ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাহসী পূর্ণিমাকে পার্সোনাল অফিসার হিসেবে বেছে নিলেন তারানা হালিম

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১৮ জানুয়ারি ২০১৮

সাহসী পূর্ণিমাকে পার্সোনাল অফিসার হিসেবে বেছে নিলেন তারানা হালিম

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার শিকার হন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার পূর্ণিমা রানী শীল। তখন পূর্ণিমা ছিলেন ১৪ বছরের কিশোরী। ২০০১ সালে বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে ১৪ বছর বয়সে গণধর্ষণের শিকার পূর্ণিমা শীলের খবর বাংলাদেশে শিরোনাম হয়েছিল। পূর্ণিমা রানীর ওপর অত্যাচার নিয়ে সে সময় গণমাধ্যমগুলোতে একের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। তার বয়স এখন প্রায় ৩২ বছর। বিগত ১৭ বছর পর আবারও পত্রিকার শিরোনামে এলো তার নাম। পূর্ণিমা চাকরি পেয়েছেন। পূর্ণিমাকে ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। বুধবার নিজের ফেসবুক পাতায় এক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে এ তথ্য জানান সম্প্রতি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে তথ্যে বদলি হওয়া তারানা হালিম। তারানা আশা করছেন, অন্ধকার জগত থেকে আসা পূর্ণিমা এখন আলোর জগতে নতুন পথচলা শুরু করবেন। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটের জয়ের পর দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংখ্যালঘু এবং আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর ব্যাপক হামলা হয়। এর মধ্যে তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম তাকে ভুলে যাননি, বরঞ্চ তাকে মনে রেখে নিজের পার্সোনাল অফিসার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। তারানা হালিম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেয়া স্ট্যাটাসে বলেন, ‘মনে পড়ে সেই পূর্ণিমাকে? ২০০১ এর ১ অক্টোবর নির্বাচন-পরবর্তী বিএনপি-জামাতের পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল ১৪ বছরের মেয়েটি। হ্যাঁ, আমি সিরাজগঞ্জের সেই পূর্ণিমা শীলের কথা বলছি। আজ আমি গর্বিত আমি পূর্ণিমাকে আমার ‘পার্সোনাল অফিসার’ হিসেবে নিয়োগ দিলাম। পূর্ণিমা, তোমাকে আমরা ভুলে যাইনি। জীবনের অন্ধকার রূপ তুমি দেখেছ, আলোর জগতে তোমায় স্বাগতম। শুরু হোক নতুন পথচলা। তোমাকে অভিবাদন প্রিয় পূর্ণিমা।’ স্ট্যাটাসের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারানা হালিমকে জড়িয়ে ধরে আছেন পূর্ণিমা এমন ছবিও দেয়া হয়েছে। তারানা হালিমের পার্সোনাল অফিসার নিয়োগ পেয়ে খুশির জোয়ারে ভাসছেন পূর্নিমা ও তার পরিবার। তিনি প্রধানমন্ত্রী ও তারানা হালিমের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, ‘২০০১ সালের পর থেকে নিজের জীবনের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করেছি। নিজ পায়ে দাঁড়ানোর শক্তি যুগিয়েছি সবসময়। পড়ালেখা শিখেছি, আবারও বাঁচার স্বপ্ন দেখেছি। আমার দ্বিতীয়বারের মতো জীবন প্রদান করেছেন বাংলাদেশের জননেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তারানা হালিম ম্যাডাম আমাকে তার পার্সোনাল অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেবেন তা আমি কখনও স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। তার প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা ও ভালবাসা। তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছেন। আজ থেকে আমার অফিস শুরু। