ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৯ জুন ২০২৫, ২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

উত্তরের লাইফ লাইন তিস্তা কি গতিপথ বদলাচ্ছে?

তাহমিন হক ববী

প্রকাশিত: ১৭:৫১, ৯ জুন ২০২৫; আপডেট: ১৭:৫৮, ৯ জুন ২০২৫

উত্তরের লাইফ লাইন তিস্তা কি গতিপথ বদলাচ্ছে?

ছবি: সংগৃহীত

আন্তজার্তিক নদী তিস্তা। যাকে বলা হয় উত্তরের লাইফ লাইন। অর্থাৎ উত্তরের জীবন রেখা। পূর্বের হিসাব মতে কয়েক দশক পর তিস্তার গতিপথের বদল হতো। কিন্তু ২০২৩ সালের ৪ অক্টোবর সিকিমের সাউথ লোনাক হ্রদের পানি উপচে পড়ে তিস্তা নদীতে যে ভয়ঙ্কর আকস্মিক বন্যা নেমে এসেছিল, তারই জেরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সমতল অঞ্চলের কয়েকটি জায়গায় নদীটি গতিপথ বদল করেছে। তিস্তা যেখানে পাহাড় থেকে নেমে সমতলে পড়ছে, সেই দার্জিলিং এর সেভক থেকে মেখলিগঞ্জ পর্যন্ত পুরো এলাকাতেই প্রাথমিক সমীক্ষায় নদীর গতিপথ উল্টাপাল্টা হয়েছে।

ওই সূত্রগুলি বলছে ভারত সীমান্তের ওই দিকে যদি তিস্তার গতিপথ কিছুটা বদল করে থাকে, তাহলে বাংলাদেশেও একই ঘটনা হয়ে থাকতে পারে। সূত্র বলছে সিকিম থেকে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত অন্তত ৫ জায়গায় গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে এ নদীর। এ অবস্থায় ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশেরই তিস্তার তীরের বাসিন্দাদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে নদীর স্যাটেলাইট ছবি পেতে ইসরোর দ্বারস্থ হয়েছে ভারতের তিস্তা সংযুক্ত সেচদপ্তর। বলা হচ্ছে সেভকের কাছে গতিপথ বদলে তিস্তা ঢুকে পড়েছে ডানদিকে। ফলে চমকডাঙি ও লালটং বস্তির মতো দীর্ঘদিনের দুটি জনপদ কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে তিস্তায়। সেখানকার বাসিন্দাদের সরিয়ে নিতে হয়।

আবার ক্রান্তির চ্যাংমারি এলাকায় এসে আবার বাঁদিকে বাঁক নিয়েছে তিস্তা। ফলে সেখানেও বিপন্ন গ্রাম। নদীরপানি ঢুকে পড়ায় এবারও চ্যাংমারির পশ্চিম দলাইগাঁও এলাকার প্রায় শত পরিবারকে ঘর ছাড়তে হয়েছে। ঠাঁই নিতে হয়েছে বাঁধে। আবার গজলডোবার কাছে তিস্তা ডানদিকে ঘুরে যাওয়ায় বিপদের আশঙ্কায় পড়েছে মিলনপল্লির বাসিন্দারা। এদিকে বাংলাদেশের অংশের ৪৩ কিলোমিটার এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ। তার মধ্যে ২০ কিলোমিটার তীব্র ঝুঁকি হয়ে পড়েছে।

তবে উত্তরবঙ্গের নদী বিশেষজ্ঞ ও ভূগোল বিভাগের প্রাক্তন প্রধান অধ্যাপক সুবীর সরকার বলছেন, তিস্তার মতো পাহাড়ি নদীতে অল্পস্বল্প জলধারা বদলানো খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়।"তিস্তা একটা পাহাড়ি নদী, তার দুদিকে উঁচু ডাঙ্গা জমি। এইসব নদীর ক্ষেত্রে যেটা হয় কখনও কখনও জলের ধারা ডানে বা বাঁমদিকে বইতেই পারে। এটাকে গতিপথের সুইং বলা হয়। এই পরিস্থিতিতে তিস্তা কোথায়, কতটা বিপজ্জনক চেহারা নিয়েছে, তা জানতে ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশনের দ্বারস্থ হয়ে ইসরোর কাছ থেকে তিস্তার স্যাটেলাইট ইমেজ চেয়ে আবেদন করা হয়।

ভারতের সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়া ভারতীয় মিডিয়াকে বলেন, আমাদের দপ্তর তিস্তা নিয়ে ইতিমধ্যে সমীক্ষা করেছে। তাতে ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে। তিস্তার স্যাটেলাইট ইমেজও পাওয়ার চেষ্টা করছি আমরা। তাঁর অভিযোগ তিস্তায় বাঁধ দিয়ে অবৈজ্ঞানিকভাবে সিকিমে ছটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। তারই জেরে আগ্রাসী হয়ে উঠেছে নদী। পাহাড় থেকে বিপুল জলরাশির সঙ্গে বোল্ডার, মাটি নিয়ে এসে সমতলে ফেলছে তিস্তা। তার প্রভাব পড়ছে সমতলে। তবে তিস্তা নদীর সমতলে দুই সীমান্তে দুই দেশের বড় দুটি বাঁধ রয়েছে। একটি ভারতের গজলডোবায় ও অপরটি বাংলাদেশের ডালিয়াস্থ এলাকায় তিস্তা ব্যারাজ।

