
ছবি: সংগৃহীত
নেত্রকোনা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক নীলক্ষেত্র। বলা যেতে পারে প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি।এ জেলায় মোট ১০টি উপজেলা একদিকে মদন, মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরীর বিশাল হাওর অঞ্চল। অপরদিকে রয়েছে কলমাকান্দা ও দুর্গাপুর উপজেলার পাহাড়ি অঞ্চল।আর এ দুইয়ের মাঝে রয়েছে নেত্রকোনা সদর,বারহাট্টা,পুর্বধলা , কেন্দুয়া, আটপাড়া উপজেলার বিশাল সমতলভূমি।হাওর অঞ্চলের প্রকৃতি দিয়েই শুরু করা যাক নেত্রকোনা জেলার প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমির বর্ণনা। মোহনগঞ্জ উপজেলার ডিঙ্গাপোতা হাওরের দৈর্ঘ্য প্রায় ১২ কিলোমিটার ও প্রস্থ ৭ কিলোমিটারের উপরে। বর্ষাকালে অথৈ পানিতে ভরপুর এ হাওরটি মিনি সাগরের মতো দেখায়। শীতকালে অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে এর বিভিন্ন বিল,ঝিল ও নিম্ন এলাকা।পলো দিয়ে মাছ ধরার উৎসবকে ‘পলো উৎসব’ বলেন এলাকার লোকজন। তবে দেশীয় মাছ কমে যাওয়ায় হাওরের দুই পাড়ের জেলে সম্প্রদায়ের লোকজন তাদের পরিবার নিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করছেন।
খালিয়াজুরী উপজেলার বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে হাওর অঞ্চল। যেখানে এক প্রবাদ প্রচলিত আছে বর্ষায় নাও আর শুকনায় দুপাও'। বর্ষাকালে নৌকা ছাড়া পায়ে হেঁটে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে পুরো উপজেলা।তখন অথৈ পানিতে ভেসে থাকা এক একটি গ্ৰামকে ছোট দ্বীপের মতো মনে হয়। এখানকার সবচেয়ে বড় নদীর নাম ধনুনদী। ধনু নদীর বুকে চলে সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ থেকে লঞ্চ ও মালামাল ভর্তি কার্গো। তবে প্রায় প্রতি বছর উপজেলার কোনো না কোনো হাওর অকাল বন্যার পানিতে একমাত্র ফসল বোরধান তলিয়ে যায়। ফলে এলাকার কৃষকের ঘরে ঘরে নেমে আসে অভাব আর অনটনের অভিশাপ। এ এলাকার অস্থায়ী ফসল রক্ষা বাঁধ সংস্কার করে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ দাবি এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের।
মোহনগঞ্জ উপজেলার বাহাম গ্ৰামে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের গানের সুরকার ও উস্তাদ শৈলজারঞ্জন মজুমদারের জন্মস্থানে নির্মিত হয়েছে শৈলজারঞ্জন একাডেমি।এ প্রতিষ্ঠানের মনোরম অডিটরিয়াম ও গ্যালারি মন কেড়ে নেয়।
জেলার সীমান্তবর্তী দেশবিখ্যাত পর্যটন এলাকাটি দুর্গাপুর উপজেলায় অবস্থিত। দুর্গাপুরে অবস্থিত বিজয়পুরের দৃষ্টিনন্দন সাদা মাটির পাহাড়ের নাম দেশের কে না জানে। এ পাহাড়ের রুপালি সাদা মাটির পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে প্রতিদিন দেশ বিদেশের অসংখ্য পর্যটক এসে ভিড় জমায়। তবে নির্বিচারে সাদা মাটি উত্তোলন করতে গিয়ে ধ্বসে পড়েছে অনেক আদিবাসী গারো,হাজংদের বসতবাড়ি। হারিয়ে গেছে জীববৈচিত্র্য ও সৌন্দর্য। সাদা মাটির একটি স্থানীয় কারখানা নির্মাণের জন্য দাবি এলাকাবাসীর। এলাকার মানুষ সাদা মাটির মূল্য ভেবে একে সাদা সোনা বলে থাকেন কেউ কেউ।
দুর্গাপুরের সোমেশ্বরী নদীই হচ্ছে জেলার সবচেয়ে বড় নদী। সোমেশ্বরী নদীর স্বচ্ছ পানি দেখামাত্র হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। সারাদেশে একসময়ের অতি পরিচিত ও জনপ্রিয় সুস্বাদু মাশুল মাছ এ সোমেশ্বরী নদীর পানিতে পাওয়া যায়। সোমেশ্বরী নদীর দুই তীরে ঘন ঘন জোয়ার ভাটা দেখা যায়।যা কম সময়ে আসে ও চলে যায়। সোমেশ্বরী নদীর তীরে ভাঙ্গনের কবলে পড়ে প্রতি বছর বসতবাড়ি ভেসে যায়। সরকার প্রতি বছর বাঁধ নির্মাণ করেও এর প্রতিকার পাচ্ছেন না।
কলমাকান্দা উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় অতি পরিচিত এক আদিবাসী গারোদের বাসস্থান হচ্ছে পাতলাবন। কলমাকান্দা শহর থেকে পাতলাবন যেতে খানা খন্দকে ভর্তি সড়কে পর্যটকের সংখ্যা কমে আসছে দিনদিন। অথচ পাতলাবন সংলগ্ন ভারতের সীমান্ত পাহাড় ঘেঁষা মহাদেও নদী সৌন্দর্যের লীলাভূমি। গারো মায়েদের বাঁশের তৈরি লম্বা ঝুড়ি আর ছোট শিশুদের পিঠে করে নিয়ে দল বেঁধে হাঁটার দূশ্য মন কেড়ে নেয়।
চিকিৎসা,শিক্ষা আর চলাচলের উপযোগী রাস্তা না থাকায় আদিবাসী গারোদের জীবন যাপন করতে খুব কষ্ট হচ্ছে খাবার পানির অভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে জনস্বাস্থ্য।অল্প সংখ্যক টিউবওয়েল চেপে পাওয়া পানিতে আয়রনের পরিমাণ অনেক বেশি। অনেকেই পানির অভাব পূরণ করতে বালি খুড়ে নিচ থেকে পানি উঠায়।
