ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘ব্যাডমিন্টন আমার রক্তে মিশে গেছে’

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

‘ব্যাডমিন্টন আমার রক্তে মিশে গেছে’

শাটল আর র‌্যাকেট তার কাছে খেলনার মতোই প্রিয়। নিজের অধ্যবসয়ী জাদু দিয়ে পোষ মানিয়ে নিয়েছেন এ দুটি ‘অমূল্য’ জিনিসকে। অবাধ্য হওয়ার সাধ্য নেই। তাতেই তিনি ব্যাডমিন্টন কোর্টকে আপন করে ছন্দময়ী খেলা উপহার দিয়ে চলেছেন ক্রীড়াপ্রেমী দর্শকদের। যোগ্যতা গুণে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ, জুনিয়র, সামার র‌্যাঙ্কিং, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস টুর্নামেন্টে একের পর পর শিরোপা জিতে নিজের ঝুঁড়িতে ভরছেন। বিরল অর্জন ৬টি ত্রিমুকুট, ২৪টি জাতীয় স্বর্ণপদক। রেকর্ড, শিরোপা, ত্রিমুকুট হাতের মুঠোয় বন্দী করে অনন্য সাধারণ কৃতিত্ব ও নৈপুণ্য দেখিয়ে ‘ব্যাডমিন্টনের রাণী’ বনে গেছেন শাপলা আক্তার। নিজেকে অনেক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন ব্যাডমিন্টনের ‘ত্রিমুকুট কন্যা’। পাবনার চঞ্চলা মেয়েটির স্বপ্ন এখন আন্তর্জাতিক শিরোপা অর্জন। জাতীয় ব্যাডমিন্টন শেষে সম্প্রতি নিজের ক্যারিয়ার ও স্বপ্ন নিয়ে শাপলা আক্তার কথা বলেছেন এ প্রতিবেদকের সঙ্গে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে ২০০৬ সালে প্রথম অংশ নেন শাপলা। প্রথমবার অংশ নিয়েই সাফল্যের দেখা পান। দ্বৈতে চ্যাম্পিয়ন এবং একক ও মিশ্র-দ্বৈতে রানার্সআপ হয়ে চমক লাগিয়ে দেন। ২০০৭ সালে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের এককের শিরোপা দিয়ে তৃপ্তির জয়যাত্রা শুরু ব্যাডমিন্টন কন্যার। সে আসরে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সাবেক জাতীয় চ্যাম্পিয়ন কনিকা রানী। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি মিষ্টভাষী মেয়েটিকে। ২০০৭ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ১২ বছরে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ হয়েছে আটবার। তার মধ্যে ২০০৯, ২০১১, ২০১৩, ২০১৬ ও ২০১৮Ñ পাঁচবারই ত্রিমুকুট জিতেছেন তিনি। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ গেমসেও ত্রিমুকুট নিজের দখলে নিয়েছেন। ২০১০ ও ২০১৪ বাদে সবগুলো জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে এককে রয়েছে তার চ্যাম্পিয়ন ট্রফি। এ দুটি আসরে শুধু দ্বৈতে শিরোপা ও এককে রানার্সআপ শিরোপা জিতে সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাকে। এছাড়া ২০১০ ও ২০১৭ সাল বাদে সবগুলো সামার ও বিজয় দিবস র‌্যাঙ্কিং টুর্নামেন্টেও শ্রেষ্ঠত্ব অক্ষুণœ রাখেন তিনি। জাতীয় আসরে কখনও তিনি নীট কনসার্নের হয়ে, আবার কখনও নারায়ণগঞ্জ জেলা দলের হয়ে কোর্ট মাতিয়েছেন। নিজের কৃতিত্বে মুগ্ধ শাপলা নিজেই। ‘প্রত্যাশা ছিল, ভাল করব। এ জন্য কঠোর অনুশীলনও করেছি। তবে এত বড় অর্জন হবে ভাবিনি। সত্যিই আমি অভিভূত এ কৃতিত্ব অর্জনে। তাছাড়া নিজের শহরে অনুষ্ঠিত দুইটি জাতীয় আসরে অংশ নিয়ে দুটিতেই ত্রিমুকুট জিতেছি। খুব ভাল লাগছে।’ নিজের শহরে এটি শাপলার দ্বিতীয় ত্রিমুকুট। এর আগে ২০১১ সালে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে ত্রিমুকুট অর্জন করে সুনাম অর্জন করেন। এবারের অর্জনে পাবনাকে যেমন স্মরণীয় করে রাখলেন তেমনি পাবনাবাসীর কাছে বরণীয় হলেন। ‘নিজের এলাকায় চ্যাম্পিয়ন, তারপর ত্রিমুকুট। এটা নিশ্চয় বড় অর্জন। খুব ভাল লাগছে। আল্লাহকে অশেষ ধন্যবাদ এ অর্জনের জন্য।’ মুখে স্ফীত হাসি শাপলার। জাতীয় আসরের পাশাপাশি জুনিয়র আসরের কৃতিত্ব গড়েন শাপলা। ২০০৫ সালে অ-১৪ জাতীয় আসরে পাবনার হয়ে প্রথম অংশ নিয়েই এককে চ্যাম্পিয়ন এবং বোন শাকিলাকে নিয়ে জুটি বেঁধে দ্বৈতে রানার্সআপ হন। একই বছর ও পরের বছরে অ-১৮ চ্যাম্পিয়নশিপের এককে চ্যাম্পিয়ন হন কম বয়সী শাটলার। ২০০৭-এ অ-১৯ আসরে একক ও দ্বৈতে চ্যাম্পিয়ন শিরোপা ঘরে তোলেন। সামার র‌্যাঙ্কিং, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস সাফল্যের স্বর্ণশিখরে আরোহণ করা শাপলার রক্তে মিশে গেছে ব্যাডমিন্টন। তাই এখন তার ভাবনা শুধু ব্যাডমিন্টন নিয়েই। তার বিচরণ, অর্জন ও কথোপকথনে তারই প্রকাশ, ‘ব্যাডমিন্টন আমার রক্তে মিশে গেছে। সবসময় শুধু কোর্ট, শাটল আর র‌্যাকেট নিয়েই ভাবি। ব্যাডমিন্টনই এখন আমার ধ্যান-জ্ঞান।’ সম্প্রতি শাপলার নিজের শহর পাবনায় অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়নশিপের ৩৫তম আসর। ২৭-৩১ জানুয়ারি ফি.ম. সামছুল আরেফিন জিমনেসিয়াম হলে বসে এ পসরা। আসরে বাংলাদেশ আনসারের হয়ে অংশ নিয়ে স্মরণীয় ত্রিমুকুটের তকমা পরেন শাপলা। মহিলা একক, দ্বৈত ও মিশ্র দ্বৈতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন কৃতী শাটলার। এককে সেনাবাহিনীর এলিনা সুলতানাকে সরাসরি ২-০ সেটে , দ্বৈতে দুলালী হালদারকে নিয়ে এলিনা-নাবিলা জামান জুটিকে ২-১ সেটে এবং মিশ্র দ্বৈতে রাহাদ কবির খালেদের সঙ্গে জুটি বেঁধে একই দলের আহসান হাবীব পরশ-দুলালীকে ২-০ সেটে হারিয়ে তিনটি শিরোপাই নিজের দখলে নেন। গত আসরে সেনাবাহিনীর এলিনা সুলতানাকে হারিয়ে ত্রিমুকুট নিশ্চিত করেছিলেন এ তারকা শাটলার। এবার পরাজিত করেন সরাসরি ২-০ (২১-১৫, ২১-১২) সেটে। এ নিয়ে ক্যারিয়ারে ৫টি জাতীয় আসর ও একটি বাংলাদেশ গেমসসহ ৬ বার ত্রিমুকুট জয়ের বিরল কৃতিত্ব দেখান তিনি। নিজের কৃতিত্বের পাশাপাশি প্রথমবার বাংলাদেশ আনসারের হয়ে দলগত চ্যাম্পিয়নও করেছেন দলকে। মোট ৫টি ইভেন্টের মধ্যে চারটিতে চ্যাম্পিয়ন ও তিনটিতে রানার্সআপ হয়ে আসরে দলগত চ্যাম্পিয়ন হয় আনসার। দলীয় চ্যাম্পিয়ন হয়ে খুশি শাপলাও, ‘আমার খুব ভাল লাগছে, দলকে চ্যাম্পিয়ন করতে পেরেছি।’ দুটিতে রানার্সআপ হয়ে দলগত রানার্সআপ হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। পুরুষ এককে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থার সালমান। পাবনা শহরের কৃষ্ণপুর মহল্লা অতীত ঐতিহ্যে ভরপুর। ঐতিহ্যবাহী পাবনার এ মহল্লার সুনাম ও দুর্নাম দুটিই আছে। এখানেই জন্ম শাপলা আক্তারের। প্রাথমিকের পাঠ চুকিয়েছেন পাশের কৃষ্ণপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এখানকার ধুলি-বালি মেখে বড় হওয়া জাতীয় তারকা শাটলার নিজের বিরল কৃতিত্ব দিয়ে এ মহল্লার সুনাম বাড়িয়েছেন বহুগুণে। সেই সঙ্গে গর্বিত করেছেন পাবনাবাসীকে। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ইছামতি নদী। নদীর উত্তাল যৌবন দেখার সৌভাগ্য হয়নি তার। কিন্তু ২৫ বছর বয়সী নিজের ক্যারিয়ারের যৌবন দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন দেশের মানুষকে। একক সময়ে জাতীয় তারকা ডানা, মরিয়ম, কনিকা, এলিনা বেগম, দুলালীরা কোর্ট মাতিয়েছেন। আর এখন কোর্টে একচ্ছত্র আধিপত্য শাপলার। চাচি হোসনে আরার হাত ধরে ব্যাডমিন্টনে আসেন শাপলা, ‘আমার চাচির মাধ্যমে আমি খেলাধুলায় আসি। চাচি পাবনা সেন্ট্রাল গার্লস হাইস্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক ছিলেন। সে সুবাদে আমি ওই স্কুলেই পড়েছি। ২০০৩ সালে তিনি আমাকে শহরে একটি টুর্নামেন্ট খেলতে বলেন। তার কয়েকদিন পর জেলা ক্রীড়া সংস্থার প্রশিক্ষণ কর্মশালায় পাঠান।’ এরপর নাকি শখের বশে অন্যের দেখাদেখি তার ব্যাডমিন্টনে এগিয়ে চলা, ‘অনেকটা সখের বশেই ব্যাডমিন্টনের প্রতি আমার ভাললাগা ভালবাসা শুরু হয়ে যায়। যতদিন পাবনায় ছিলাম, কোচ খুরশিদ আলম স্যারের কাছে আমার ব্যাডমিন্টন শেখা।’ পাঁচ বোনের মধ্যে সবার ছোট শাপলা। বাবা আব্দুস সালাম মুদি দোকানদার, এখন বয়সে ভারাক্রান্ত। একমাত্র প্রবাসী ভাই সংসারের হাল ধরেছেন। মা-বাবাসহ পুরো পরিবারই তাকে খেলাধুলায় উৎসাহ দিয়েছেন। বোনকে নিয়ে জাতীয় জুনিয়রে অংশ নিয়েছেন। স্মৃতি হাতড়ান তিনি, ‘শহীদ এ্যাডভোকেট আমিন উদ্দিন স্টেডিয়াম থেকে মাত্র ১০ মিনিট হাঁটলেই আমাদের বাড়ি। আমার ভাই-বোন সবাই আমাকে উৎসাহ দিতেন। যে কারণে আমার এতদূরে আসা। ২০০৫ সালে অ-১৪ জাতীয় আসরে আমার বোন শাকিলা আক্তার সাবার সঙ্গে জুটি বেঁধে রানার্সআপ হয়েছিলাম। পরে অবশ্য বোন আর খেলেননি।’ জীবনে এত অর্জন। অথচ একসময় খেলাই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন, ‘২০১০-এ জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে এলিনার কাছে এককের ফাইনালে হেরে যাই। তখন মন অনেক খারাপ হয়ে যায়। খেলাই বাদ দিতে চেয়েছিলাম। কোচ রাজু ভাইয়ের অণুপ্রেরণায় আবার র‌্যাকেট হাতে কোর্টে নামি।’ পাবনার মেয়ে গত মার্চে সেই কোচ নারায়ণগঞ্জের অহিদুজ্জামান রাজুকে জীবন সঙ্গীনি হিসেবে বেছে নিয়েছেন গত বছর। তারই অণুপ্রেরণা ও সহযোগিতায় সংসারের পাশাপাশি নৈপুণ্য ধরে রাখার আপ্রাণ সংগ্রাম চলছে। বিয়ের পরও সবার সহযোগিতায় নিজের দ্যুতি ছড়িয়ে যাচ্ছেন শাপলা আক্তার। এ জন্য সর্বশেষ ত্রিমুকুটটি উৎসর্গ করেছেন তার স্বামীসহ শ্বশুরবাড়ির সবাইকে। পেছনের সুখ-স্মৃতি নিয়ে আরও অনেক দূরে দৃষ্টি মিষ্টভাষী শাপলা আক্তারের। তার প্রিয় খেলোয়াড় ইন্দোনেশিয়ার শাটলার তৌফিক হেদায়েত। তার খেলা ভাল লাগে। মালয়েশিয়া ও ভারতে সরাসরি তার খেলাও দেখেছেন বলে জানান তিনি। শাপলার স্বপ্ন দেশের শিরোপা জয়ের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ট্রফি জেতা, ‘আমার স্বপ্ন আন্তর্জাতিক শিরোপা জেতা। দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনা।’
×