ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রাম-বাংলার লোকজ আঙ্গিক

সাজেদ রহমান

প্রকাশিত: ০১:১৫, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

গ্রাম-বাংলার লোকজ আঙ্গিক

যশোরে পাটজাত পণ্য দেখছেন মেলায় আগত তরুণীরা

তিন দশক পর যশোরে ফিরছে বৈশাখী মেলা। ৩০ চৈত্র (১৩ এপ্রিল) বর্ণাঢ্য আয়োজনে যশোর টাউন হল ময়দানে এই মেলার উদ্বোধন করা হয়। দশ দিনব্যাপী মেলায় গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ও লোকজ সংস্কৃতিকে তুলে ধরা হচ্ছে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও যশোর ইনস্টিটিউট যৌথভাবে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় ১০ দিনব্যাপী লোকজ সংস্কৃতি উৎসব ও বৈশাখী মেলা ১৪৩১ আয়োজন করেছে। সমগ্র আয়োজনে যশোরসহ জেলা ও উপজেলার মোট ১৩০টি সাংস্কৃতিক সংগঠন অংশগ্রহণ করবে।

বাংলা সংস্কৃতি পরিচয়বাহী কবিগান, পটগান, গম্ভীরা, জারিগান, সঙ যাত্রা, লাঠিখেলা, সাপ খেলাসহ গ্রাম বাংলার লোকজ আঙ্গিক ধারাবাহিকভাবে প্রদর্শিত হচ্ছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিদিন বিকেল থেকে সমস্ত সংগঠনের শিশুদের নিয়ে শিশুতোষ আয়োজন চলেছ। সর্বশেষ ১৪০১ বঙ্গাব্দে যশোরে সর্বশেষ বৈশাখী মেলা হয়েছে। এরপর এমন আয়োজন এই জেলায় আর প্রশাসনের উদ্যোগে হয়নি। সেই হিসেবে তিন দশক পর বৈশাখী মেলা শুরু হওয়ায় প্রতিদিন যশোর টাউন হল ময়দানে শত শত মানুষ আসছেন। 
গ্রামীণ মেলা, সেটা বৈশাখী মেলা বা অন্য যে কোনো মেলা হোক এটা বাঙালির জীবনের অনুষঙ্গ ছিল এক সময়। আমাদের বাংলাদেশে মেলার ঐতিহ্য বহুকালের। কিন্তু তা যে কত পুরনো, কবে এবং কিভাবে এর সৃষ্টি সে তথ্য জানা যায় না। তবে মেলার আদিবৃত্তান্ত না জানা গেলেও ধারণা করা যায় যে ধর্মীয় উপলক্ষ বা ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষেই এদেশে মেলার জন্ম। কোনো কোনো লোকতাত্ত্বিক মনে করেন, গ্রামীণ মেলা কিছু জমিদারদের উদ্ভাবিত ও পরিকল্পিত।

কেননা এর সাহায্যে তাঁরা রোজগার বাড়াতেন। জামিদারদের পাশাপাশি লৌকিক উদ্যোগের কথাও স্মরণ করা যেতে পারে। মেলার এই সমাবেশ ও বিকিকিনির প্রাথমিক ধারণা সম্ভবত গ্রামীণ হাট থেকেই এসেছিল। সেই অর্থে হাটই মেলার আদিরূপ। আসলে ‘মেলা’ শব্দটি মিলন শব্দ থেকে এসেছে। শব্দটি বাংলা ভাষায় বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার হয়ে থাকে। যেমন ‘মেলা-র প্রধান অর্থ ‘মিলন’ বা ‘সম্মিলন’, তেমনি আরেকটি অর্থ হচ্ছে ‘অনেক’ বা ‘বিস্তর’ (যেমন মেলা কথা, মেলা কাজ)।