তবে কলমাকান্দা উপজেলার একসময়ের ঐতিহ্য মহিষের গাড়ি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। উপজেলার বরুয়া কোনা,পাতলাবন এলাকায় হাতে গোনা কয়েকটি মহিষের গাড়ি চলাচল করে।মহিষের খাবারের অভাবে পালন করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানান এলাকাবাসী।সার, লাকড়ি ,ধান চাল নিয়ে এখনও এসব এলাকার বিভিন্ন সড়কে মহিষের গাড়ি চলাচল করে।
জেলার কেন্দুয়া উপজেলার সাজিউড়া গ্ৰামে অবস্থিত অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে ঐতিহাসিক বৃটিশ পার্লামেন্টের অর্থমন্ত্রী নলিনী সরকারের পৈতৃক বাড়ি। তিনি কলকাতা শহরের মেয়র ও ছিলেন। দোতলা ইটের তৈরি বাড়িটি লতাপাতায় ছেয়ে গেছে। ময়লা,আবর্জনায় ভর্তি ভবনের কারুকাজ বোঝা যায় না। জমিদার আমলের শেষের দিকে নলিনী সরকারের পিতা চন্দ্রনাথ সরকার স্বপরিবারে কলকাতা শহরে চলে যান। ভবনের পাশে বিভিন্ন দেবদেবীর মন্দিরটি পুরনো আমলের সনাতন ধর্মের উৎসবের কথা মনে করিয়ে দেয়। বাড়ির সামনে অবস্থিত বিশাল আকারের পুকুরের তীরে প্রাচীন দুটো তোরণ বাড়ির স্মূতি বুকে ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে। এ বাড়িটি সংরক্ষণ করে এর ঐতিহ্য রক্ষার দাবি এলাকাবাসীর।
প্রতিদিন কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইলবাড়িতে অবস্থিত মোঘল আমলের স্থাপনা দেখতে বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ আসে। বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে এ বাড়ির ঐতিহ্য রক্ষার জন্য বিভিন্ন স্থাপনা। তবে ঐতিহাসিক মোঘল আমলের আলোচিত স্থাপনা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় রাস্তাঘাট ও আর ও যুগোপযোগী আবাসিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে জানান উপস্থিত পর্যটকগণ।
নেত্রকোনা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থিত শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে নির্মিত হয়েছে স্মূতিশৌধ।যার নান্দনিক সৌন্দর্য দেখতে অপূর্ব।প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর নেত্রকোনা মুক্ত দিবস উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এখানে এসে উপস্থিত হন। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে কাজ উপলক্ষে যারা এসে ভেতরে প্রবেশ করেন , তারা এ স্থাপনার সৌন্দর্য না দেখার উপায় নেই। ছোট আকারের হলে ও এর নির্মাণ শৈলী মানুষমাত্রই আকর্ষণ করে।
দেশের অতি জনপ্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণের পৈতৃক বাড়ি বারহাট্টা উপজেলাধীন তার জন্মভূমি কাশতলা গ্ৰামে অবস্থিত।এ বাড়িতে পাঠাগার, সঙ্গীত চর্চা কেন্দ্র ও চিত্রকর্ম প্রদর্শনী সংরক্ষিত আছে। কবি নির্মলেন্দু গুণ নিজ পছন্দ অনুযায়ী দীর্ঘ সময় নিয়ে বাড়িটি নির্মাণ করেছেন। এ বাড়িতে মাইকেল মধুসূদন দত্তের ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। বাড়ির সামনে ও পেছনে নির্মাণ করা হয়েছে বিশাল দুটো শানাইবাধা ঘাটসহ পুকুর। প্রতি বছর কবির জন্মদিন পালন উপলক্ষে বিভিন্ন এলাকা থেকে অগণিত কবি ভক্ত এসে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে।
জননন্দিত অমর লেখক অধ্যাপক হুমায়ুন আহমেদের পৈতৃক বাড়ি নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুর গ্রামে। হুমায়ূন আহমেদ জীবিত থাকা অবস্থায় শহীদ বিদ্যাপীঠ নামক একটি বিদ্যালয় স্থাপন করে গেছেন।যার গঠনশৈলী অত্যন্ত মনোরম। হুমায়ূন আহমেদ এখানে একটি উন্নত ও সূজনশীল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্থাপনের ইচ্ছে পোষণ করে ছিলেন।বিধি বাম তার সে স্বপ্ন পূরণ হবার পূর্বেই তিনি পরলোকগমন করেন। তবু এ বিদ্যালয়ের আধুনিক অথঢ একটু ভিন্ন রকম। একবার ভেতরে প্রবেশ করে দেখার পর বার বার দেখতে ইচ্ছে করে।এ বিদ্যালয়ের ফলাফল ও পাঠদান বরাবরই ভালো।
জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস জানান, আমি জেলার বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঐতিহ্য রক্ষার জন্য পরামর্শ দিতে সচেতন মহল ও সাংবাদিকদের সহযোগিতা কামনা করছি। পর্যায়ক্রমে এসব ঐতিহ্য রক্ষার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
আঁখি