তিস্তার জন্ম বৃত্তান্ত সম্পর্কে কালিকা পুরাণ-এ বলা হয়েছে পার্বতীর বুক থেকে তিনটি ধারা বের হয়ে ত্রিস্রোতা বা তিস্তার জন্ম। উত্তর সিকিমের পার্বত্য এলাকা লাচেন পর্বত থেকে লাচেনচুং এবং লাচুং পর্বত থেকে লাচুংচু নামের দুই স্রোতধারা মিশেছে চুংখান নামের স্থানে। এই সঙ্গমটি চিতামু বা সোলামো হ্রদ নামেও পরিচিত। সাত হাজার দুইশত মিটার ওপর থেকে চুংথামের যত ভাটিতে নামতে থাকে, তত প্রশস্ত হতে থাকে এই ধারাটি। পথের মধ্য রাংনিচুং, ডিমচু, ডিকচু ও চাকুংচু প্রধান উপ নদ-নদী। রাংনিচুং একটি বড় উপনদী, এটি মিলেছে সিংতাম নামের জায়গায় আর বাকি তিনটা গ্যাংটকের কাছে। সিংতাং থেকে দক্ষিন-পূর্ব দিকে রাংপোচু নদীর ও দক্ষিন-পশ্চিমে গিয়ে রঙ্গিত নদীর জল এসে মিলেছে তিস্তায়। তারপর রাপো ও সেভক হয়ে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি ও মেখলিগঞ্জ অতিক্রম করে নীলফামারী জেলার ডিমলার পূর্বছাতনাইয়ের কালিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে। এরপর নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর জেলার কাউনিয়া দিয়ে কুড়িগ্রামের উলিপুর দিয়ে চিলমারী উপজেলার কাঁচকোলে ব্রহ্মপুত্রে পতিত হয়। এরই অন্য ধারাটি মানাস নাম নিয়ে গাইবান্ধা জেলার কামারজানিতে গিয়ে ব্রহ্মপুত্রে পড়ে। লোকমুখে শোনা যায়, মানাস নদীর একটি স্থানে বীর ভবানী পাঠকের বজরা ডুবে যাওয়ার ঘটনা থেকে জায়গাটির নাম হয় বজরা।

জানা যায়, তিস্তা একসময়ে গঙ্গায় গিয়ে মিশতো। পুরানো একটি মানচিত্র, যা ১৭৬৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, সেখানে তিস্তা দক্ষিণমুখী নদী ছিল। ১৭৮৭ সালের বন্যার পর থেকে দক্ষিণ পূর্ব দিকে সম্পূর্ণ নতুন খাতে সরতে শুরু করে তিস্তা। যা গঙ্গার বদলে তিস্তা ভারতের জলপাইগুড়ি হয়ে বাংলাদেশের নীলফামারী দিয়ে ব্রহ্মপুত্রে গিয়ে পড়ে এখন। ভারতের তৎকালীন সার্ভেয়ার জেনারেল মেজর জেমস রেনল্ডের তত্ত্বাবধানে তৈরি মানচিত্র আর পুরানো নথির সূত্র বলছে ১৯৬৮ সালের উত্তরবঙ্গে ভয়াবহ বন্যার পরে আরও কিছুটা গতিপথ বদলিয়েছে তিস্তা, তবে ১৭৮৭ র মতো সম্পূর্ণ নতুন খাত নয় সেটি।

বুকানন হ্যামিলটনের মতো সার্ভেয়ার, যিনি ওই অঞ্চলে ১৮৩০-৩৩ সালে, তিনিও যেমন বর্ণনা দিয়েছেন, আবার ১৮১১ সালের প্রথম সার্ভে থেকেও জানা যায় যে তিস্তা তার গতিপথ বদল করছিল।১৭৮৭ র বন্যা ছাড়াও সেই সময়ে বেশ কয়েকটি ভয়াবহ ভূমিকম্পও হয়েছিল। এসবের কারণেই তিস্তা সম্পূর্ণ নতুন খাতে চলে যায়। এ বিষয়ে ভারতীয় মিডিয়ার সাক্ষাৎকারে ভারতের সেচদপ্তরের উত্তরপূর্বের চিফ ইঞ্জিনিয়ার কৃষ্ণেন্দু ভৌমিক জানিয়েছেন ২০২৩ সালের অক্টোবরে সিকিমের লোনক হ্রদ বিপর্যয়ের পর থেকে তিস্তার অবস্থা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। তিনি ভারতীয় মিডিয়াকে আরও বলেন, আমাদের সমীক্ষায় ধরা পড়েছে, সিকিমের বিপর্যয়ের জেরে সমতলে তিস্তার তলদেশ ৩-৫ ফুট উঁচু হয়ে গিয়েছে। কোথাও কোথাও নদীখাত এতটা উঁচু হয়ে গিয়েছে যে, নীচে চলে গিয়েছে জনপদ। দীর্ঘ গতিপথে তিস্তার বর্তমান অবস্থা জানতে স্যাটেলাইট ইমেজের প্রয়োজন। এনিয়ে রাজ্যে প্রস্তাব জমা দেওয়া হয়েছে। তাঁর দাবি, আগে যেখানে কয়েক দশক পর তিস্তার গতিপথের বদল হতো, ২০২৩ সালে সিকিমে বিপর্যয়ের পর দেখা যাচ্ছে, প্রতি বছরই ওই নদীর গতিপথ বদলাচ্ছে।