এছাড়া বহুকাল ধরে প্রচলিত খনার বচনে ‘মেলা’ শব্দের অর্থ পাচ্ছি ‘খোলা’ বা ‘উন্মুক্ত’। যেমন ‘পুবে হাঁস, পশ্চিমে বাঁশ, উত্তরে কলা, দক্ষিণে মেলা’। মূলত মেলায় আমরা এই শব্দার্থগুলোই খুঁজে পাই, যেখানে বহু লোকের মিলন বা সম্মিলন দেখি, থাকে বিস্তর বা অনেক পণ্যের দোকানপাট। সর্বোপরি মেলা বসে উন্মুক্ত বা খোলা প্রান্তরে।
এক সময় বৈশাখী মেলা দুইদিন হতো। চৈত্র মাসের শেষের দিন বসে ‘চৈত্রসংক্রান্তির মেলা’ আর বৈশাখের প্রথম দিন বসে ‘বৈশাখী মেলা’। অবশ্য সর্বক্ষেত্রে মেলা দুইদিন বসে না। কোথাও কোথাও বসে শুধু ‘বৈশাখী মেলা’ আর কোথাও বা ‘চৈত্রসংক্রান্তির মেলা’। হিন্দুপ্রধান এলাকায় চৈত্রসংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত হতো ‘গাজন’ বা ‘শিবের উৎসব’। এর সঙ্গে আরও দুটি উৎসব রয়েছে ‘চড়ক পূজা’ বা ‘চিল পূজা’।

অনেকের মতে ‘গাজন’ শব্দটি সংস্কৃত ‘গর্জন’ থেকে এসেছে ‘কারণ সন্ন্যাসী এবং বহু লোকের উচ্চধ্বনি, কোলাহল, নৃত্যগীত ও ক্কোনিনাদের মধ্যেই গাজন-উৎসব সুসম্পন্ন হয়।
যশোরের চাঁচড়া এলাকায় যুগ যুগ ধরে চড়ক পূজা হয়ে আসছে। এ উপলক্ষে এক সময় বড় মেলা বসত। সেই মেলার পরিধি কমে গেছে। চড়ক পূজা উপলক্ষে অস্থায়ী কিছু দোকানে মিষ্টি এবং মাটির তৈরি পাত্র বিক্রি হয়। সন্ন্যাসীরা ‘চড়কগাছ’ নামে অভিহিত এক স্তম্ভে ‘বান-ফোঁড়া’ অবস্থায় চক্রাকারে ঘুরতে থাকেন। ‘জিহ্বায়, পিঠে বা হাত পায়ে বাণবিদ্ধ অবস্থাকে ‘বাণ-ফোঁড়া’ বলা হয়। এই বাণটি হচ্ছে ‘বঁড়শির আকারে পঞ্চশীর্ষ অস্ত্রবিশেষ’। যশোর অঞ্চলে এক সময় বহু স্থানে চড়ক পূজা উপলক্ষে মেলা হতো। সেই সব মেলায় হাজার হাজার নারী-পুরুষ অংশ নিতেন। এত বড় চড়কপূজা যশোর অঞ্চলে কোথাও হতো না। এই পূজা হতো চাঁচড়া জমিদারদের আগে থেকেই।

মেলার যে উপলক্ষেই থাক না কেন। নানা রকমের পণ্য আসে মেলায়। যশোরের অনেক গ্রামে এখনো ছোট ছোট বৈশাখী মেলা হয়। মেলায় ঘর গেরস্থালির দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সামগ্রী, শরীর রূপসজ্জা-অঙ্গাভরণের বস্তু থেকে শিশু-কিশোরের আনন্দ-ক্রীড়ার উপকরণ ও রসনালোভন খাদ্য-খাবারের সমারোহ থাকে।