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন।’ পূর্ণিমা শীল জনকণ্ঠকে আরও বলেন, ‘আমি ভবিষ্যতে অসহায় ও পিছিয়ে পড়া নারীদের সহায়তা করতে চাই। নারীবাদী হিসেবে সমাজের জন্য কাজ করব। আমি চাইনা আমার মতো একটি মেয়েকে ভয়াবহ বর্বরতার সম্মুখীন হতে না হয়। সমাজের সকল নারীর জন্য সফল দৃষ্টান্ত হয়ে নিজেকে উপস্থাপন করব। আসলে কোন বাধা নারীকে দমিয়ে দিতে পারে না।’ বর্তমানে পূর্ণিমা শীল গানের শিক্ষকতা করেন। পাশাপাশি গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসেবেও কাজ করছেন বলে জনকণ্ঠকে জানান। এত কিছুর পরও দৃঢ় মনোবল আর নিজের প্রতি অবিচল আত্মবিশ্বাস সব বাধা ডিঙিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন নির্যাতিত পূর্ণিমা। ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বিজয়ী হওয়ার পর অমানিশার অন্ধকার নেমে এসেছিল তার জীবন ও পরিবারের ওপর। সে সময়ে তার পাশে এগিয়ে যান ওয়াহিদুল হক ও শাহরিয়ার কবির। শাহরিয়ার কবির তাকে নিয়ে এসে সাংবাদিক সম্মেলন করেন এবং তার পড়াশোনাসহ অন্যান্য ভার নেন ওয়াহিদুল হক। এরপর তার পথ চলায় স্বাধীনতার সপক্ষের অনেকেই নীরবে সহায়তা করেছেন। সেই পূর্ণিমা প্রত্যন্ত গ্রামের পিছিয়ে থাকা বড় পরিবারটিকে একাকী ধীরে ধীরে টেনে তুলছেন। নিজে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেছেন। ভাইবোনদেরও শিখিয়েছেন লেখাপড়া। মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে তাদের। শত প্রতিবন্ধকতার মধ্যে ঘুরে দাঁড়ানো এই মেয়েটি ১৭ বছর ধরে বয়ে বেড়াচ্ছেন যন্ত্রণার জ্বালাও। তবে সাহসী পূর্ণিমা বলেন, ‘লজ্জা আমি পাব কেন? এই লজ্জা সমাজের, রাষ্ট্রের।’ ২০১৬ সালে শারমিন ফিল্মের পর্দায় নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া লোমহর্ষক ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনায় ক্যামারার সামনে বলেন সাহসী নারী পূর্ণিমা শীল। দশম শ্রেণীতে পড়া পূর্ণিমাকে ধর্ষণ করতে এসেছিল ১০-১২ জনের একটি দল। এতোটুকু মেয়েটা এতজনের অত্যাচার সহ্য করতে পারবে না দেখে পূর্ণিমার মা কান্না করতে করতে বলেছিলেন, ‘বাবা’রা আমার মেয়েটা ছোট্ট মরে যাবে। তোমরা একজন একজন করে আস।’ যা ঘটেছিল সেদিন ॥ পূর্ণিমা সে সময় উল্লাপাড়া হামিদা পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী। বয়স ১৪ বছর। ভোটের দিন সিরাজগঞ্জ-৪ (উল্লাপাড়া) আসনে আওয়াামী লীগ মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থী প্রয়াত আব্দুল লতিফ মির্জা পূর্বদেলুয়া উচ্চ বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে তার দলের মহিলা এজেন্ট নিয়োগ দিয়েছিলেন পূর্ণিমাকে। বিএনপি প্রার্থী এম আকবর আলীর কর্মী ও সমর্থকরা ভোট চলাকালে জোর করে কেন্দ্রে ঢুকে ব্যালট পেপার নিয়ে ধানের শীষে সিল দেয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় প্রতিবাদ করেন এই সাহসী মেয়ে। বিষয়টি উপজেলা নির্বাচন অফিস ও প্রশাসনকে অবহিত করেন তিনি। এটাই ছিল পূর্ণিমার অপরাধ। ওই নির্বাচনে হেরে যান আওয়ামী লীগ প্রার্থী আব্দুল লতিফ মির্জা। নির্বাচনের এক সপ্তাহ পর ৮ অক্টোবর বিএনপি জোটের নেতা ও