ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদের পর টানা ৭ দিন সীমান্তের দিকে চামড়াবাহী যান নিষিদ্ধ

প্রকাশিত: ১১:২১, ৯ আগস্ট ২০১৯

ঈদের পর টানা ৭ দিন সীমান্তের দিকে চামড়াবাহী যান নিষিদ্ধ

গাফফার খান চৌধুরী ॥ এবার চামড়া পাচাররোধে স্বরাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে যৌথ টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এই টাস্কফোর্স পুরো বিষয়টি মনিটর করবে। চামড়া পাচাররোধে ঈদের পর টানা এক সপ্তাহ সীমান্তের দিকে চামড়াবাহী সব ধরনের যানবাহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে চামড়া পাচার ঠেকাতে সারাদেশের সড়ক মহাসড়কে চেকপোস্ট বসিয়ে বিশেষ অভিযান চালানো হবে। বাংলাদেশ-ভারত স্থল সীমান্তে বসানো হচ্ছে বিশেষ চেকপোস্ট। চেকপোস্টগুলোতে চামড়াবাহী প্রতিটি যানবাহনের চালক, তার ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির কাগজপত্র ও গাড়ির নম্বরের ছবি তুলে রাখা হবে। আর চালকের জাতীয় পরিচয়পত্রসহ মোবাইল নম্বর লিপিবদ্ধ করে রাখা হবে রেজিস্টার্ড খাতায়। চামড়াবাহী যানবাহনকে সাভারের চামড়া শিল্প নগরীর দিকে পাঠানো হবে। যেসব যানবাহন যেতে অনাগ্রহ দেখাবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া হবে। ২০২১ সাল নাগাদ চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সরকারের তরফ থেকে এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির তথ্য মোতাবেক, সারাদেশে ছোট বড় ৩শ’ চামড়া প্রস্তুতকারী কারখানা রয়েছে। এরমধ্যে ঢাকায় ২৬৫টি। বাকিগুলো ঢাকার বাইরে। উচ্চ আদালতের নির্দেশের পর বেশিরভাগ কারখানাই সাভার চামড়া শিল্প নগরীতে চলে গেলেও গ্যাস, বিদ্যুতসহ নানা অসুবিধা থাকায় পুুরোপুরি কাজ শুরু করতে পারেনি। প্রতিবছর ঈদ-উল-আজহায় সারাদেশে প্রায় সোয়া এক কোটি প্রাণী কোরবানি হয়। অধিকাংশ চামড়াই এক সময় ঢাকায় আসত। এখন সাভারে ট্যানারি শিল্প গড়ে ওঠায় চামড়া সেখানেই যাওয়ার কথা। বেশকিছু চামড়া দেশের বিভিন্ন জেলায় থাকা চামড়া প্রস্তুতকারী কারখানায় যায়। পরিসংখ্যান মোতাবেক, বাংলাদেশ থেকে রফতানিকারক পণ্যের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে তৈরি পোশাক। দ্বিতীয় অবস্থানে হিমায়িত মাছ। আর তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে ৫০ কোটি ৫৫ লাখ মার্কিন ডলার ও ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে সাড়ে ৬২ কোটি মার্কিন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। আর ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে বৈদেশিক আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল প্রায় একশ’ কোটি ডলার। ২০২১ সালে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে ৪০ হাজার কোটি টাকার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে চামড়া পাচাররোধে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। নিয়মিত সড়ক মহাসড়কে, রেল স্টেশন ও লঞ্চ টার্মিনালেও চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালানো হবে। বেআইনীভাবে চামড়া বেচাকেনা ও পাচারকারীদের শাস্তি দিতে মাঠে থাকবে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এবার হাইওয়ে পুলিশ প্রধান ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান চামড়া পাচাররোধে কড়া নির্দেশনা জারি করেছেন। সেসব নির্দেশনার মধ্যে আছে, চামড়া পাচারের চেষ্টা যেহেতু বছরজুড়েই হয়, এজন্য সারাবছরই চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালানো হবে। চেকপোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অবশ্যই চামড়াবাহী যানবাহনকে সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। কোনভাবেই চামড়াবাহী যানবাহন সীমান্তের দিকে যেতে পারবে না। চামড়াবাহী যানবাহন পুরোপুরি সীমান্তের দিকে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যারা এমন নির্দেশ অমান্য করবে, তাদের বিরুদ্ধে আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা আছে। ঈদের পর টানা এক সপ্তাহ সারাদেশে চামড়া পাচাররোধে বিশেষ অভিযান ও নিরাপত্তা এবং চেকপোস্ট ব্যবস্থা জোরদার থাকবে। বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোঃ সাফিনুল ইসলাম ইতোমধ্যেই সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিজিবিকে চামড়া পাচাররোধে সীমান্তে বিশেষ চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি ও নজরদারি বাড়ানোর কড়া নির্দেশ দিয়েছেন। র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের পরিচালক ও র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এমরানুল হাসান জানান, চামড়া পাচাররোধে সারাদেশে বিশেষ অভিযান চালাবে র‌্যাব। পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। বিশেষ নজরদারি করা হবে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে। ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান জানান, চামড়া পাচাররোধে রাজধানীর চারদিকে ১৪টি জায়গায় চেকপোস্ট বসানো হচ্ছে। এসব চেকপোস্ট বসছে পোস্তা, লালবাগ, হাজারীবাগ, সোয়ারীঘাট, সদরঘাট, আশুলিয়া বেড়িবাঁধ, আমিনবাজার, গাবতলী, সাভার, সাভারের বলিয়ারপুর, আব্দুল্লাহপুর, যাত্রাবাড়ীসহ আশপাশের এলাকায়। সাভারের বলিয়ারপুরের চেকপোস্টটি পরিচালনা করবে ঢাকা জেলা পুলিশ। গাজীপুরের জয়দেবপুর চৌরাস্তা, মানিকগঞ্জ, মাওয়া ফেরিঘাট, কাঁচপুর ব্রিজসহ ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সুলতানা কামাল ব্রিজ এলাকায়ও চেকপোস্ট বসানো হচ্ছে। এছাড়া রেলস্টেশন ও লঞ্চ টার্মিনালেও চেকপোস্ট বসানো হবে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, চামড়া পাচারকারী ছাড়াও বাড়তি টাকার লোভে ভাল চামড়ার সঙ্গে নিম্নমানের চামড়া রফতানি করে থাকে কিছু কিছু অসাধু চামড়া ব্যবসায়ী। এসব ব্যবসায়ীদের ওপরও নজরদারি চালানো হচ্ছে। ঈদের পরেও তাদের ওপর নজরদারি চলবে। দেশের একজন শীর্ষ চামড়া ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছেন, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের আওতায় আনতে হয়। চামড়া সংগ্রহের পর তা থেকে চর্বি ও মাংস পরিষ্কার না করলে পচন ধরে। পরিষ্কার করার পর তাতে পরিমাণমত লবণ দিতে হয়। পর্যাপ্ত লবণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। অনেক লবণ ব্যবসায়ী চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম লবণ সঙ্কট সৃষ্টি করেন। আর এমন অজুহাতে সিন্ডিকেটের সদস্যরা সস্তা দামে চামড়া কিনে থাকে। লবণ না দিলে চামড়া পচে যায়। আর পরিমাণমত লবণ না দিলে চামড়া নিম্নমানের হয়ে পড়ে। এমন সুযোগটিকেই কাজে লাগায় চামড়া পাচারকারী ও অসাধু চামড়া ব্যবসায়ীরা। খুচরা ক্রেতারা চামড়াগুলো মাঝারি মানের ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে থাকেন। মাঝারি মানের ক্রেতাদের কাছ থেকে ইচ্ছে করেই পাচারকারীরা চামড়া কেনা বন্ধ রাখে। এতে করে দ্রুত চামড়ায় পচন ধরার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কারণ চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চামড়া পরিষ্কার করে উপযুক্ত প্রক্রিয়ায় লবণ দিতে না পারলে তা পচতে বাধ্য। ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে একপর্যায়ে সস্তায় চামড়া বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন ব্যবসায়ীরা। এই অসাধু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আবার পাচারকারীদের যোগসূত্র থাকে। অনেক সময় পাচারকারীদের সঙ্গে সিন্ডিকেট করেও অনেক চামড়া ব্যবসায়ী এ কাজ করে থাকেন। পাচারকারী সিন্ডিকেট অধিকাংশই প্রক্রিয়াজাত করা চামড়া কিনে থাকে। কারণ এসব চামড়া গুণগত মান খুবই ভাল। সিন্ডিকেটের সদস্যরা আবার নিম্নমানের চামড়াও কিনে থাকে। তারা ভাল চামড়ার আড়ালে নিম্নমানের চামড়া বিক্রি করে দেয়। শুধু পাচারের ক্ষেত্রে নয়, বৈধভাবে চামড়া রফতানির ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটে। এ কারণে বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য নিয়ে বিদেশী ক্রেতাদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাবও রয়েছে।
×