ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ জুন ২০২৫, ৯ আষাঢ় ১৪৩২

ইলিশের আশায় সাগরে, ফিরলেন খালি হাতে—কুয়াকাটার খুটা জেলেরা দিশেহারা

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া, পটুয়াখালী  

প্রকাশিত: ১৯:১৮, ২৩ জুন ২০২৫

ইলিশের আশায় সাগরে, ফিরলেন খালি হাতে—কুয়াকাটার খুটা জেলেরা দিশেহারা

ছবি: দৈনিক জনকণ্ঠ।

প্রায় ৩৫ বছর ধরে খুটা জেলে হিসেবে কুয়াকাটা সংলগ্ন অগভীর সাগরবক্ষে ইলিশ শিকার করেন আবু হানিফ মাঝি। তিন জনে মিলে জাল তুলে ৪০০ গ্রাম ওজনের একটি ও দুইটি জাটকা ইলিশ পেয়েছেন। 

আজ সোমবার (২৩ জুন) দুপুরে জাল তোলার পরে কথা হয় আবু হানিফের সঙ্গে। জানালেন, অবরোধের পরে দুই-তিন দিনে মাত্র ১২ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করেছেন। এরপরে সাগর উত্তাল হওয়ায় মাছ তো দূরের কথা, উলটো তার ২৪টি জালের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। একটি জালও ঠিকমতো কাজে লাগবে না বলে জানালেন। শুধু রশি আর কিছু ফ্লোট (ভাসা) কাজে লাগবে। জাল নতুন কিনতে হবে। অন্তত ৭৫ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে তাঁদের। তিনটি সংসারের ভরণপোষণ নির্ভর করে মাছ ধরার ওপর। দাদনের টাকায় সংগৃহীত ইঞ্জিনচালিত নৌকাসহ এই জাল আর নিজেদের তামাটে রঙের শরীরটাই তাঁদের পুঁজি। আবু হানিফের দাবি, গত চার বছর ধরেই ইলিশের আকাল চলছে। তবে এ বছর তা এখন পর্যন্ত ভয়াবহ মনে হচ্ছে তাঁদের। পেশা নিয়ে মানুষগুলো চরম হতাশা প্রকাশ করলেন।

এভাবে অবরোধ শেষ হলেও কুয়াকাটার খুটা জেলেদের দুঃখ কষ্ট শেষ হয়নি। একেতো মাছের দেখা মেলে না। তার উপরে গত কয়েকদিনের সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের তাণ্ডবে একেক জেলের ১০/১২ থেকে ২০/২২টি জাল ছিড়ে গেছে। ভেসে গেছে অনেকের জাল-খুটা। গড়ে প্রত্যেকের অন্তত ২০-৪০/৫০ হাজার টাকার জাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারও প্রায় লাখ টাকা। এভাবে এখন পর্যন্ত সাগরে মাছ ধরতে নামা আড়াই শ’ খুটা জেলের অর্ধকোটি টাকারও বেশি লোকসান হয়ে গেছে। এভাবে প্রত্যেক নৌকায় দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার দাদন নিয়ে মৌসুমের শুরুতেই লোকসানের ধকলে পড়ল ক্ষুদে খুটা জেলেরা। মাত্র দুই-তিন দিন ঠিকঠাক মতো জাল পেতে গড়ে প্রত্যেকে ১০/১২ থেকে সর্বোচ্চ ৪০-৫০ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করতে পেরেছেন। অথচ স্থায়ী ক্ষতির কবলে পড়ল অন্তত অর্ধকোটি টাকার। কম পুঁজির এসব জেলেরা এখন পেশা নিয়ে সংকটে পড়েছেন। সাগরের বৈরী আচরণে দিশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।

সাগরের অগভীর এলাকায় ইলিশসহ বিভিন্ন ধরনের মাছ শিকার করা জেলেদের বলা হয় খুটা জেলে। কুয়াকাটা সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের দুই তিন কিলোমিটার দূরে অগভীর সাগরবক্ষে এরা মাছ শিকার করেন। খাজুরা মোহনা থেকে গঙ্গামতি পর্যন্ত দীর্ঘ এলাকায় অন্তত ৪৬০ জেলে নৌকা এই মাছ আহরণের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। একেকটি নৌকায় ৩-৫জন জেলে মাছ ধরে আসছেন। প্রায় ২০০ হাত লম্বা এবং ১০-১২ হাত খাড়া একেকটি জাল থাকে। এভাবে একেকটি নৌকার জেলেরা ১৫ থেকে ২৪-২৫টি জাল সাগরের অগভীর এলাকায় খোঁটার সঙ্গে পেতে রাখেন। প্রতিদিন ভাঁটার সময় গিয়ে জালের আটকা মাছ সংগ্রহ করেন।

রশিদ মাঝি জানান, অবরোধ শেষ হওয়ার পরদিন সাগরের প্রায় দুই কিলোমিটার ভিতরে চারজনে মিলে ২২ টা জাল পেতে রাখি। দুই বারে ৩০-৪০ হাজার টাকার মাছ পেয়েছি। ইলিশের সাইজ খুব ছোট। এরপর মঙ্গলবার থেকে টানা তিন দিন সাগর অনেক উত্তাল হয়ে যায়। স্রোতে আর ঢেউয়ে ১৩-১৪টা জাল ছিড়ে গেছে। অন্তত ৭০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। জাল পাতার খুটাও ভেসে গেছে। একই সর্বনাশার কথা জানালেন, আলআমিন মাঝি, ইউসুফ মাঝি, সুমন শেখ, আলতাফসহ অনেকেই। সুমন মাঝি জানান, পাঁচ জনে মিলে জাল পেতে খালি হাতে ফিরেছেন। তাদের কষ্টের যেন শেষ নেই। এভাবে মৌসুমের শুরুতেই সহস্রাধিক খুটা জেলের সর্বনাশ হয়ে গেছে। খুটা জেলেরা অনেকটা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। ধারদেনায় এখন কাহিল হয়ে আছেন।

কুয়াকাটা আশার আলো মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নিজাম শেখ জানান, এখানকার অন্তত ৪৬০ টি খুটা জেলে নৌকায় কমপক্ষে দেড়-দুই হাজার জেলে পরিবার সাগরের অগভীর এলাকায় ইলিশ মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছে। এবারে এখন পর্যন্ত তিন শতাধিক বোট অবরোধের পরে সাগরে নামছে। কিন্তু কেউ ১০-১২ থেকে ৪০ হাজার টাকার বেশি মাছ বিক্রি করতে পারে নাই। আর গত সপ্তাহের তিনদিনের সাগর উত্তাল হওয়ায় শতকরা ৯০ জনের জাল ছিড়ে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। প্রত্যেকের ৫০-৬০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। রশি আর ফ্লোট ছাড়া কিছুই কাজে লাগবে না। অনেকের ট্রলারের বডি থেকে শুরু করে ইঞ্জিন পর্যন্ত নষ্ট হয়ে গেছে। আর আজকে তো কোন ইলিশ নাই বললেই চলে। লোকসানে লোকসানে ক্ষুদ্র পুঁজির জেলেরা খুব খারাপ অবস্থায় আছেন। তার দাবি সরকারি সহায়তা প্রয়োজন জেলেদের। অন্তত সুদমুক্ত লোনের জরুরি ব্যবস্থা করা প্রয়োজন মনে করেন তিনি। না হলে এ পেশার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যাবে। নতুন করে প্রত্যেকের আবার জাল কিনতে হবে।

মিরাজ খান

×