ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ু দূষণে বছরে ক্ষতি ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা

প্রকাশিত: ০১:৪১, ১০ ডিসেম্বর ২০১৭

বায়ু দূষণে বছরে ক্ষতি ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ক্রমবর্ধমান ও অপরিকল্পিত নগরায়নের কারনে ঢাকাসহ অন্যান্য শহর গুরুতর বায়ু ও পানি দূষণের সম্মুখীন হচ্ছে। প্রতিবছর দেশ এক শতাংশ জিডিপি হারাচ্ছে কেবল বায়ু দূষণের কারণে। দেশের জিডিপির আকার বর্তমানে প্রায় ২৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ হিসেবে বায়ু দূষণের কারণে ক্ষতির পরিমাণ গড়ে আড়াই বিলয়ন বা ২৫০ কোটি ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হতে হলে বাংলাদেশকে পানি, বাতাসসহ সব ধরনের পরিবেশগত অবনতি রোধে ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিবেশ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ‘কান্ট্রি এনভায়রনমেন্ট এসেসম্যান্ট ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক কর্মশালায় এ তথ্য ও পরামর্শ দেয়া হয়েছে। রবিবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে বিশ্বব্যাংক এ কর্মশালার আয়োজন করে। পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। কর্মশালায় বিশ্বব্যাংক পরিচালিত ‘বাংলাদেশ : আনলকিং অপরচুনিটিস ফর ক্লিন এন্ড রেজিলিয়েন্ট গ্রোথ (সিইএ) শীর্ষক খসড়া প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনের প্রাথমিক ফলাফলে বলা হয়েছে, কেবল বায়ু দূষণের কারণে প্রতিবছর দেশ এক শতাংশ জিডিপি হারাচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা শিল্প এবং দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শহরগুলোর বাতাসের পাশাপাশি ভূ-উপরিস্থ এবং ভূগর্ভস্থ পানিও দূষিত করছে। রাজধানীর দরিদ্র এলাকাগুলোতে থাকা ডায়িং এবং ফিনিশিং ফ্যাক্টরিগুলোর বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। এসব ফ্যাক্টরি পোশাক তৈরিতে ব্যবহৃত প্রতি এক টন ফ্যাব্রিকের জন্য ২০০ মেট্রিক টন বিষাক্ত পানীয় বর্জ্য উৎপন্ন করে, যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। খসড়া প্রতিবেদনটি মূলত চারটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেছে। এগুলো হলো-পরিবেশগত অবনতির আর্থিক মূল্য, শহুরে জলাভূমি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি এবং পরিবেশ বিষয়ক প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা উন্নয়ন। প্রতিবেদনটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘমেয়াদী টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে বাংলাদেশের নগরয়ান এবং শিল্পায়ন প্রক্রিয়া পরিবেশগতভাবে টেকসই হওয়া প্রয়োজন। বলা হয়েছে, পরিবেশ নীতি বাস্তবায়ন করতে সরকারকে অবশ্যই এ সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান ও নিয়ন্ত্রক কাঠামো শক্তিশালী করতে হবে। এছাড়া সবুজ ও পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তি গ্রহণের জন্য শিল্প-কারখানাগুলোকে প্রণোদনা দেয়ার নীতি এবং দূষণকারীর কাছ থেকে জরিমানা আদায়ের নীতি কঠোরভাবে প্রয়োগ করা উচিত। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে সৃষ্ট দূষণ পরিস্থিতি বড় এবং ছোট শহরের বাসিন্দাদের ঝুঁকির মুখে ফেলছে। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, বর্তমানে ঢাকার আশপাশের ৬ লাখ বাসিন্দা, বিশেষ করে শিশুরা তীব্র দূষণের শিকার; যা তাদের আইকিউ লস এবং ¯œায়ুবিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। আবার ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে শহরগুলো জলাবদ্ধাতার সমস্যায় ভুগছে। পানি নিষ্কাশনের ক্ষেত্রে জলাভূমিগুলোর অকার্যকারিতা এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে বেশিরভাগ শহর বন্যার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে পাবনার কথা। ১৯৯০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত কেবল পাবনায় অর্ধেক জলাভূমি