সমর্থক মিলে দেড়শতাধিক মানুষ লাঠিসোটা নিয়ে সন্ধ্যার পর আকস্মিক হামলা চালায় পূর্ণিমাদের বাড়িতে। ১৫-২০ যুবক বাড়ি থেকে পূর্ণিমাকে জোর করে তুলে পাশের মাঠে নিয়ে যায়। এখানে তার ওপর চালানো হয় নিষ্ঠুর নির্যাতন। আক্রমণকারীরা পূর্ণিমার বাবা, মা, ভাইবোনদের বেধড়ক পেটায়। পূর্ণিমার মায়ের ডান হাত ভেঙ্গে যায়। গুরুতর আহত হন তার বাবা অনিল শীল, মেঝো বোন গীতা রানী শীল, ভাই গোপাল চন্দ্র শীল ও অর্জুন শীল। সন্ত্রাসীরা লুটপাট চালায় তাদের বাড়িতে। ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়া হয় তাদের বাড়ি। পূর্ণিমা শীল জানান, ওই সময় উল্লাপাড়ায় কর্মরত উপ-পরিদর্শক মোঃ ইকবাল মাঠ থেকে তাকে উদ্ধার করেন। পরে মুক্তিযোদ্ধা খোরশেদ আলম তাকে কোলে করে নিয়ে বাড়ির পাশের রাস্তায় ভ্যানে তোলেন। উল্লাপাড়া থানায় মামলা দেয়ার ব্যাপারে আব্দুল লতিফ মির্জার সঙ্গে সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শফি, সিরাজগঞ্জের সাংবাদিক আমিনুল ইসলাম চৌধুরী, উল্লাপাড়া হিন্দু ধর্মীয় নেতা গৌতম কুমার দত্তসহ অনেকেই তাদের সাহায্য করেন। আমিনুল ইসলাম চৌধুরী উল্লাপাড়া ২০ শয্যা হাসপাতাল থেকে ডাক্তারী পরীক্ষার জন্য তাকে সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। পূর্ণিমা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ওই সময় পূর্ণিমার বাবা অনিল চন্দ্র শীল বাদী হয়ে উল্লাপাড়া থানায় ১০ অক্টোবর মোট ১৬ জনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও লুটপাটের মামলা দায়ের করেন। পূর্ণিমা তার অতীত ও বর্তমান কাহিনীর বিবরণ দিতে গিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী তার পরিবারের চরম দুর্দিন ও অসহায় অবস্থায় তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী উল্লাপাড়ার আদর্শগ্রামে তাদের বসবাসের জন্য পাঁচ শতক জমি দিয়েছেন। ঘর তুলে দিয়েছেন। তাকে একটি বেসরকারী কোম্পানিতে চাকরি দিয়েছেন। তার ভাই গোপাল চন্দ্র শীলকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। লেখাপড়া করার সুযোগ করে দিয়েছেন পূর্ণিমার। তিনি প্রধানমন্ত্রীর এ অবদানের কথা কোনদিন ভুলবেন না। পূর্ণিমা বলেন, জোট সরকারের সময় তার বাবার করা মামলা নিয়ে পুলিশ টালবাহানা শুরু করেছিল। ফলে ২০০১ সালেরই ২৪ অক্টোবর পূর্ণিমা রানী শীল ১৬ জনকে আসামি করে সিরাজগঞ্জ জেলা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে আবারও মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় পুলিশ ২০০২ সালের ৯ মে ১৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দায়ের করে। পরে আদালত ওই অভিযোগপত্র আমলে না নিয়ে আবারও চার্জশীট দেয়ার নির্দেশ দেন। এই নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ দ্বিতীয় দফায় ১১ জনকে শাস্তি দেয়। যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদ- প্রদান করে। একই সঙ্গে প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়। তবে দেরিতে হলেও পূর্ণিমা তার সঠিক বিচার পেয়েছেন। দীর্ঘ ১০ বছর পর ২০১০ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের নির্যাতনের শিকার দেশব্যাপী বহুল আলোচিত পূর্ণিমা রানী ধর্ষণ মামলার রায় হয়। সিরাজগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক ওসমান হায়দার এই মামলার রায় প্রদান করেন।
×