা আর মানুষকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে হত্যার বীভৎসতা নগরবাসীর সামনে তুলে ধরে তাদের ঘায়েল করতে আওয়ামী লীগ নেতারা মাঠে নেমেছে, ঠিক তখনই হঠাৎ করে ছাত্রলীগের ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষ ও শ্লীলতাহানির মতো স্পর্শকাতর অভিযোগ সরকার ও দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে চরম বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পতিত করেছে। বীভৎস কায়দায় মানুষকে পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে নির্বাচনের মাঠে বিএনপি-জামায়াত জোট এখন ছাত্রলীগের এসব অপকর্মকে সামনে এনে সরকারকেই উল্টো ঘায়েল করতে চাইছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহের ছাত্রলীগের খুনোখুনির ঘটনায় চরম ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। ইতোমধ্যে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মাত্র কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা নিজে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলমকে দ্রুত সম্মেলনের মাধ্যমে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন। খোদ প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশের পর আগামী জুনের মধ্যে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন শেষ করতে কাজ করছে সংগঠনটির বর্তমান নেতৃত্ব। তবে মেয়াদোত্তীর্ণ ছাত্রলীগের বর্তমান নেতৃত্ব সারাদেশে সংগঠনটির চেইন অব কমান্ড রাখতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। ফলে কোন ঘটনা ঘটলেই জড়িতদের নামকাওয়াস্তে বহিষ্কার ছাড়া ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখতে বার বারই ব্যর্থ হচ্ছে বর্তমান নেতৃত্ব। ছাত্রলীগের নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকা বেশ ক’জন বর্তমান কেন্দ্রীয় নেতা ক্ষোভের সঙ্গেই অভিযোগ করেন, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সংগঠনের সবকিছু এককভাবে নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টার কারণেই এখন দেশের কোথাও কোন শৃঙ্খলা নেই। শুধুমাত্র নিজেদের আধিপত্য ও কর্তৃত্ব বজায় রাখতে কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত ত্যাগী ও আদর্শবাদী ছাত্রনেতাদর বাদ দিয়ে আদর্শহীন-সুযোগসন্ধানী শিবির-ছাত্রদলের ক্যাডারদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করার কারণেই সরকারের সব অর্জন আজ ম্লান হতে বসেছে। গত এক সপ্তাহে ছাত্রলীগের অপকর্ম প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের একাধিক জানিয়েছেন, এসব বিষয়ে সরকারের নীতিগত অবস্থান হচ্ছে কঠোর। ইতোমধ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাঁরা মনে করেন, স্থানীয় নেতাদের আধিপত্য আর নিজ প্রভাববলয় বিস্তারের জন্য ছাত্রলীগ-যুবলীগকে ব্যবহারের কারণে এসব খুনোখুনি হচ্ছে। তা ছাড়া দলে কিছু সুযোগসন্ধানী ঢুকে পড়ায় এসব ঘটনা ঘটছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও বলছেন একই কথা। তাঁদের মতে, ক্ষমতাসীন দলের বেপরোয়া হয়ে ওঠার প্রবণতাটি ঐতিহাসিক। মূলত দুই ভাবে এটি সংঘটিত হয়। একদিকে দলের মধ্যে যারা সুবিধাভোগী অর্থাৎ না চাইতেই অনেক কিছু পেয়ে গেছে তারা ক্ষমতা পেয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। অন্যদিকে নিজেরা রাজনীতি করতে না পেরে সরকারি দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করতে প্রতিপক্ষ লোক ঢুকে যায় ক্ষমতাসীন দলে। ক্ষমতাসীন দলের ওপর দোষ চাপাতে ও প্রতিপক্ষদের হাতে ইস্যু তুলে দিতেই দলে ঢুকে পড়া বহিরাগতরা সুযোগ বুঝে এ ধরণের কর্মকান্ড ঘটায়। সমাধান প্রসঙ্গে বিশ্লেষকদের মত হচ্ছে, জড়িতদের ‘দুর্বৃত্ত’ হিসেবে চিহ্নিত করে শুধু সংগঠন কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার নয়, তাদের ফৌজদারি আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক বিচার করতে হবে। যা দেখে ভবিষ্যতে ছাত্র নামধারী সুযোগসন্ধানীরা আর কোন অপকর্ম করার সাহস দেখাতে পারবে না। আওয়ামী লীগ ঘরানার সব শ্রেণীর মানুষ ক্ষুব্ধ কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়েছেন- এত ছাত্রলীগ এতদিন কোথায় ছিল? বিএনপি-জামায়াত জোটের পাঁচ বছর, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দু’বছর এমনকি সর্বশেষ ৫ জানুয়ারি নির্বাচনপূর্ব বিএনপি-জামায়াত জোটের ভয়াল নাশকতার সময় রাজপথে ছাত্রলীগকে খুঁজেই পাওয়া যায়নি। এখন সুসময়ে বানের স্রোতের ভেসে আসা ছাত্রলীগ নামধারী এরা কারা? তাঁদের মতে, ছাত্রলীগ কিংবা যুবলীগকে দিয়ে শেখ হাসিনার সরকার তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসেনি। দক্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব, অভাবনীয় উন্নয়ন-সাফল্যে বিশ্লেষণ করেই দেশের জনগণ সবধরণের নাশকতা-সহিংসতা ও ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছে। তাই ছাত্রলীগ-যুবলীগের সুযোগসন্ধানীদের বাড়াবাড়ির কারণে শেখ হাসিনার অর্জন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে না। উন্নয়ন-অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করার আছে শক্তহাতে ছাত্রলীগ-যুবলীগ নামধারী এসব দুর্বৃত্তদের দমন করার এখনই সময়।
×