এর বাইরে নানারকমের পণ্য আসে মেলায়। এ প্রসঙ্গে একটি লোকগানের মুখটা মনে পড়ছে : ‘ও দাদা পায়ে পড়ি রে/ মেলা থেকে বউ এনে দে।’ অবোধ অনুজের বিশ্বাস মেলায় সব সামগ্রীই মেলে, এমন কি ঘরের বউ তাও মেলায় অপ্রাপ্য নয়, ফলে অগ্রজের কাছে এই কাতর প্রার্থনা। উপলক্ষ যাই থাকুক না কেন মেলার একটা সর্বজনীন রূপ আছে। মেলায় অংশগ্রহণে সম্প্রদায় বা ধর্মের ভিন্নতা বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। কেননা মেলার আর্থসাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য সবকিছু ছাপিয়ে প্রকাশিত। 
তাই মেলায় সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষের আনাগোনা। মৈত্রী-সম্প্রীতির এক উদার মিলনক্ষেত্র মেলা। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর সকলেই আসে মেলায়। তাদের অভিন্ন আকাক্সক্ষা একটিই, তা হলো মেলা বা আড়ং দেখা। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিকিকিনির আশা আর বিনোদনের টান। এক সময়  বৈশাখী মেলায় গাঁয়ের বধূর ঝোঁক থাকত আলতা, ¯েœা-পাউডার, সাবান, ঘর-গেরস্থালির টুকিটাকি জিনিসের প্রতি। আকর্ষণ তার যাত্রা বা সার্কাসের প্রতিও। আর শিশু-কিশোরের টান তো মূলত খেলনার দিকেই। মাটির পুতুল, কাঠের ঘোড়া, টিনের জাহাজ। মুড়ি-মুড়কি, খই-বাতাসা, কদমা, জিলিপি-রসগোল্লাÑ এসব খাবারেরও তার তো অরুচি নেই।
এখনো বৈশাখী মেলায় বিনোদনের জন্য আছে নাগরতোলা, ম্যাজিক, লাঠিখেলা, কুস্তি, পুতুল নাচ, যাত্রা, কবি গান, বাউল-ফকিরি গান, জারিগান, বায়োস্কোপ তো থাকেই। অভয়নগরে নওয়াপাড়া ইনস্টিটিউট মাঠে মাসব্যাপী বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে অনেকদিন ধরে। বেশাখী মেলায় লোকজ অনেক দ্রব্যাদির পসরা সাজে। বৈশাখী মেলায় বিভিন্ন লোকখেলাধুলার আয়োজন হয়ে থাকে। নৌকাবাইচ, ষাঁটের লড়াই, দড়িটানা প্রভৃতি খেলার প্রতিযোগিতা হয়। ঈদ উৎসবে নওয়াপাড়া, মহাকাল ও চেঙ্গুটিয়ায় নৌকাবাইচ হয় ভৈরব নদে।
অন্যদিকে গ্রামীণ মেলায় আধুনিকতার স্পর্শ লেগেছে। বিজলী বাতি পৌঁছে গেছে গ্রামে গ্রামে। দেশী-বিদেশী চোখ ধাঁধানো বাহারি পণ্যের জৌলুসে কদর কমেছে কুটির শিল্পজাত গ্রামীণ পণ্যের। এই রুচির পালাবদল অবশ্য শুরু হয়েছিল আগে থেকেই। স্বদেশী যুগেও গ্রামীণ মেলায় দেশী শিল্পের চাইতে বিদেশী তৈজসপত্র, কাচ এনামেলের বাসন, বিলাতি ছাতার সমাদর ছিল বেশি।

বৈশাখী মেলায় এখন উচ্চৈঃস্বরে মাইক কিংবা সাউন্ড বক্সে গান বাজে। আর সর্বস্ব লুণ্ঠন জুয়া ছাড়া তো মেলার অস্তিত্বই কল্পনা করা যায় না। আগে যে গ্রামীণ মেলা ছিল নির্মল আনন্দের পরম প্রত্যাশিত মিলন-উৎসব, আজ তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থোপার্জন ও চরিত্র হননের উপায় হয়ে উঠেছে। গ্রামীণ সমাজের অবক্ষয় মেলাকেও স্পর্শ করেছে।

সাজেদ রহমান, যশোর

×