বাংলাদেশ অংশের তিস্তার কি অবস্থাঃ

তিস্তাপাড়ের মানুষজন বলছেন হে তিস্তা গতিপথ বদলাচ্ছে। বাম থেকে ডান দিকে সরে যাচ্ছে। আবার কয়েক কিলোমিটার প্রবাহের পর ডান থেকে বাম দিকে সরছে। গতিপথ পরিবর্তন না হলে নদীর ভাঙ্গন হচ্ছে কেন এমন প্রশ্ন চরবাসীদের। বলা হচ্ছে গতিপথ পরিবর্তনের কারনে এবং সংস্কারের অভাবে বালু ও পলিতে ভরাট হয়ে এখন সমতল থেকে অনেক উঁচু হয়েছে তিস্তার বুক। ফলে পানির ধারণক্ষমতা কমে উজানের ঢলে সৃষ্টি হওয়া সময়, অসময়ের বন্যায় ভয়াবহ ক্ষতির মুখে তিস্তা অববাহিকার বাসিন্দারা। শুধু মৌসুমি ফসলই নয় বিলীন হচ্ছে বসতভিটা, আবাদি জমি। তিস্তা পাড়ে বসবাস করা একাধিক ব্যক্তি জানান, খরায় পানির অভাবে এক ধরনের সংকট। আবার বন্যায় পানিতে ভাঙন, প্লাবনসহ নানা দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়। রিভারাইন পিপলের গবেষণা বলছে, প্রতিবছর বন্যা ভাঙনে তিস্তা পাড়ের বাসিন্দাদের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। একই সঙ্গে শুষ্ক মৌসুম ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারে ৬ হাজার কোটি টাকার বোরো উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তবে তিস্তার টেকসই সংস্কারে আপাতত কোনো উদ্যোগ না থাকলেও বালুর বস্তা দিয়ে তিস্তার পাড় রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ড খরচ করছে শত কোটি টাকা। কল্লোলিনী তিস্তার কল্লোলে রয়ে গেছে কালের যাত্রাবদলের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি। তিস্তার গতিপথ বদলের ফলে বৃহত্তর রংপুর থেকে তিস্তার গর্ভে হারিয়ে গেছে হাজার হাজার একর জমি বসতবাড়ি। ২৩৮ বছরের পুরোনো তিস্তা নদী রায় টেকসই পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তিস্তার আগ্রাসী আচরণে নদীভাঙন ও বন্যায় সর্বস্বান্ত হয়েছে মানুষ। ফলে উত্তরের পাঁচ জেলাবাসীর জীবন-জীবিকা ও জীববৈচিত্র্যের বিরূপ প্রভাব পড়েছে। সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তিস্তায় টেকসই মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে জোর দিয়েছে। নদীর গতিপ্রকৃতি ঠিক রেখে তিস্তায় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন নদী বিশেষজ্ঞরা। নদী বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্ষা-বৃষ্টির পানির মাত্র ৮ শতাংশ ব্যবহার করতে পারে তিস্তাপাড়ের মানুষ। বাকি ৯২ শতাংশ পানি সাগরে পতিত হয়। বর্ষাকালে তিন থেকে চার লাখ ঘনফুট পানি একযোগে তিস্তায় প্রবাহিত হয়। এ পানি তিস্তা তার বুকে ধারণ করতে পারে না। ফলে তিস্তাপাড়ে দীর্ঘমেয়াদি বন্যা ও ব্যাপক ভাঙন দেখা যায়। ভাঙনের ফলে গ্রাম, ভিটেমাটি, ফসলি জমি, ঘরবাড়ি, কবরস্থান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মন্দিরসহ নানা অবকাঠোমো নদীতে বিলীন হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোডের্র উত্তরাঞ্চল কার্যালয়ের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলছেন বিভিন্ন এলাকায় তিস্তার প্রবাহ ডান ও বামদিকে সরছে। ফলে ভাঙ্গন দেখা দিচ্ছে। এরকম ৪৩ কিলোমিটারে মতো এলাকায় ২০ কিলোমিটার প্রচন্ড ঝুঁকিপূর্ণ। এরমধ্যে নীলফামারীর বাইশপুকুর, সোনাখুলী, রংপুরের গঙ্গাচরা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর এলাকায় ভাঙ্গনরোধের কাজ চলমান রয়েছে। যা দ্রুত সম্পন্ন করা হচ্ছে।

রিফাত

×