ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

অন্তিম শয়নে সঙ্গীতশিল্পী বারি সিদ্দিকী

প্রকাশিত: ০১:৩৩, ২৪ নভেম্বর ২০১৭

অন্তিম শয়নে সঙ্গীতশিল্পী বারি সিদ্দিকী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ‘তুমি আমি জনম ভরা ছিলাম মাখামাখি আজ কেন হইলে নীরব মেল দুটি আঁখি, শুয়াচান পাখি আমি ডাকিত্যছি তুমি ঘুমাইছ নাকি’ দরদভরা এ গানে আর কারো হৃদয় স্পর্শ করবে না। আর আঁখি মেলবেন না তিনি। স্তব্ধ হয়ে গেল তার সুর। চিরকালের ঘুমের জগতে চলে গেলেন মরমী সঙ্গীতশিল্পী বারি সিদ্দিকী। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত দুইটার দিকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন শিল্পী বারি সিদ্দিকী (ইন্নালিল্লাাহি... রাজেউন)। তার বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে সঙ্গীতাঙ্গনসহ ভক্তদের মধ্যে। বারী সিদ্দিকীর আত্মার মাগফেরাত কামনা করে শোকার্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যত দিন লোকসঙ্গীত থাকবে, তত দিন বারী সিদ্দিকী বেঁচে থাকবেন। গভীর শোক প্রকাশ করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে শুক্রবার সকালে বারী সিদ্দিকীর প্রথম নামাজে জানাজা হয়। এরপর তার মরদেহ ৩২ বছরের কর্মস্থল বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। দুটি জানাজায় অংশ নেওয়া শিল্পী ও কলাকুশলীদের মধ্যে ছিলেন ফকির আলমগীর, নকিব খান, শহীদুল্লাহ ফরায়েজী, রবি চৌধুরী, মানাম আহমেদ, নোলক বাবু, পল্লব স্যান্নাল, জালাল আহমেদ প্রমুখ। এরপর নেত্রকোনা সরকারি কলেজ মাঠে বাদ আসর তৃতীয় নামাজে জানাজা শেষে তাকে তার নিজের ‘বাউলবাড়ি’-তে দাফন করা হয়। বারী সিদ্দিকীকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লা। তিনি বলেন, বারী সিদ্দিকীর হঠাৎ এভাবে চলে যাওয়া আমাদের মিউজিক ইন্ডাষ্ট্রির জন্য খুব ক্ষতি হয়েগেলো। তার ইউনিক একটি ভয়েজ ছিলো। গাওয়ার স্টাইলওটাও ছিলো ভিন্নরকম। তার গেয়ে যাওয়া গানগুলোর মধ্যেই তিনি আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন। শিল্পী ফরিদা পারভীন বলেন, দেশে অনেক ডাক্তার আছেন, ইঞ্জিনিয়ার আছেন, শিল্পপতি আছেন, কিন্তু বারী সিদ্দিকী দেশে একজনই আছেন। সেই বারী সিদ্দিকী শেষ পর্যন্ত চলে গেলেন। এটা অবশ্যই আমাদের জন্য অনেক কষ্টের, বেদনার। ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে বারী সিদ্দিকী একজনই। আমাদের সবাইকেই যেতে হবে। আর এ জন্য মানসিকভাবে আমাদের সবাইকেই প্রস্তুত থাকতে হবে। গীতিকবি শহীদুল্লাহ ফরায়েজী বলেন, বারী ভাই আমাদের অনুভুতিকে ঋণী করে গেছেন, আমাদের হৃদয়কে ঋণী করে গেছেন। আমাদের অনুভূতি যতোদিন থাকবে, আমাদের হদয় যতোদিন থাকবে বারী ভাই ততোদিন আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন। বারী ভাই আমার লেখা অসংখ্য গান গেয়েছেন। বারী ভাই আমার পরিবারেরই একজন। তার চলেও যাওয়া আমার মেনে নেওয়া অনেক কষ্টের, যন্ত্রনার। সঙ্গীতশিল্পী সামিনা চৌধুরী বলেন, বারী ভাই সত্যিকারের একজন ভালো মানুষ ছিলেন। এমন অসাধারন কন্ঠ আর আসবেনা। তার প্রতিটি গানই একেকটি অনবদ্য সৃষ্টি। কণ্ঠশিল্পী আইয়ূব বাচ্চু বলেন, বারী চলে গেছেন, সম্পদ হারানোর মিছিলে বাংলাদেশ বিশাল এক সম্পদকে হারালো। বারী ভাইয়ের মৃত্যুতে যে অপূরণীয় ক্ষতি হলো তা আর কোনকিছু দিয়েই পূরণ হবার নয়। তার বাঁশি তার কন্ঠ দুই মিলিয়েই তিনি নিজেকে বারী সিদ্দিকী হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। কয়েক জনমেও আর এই দেশে একজন বারী সিদ্দিকীর জন্ম হবে না। সঙ্গীতশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ বলেন, সত্যিই বড় অসময়ে চলে গেলেন বারী ভাই। তারবারী খুব বেশি যে বয়স হয়েছিলো তেমন নয়। আরো বিশটি বছর অনায়াসে তিনি এদেশের সংষ্কৃতির জন্য কাজ করে যেতে পারতেন। কিন্তু পারলেন না। তার পরিপূরক এই বাংলায় আর কেউ হবে না কোনদিন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিলো বারী ভাইয়ের সুরে তিনটি গান গাইবার। আবার আমার সুরে ‘ঢাকা ড্রিম’ চলচ্চিত্রে তিনি প্লে-ব্যাক করেছেন। এটি আগামী বছর শ্রোতারা শুনতে পাবেন। সত্যি বলতে কী বারী ভাই বাউলিয়ানা ছিলেন কিন্তু শেষ সময় ‘সেরা কণ্ঠ’তে ফোক গানের বিশেষ পর্বে যখন রাত আটটা থেকে ভোর চারটা পর্যন্ত সময় কাটালাম তখন তারমধ্যে সংসার, সন্তান নিয়ে খুব দুঃশ্চিন্তা দেখেছি। শিল্পী এ্যন্ড্রু কিশোর বলেন, চলমান ফোক সঙ্গীতে এক অন্যরকম ধারার সৃষ্টি করেছিলেন বারী ভাই। তার গায়কী, তার বাঁশি সবাইকে মুগ্ধ করতো। এই অসময়ে চলে যাওয়াটা আসলে মেনে নেবার মতো নয়। ভীষণ খালাপ লাগছে বারী ভাইয়ের জন্য এই ভেবে যে তিনি যদি তার শরীরের প্রতি আরেকটু যতœবান হতেন তাহলে আমরা তাকে আরো বহুবছর পেতাম গানের ভুবনে। সঙ্গীতশিল্পী ঐশী বলেন, বারী স্যার চলে গেছেন, এটা বিশ্বাস করতেই আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমি তার গান শুধু শুনতামই না মন দিয়ে অনুভব করতাম এবং এটা সত্য যে স্টেজ শো’তে বা টিভিতে কোন শো’তে আমি তার গান দিয়েই শুরু করতাম। গত কয়েকদিন ধরেই তিনি স্কয়ার হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। বারী সিদ্দিকীর দুটি কিডনি অকার্যকর হয়ে পড়েছিলো। পাশাপাশি তিনি বহুমূত্র রোগেও ভুগছিলেন। গত ১৭ নভেম্বর রাতে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। অচেতন অবস্থাতেই তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। এরপর তাকে দ্রুত নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছিলো। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত আড়াইটায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে, এক মেয়ে ও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। বারী সিদ্দিকী ছিলেন বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত বংশীবাদক। সেইসাথে তিনি ভাব ও মরমী ধারার এক অন্যরকম গায়কও বটে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের সঙ্গীত পরিচালক এবং একজন মুখ্য বাদ্যযন্ত্র শিল্পী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। নেত্রকোনায় ১৯৫৪ সালের ১৫ নভেম্বর বারী সিদ্দিকীর জন্ম। তার বাবা প্রয়াত মহরম আলী ও মা প্রয়াত জহুর-উন-নিসা। কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের এক জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তার বাসায় যান বাঁশি বাজাতে। সেখানে বাঁশি বাজানোর পাশাপাশি গানও করেন তিনি। গান শুনে মুগ্ধ হন হুমায়ূন আহমেদ। ১৯৯৫ সালে বিটিভির ‘রং-এর বারৈ’ অনুষ্ঠানে প্রথম গান করেন বারী সিদ্দিকী। এর পরপরই হুমায়ূন আহমেদ তাকে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে গান গাইতে বলেন। এই চলচ্চিত্রে ছয়টি গান করেন তিনি, যার প্রতিটিই বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৮০ সালে বারী সিদ্দিকী পেশাগতভাবে বাঁশি বাজানো শুরু করেন। ১৯৮৬ সালে প্রথম বিটিভিতে ‘সৃজন’ অনুষ্ঠানে বাঁশি বাজান। বারী সিদ্দিকী ‘মাটির পিঞ্জিরা’ নামের একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ফেরারী অমিতের নির্দেশনায় ‘পাগলা ঘোড়া’ নাটকেও অভিনয় করেছিলেন। তবে অভিনয় করতেন নিতান্তই অনুরোধে এবং শখের বশে।
×