হারিয়ে গেছে। বর্তমানে পাবনায় জলাবদ্ধতার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। শহরগুলির স্থিতিস্থাপকতা উন্নয়নে সরকারকে নগর পরিকল্পনায় জলাভূমি অন্তর্ভুক্ত করা, বিশেষ জোনের প্রবর্তন করা এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শিল্প দূষণ আরও বাড়বে। কারণ কিছু শিল্প বেল্টে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এরইমধ্যে বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষির উৎপাদনশীলতা কমে যাবে, অপুষ্টি বৃদ্ধি পাবে এবং অনেক এলাকায় পানি সরবরাহ হ্রাস পাবে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির ফলে পরিবেশ দুষণও বাড়ছে। পরিবেশ বিষয়ে এখনো সচেতনতার অভাব রয়েছে। শিক্ষার হার আরও বাড়লে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জাতীয় মাথাপিছু আয় বাড়লে মানুষ পরিবেশ সম্পর্কে আরও সচেতন হবে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে জাতীয় পরিবেশ কমিটি আছে। আমার মন্ত্রণালয় এটি কো-অর্ডিনেট করে। সেখানে সব মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে আলোচনা হয়, সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু মিটিং থেকে বের হওয়ার পর অন্যদের কাছে পরিবেশ গুরুত্ব হারায়। তিনি বলেন, দেশজুড়ে ৫০ শতাংশ পুকুর এবং ৭০ শতাংশ খাল বর্তমানে হারিয়ে গেছে কিংবা সংস্কারহীন অবস্থায় আছে। অথচ এসব পুকুর ও খাল সংস্কারে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের খাল গুলো দূষিত হয়ে পড়ছে। উপজেলা পর্যায়ে উন্নয়নের জন্য গঠিত কমিটি স্থানীয় এমপিদের কথার বাইরে যেতে পারেন না। তিনি বলেন, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ও পুকুর খনন, খাল খনন কর্মসূচি নেন। অন্যদিকে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় তারাও খাল খনন করেন। কিন্তু বাস্তবে খাল বা পুকুরে এর কোন প্রতিফলন নেই। মন্ত্রীর মতে, মূলত স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দুর্নীতির জন্যই এসব কাজ হয় না। তিনি আরও বলেন, উপজেলা ভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা করা হলে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো শহরের ওপর চাম কমবে। এজন্য কেন্দ্রীয় সরকারের আকার ছোট হওয়া উচিত। সর্বত্র সরকারের উপস্থিতি কাজে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি করে। বিশেষ অতিথি বিশ্বব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর জাহিদ হোসেন বলেন, পরিবেশের বিনিময়ে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলে তা টেকসই হয় না। তবে ভালো খবর হলো গবেষণার ফলাফল বলছে, দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য পরিবেশদূষণ কাম্য হতে পারে না। পরিবেশসম্মত উপায়েও দ্রুত প্রবৃদ্ধি বাড়ানো সম্ভব। কেবল শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার অজুহাতে বাংলাদেশ পরিবেশ ইস্যু উপেক্ষা করতে পারে না। পরিবেশগত অবনতি রোধ এবং জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশকে এখনই পরিকল্পনা নিতে হবে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করতে হবে। পরিবশে সচিব ইশতিায়ক আহমেদ বলেন, আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হতে চাই। তাই শিল্পায়ন বন্ধ করা যাবে না। তবে পরিবেশ সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জগুলো বিষয়ে আমরা সতর্ক আছি। সরকার বর্তমানে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনে কাজ করছে। এসডিজির সঙ্গে পরিবেশ সুরক্ষা অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন কমিটি জাতীয় পরিবেশ নীতি অনুমোদন দিয়েছে। শীঘ্রই এটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রীসভায় উঠবে। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রইসুল ইসলাম মন্ডল, বাংলাদেশের বিশ্বব্যাংকের প্রোগ্রাম লিডার সঞ্জয় শ্রীবাস্তব, বিশ্বব্যাংকের প্র্যাকটিস ম্যানেজার ফর এনভায়রনমেন্ট কেসনিয়া লিভস্কি প্রমুখ।
×