ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এ্যামনেস্টি রিপোর্ট

মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী

প্রকাশিত: ০৬:০১, ১৯ অক্টোবর ২০১৭

মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধনের দায়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ করেছে লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। বুধবার বিস্তারিত এক প্রতিবেদনে সংস্থাটি জানিয়েছে, সেনাবাহিনীর রক্তক্ষয়ী অভিযানের মুখে পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। তাদের মধ্যে ১২০ নারী ও পুরুষের সাক্ষ্য নেয়ার পর সংস্থাটি এই অভিযোগ জানায়। খবর গার্ডিয়ান অনলাইনের। ‘আমাদের পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেছে’ শিরোনামের একটি গবেষণার জন্য ত্রিশ চিকিৎসক, সাহায্যকর্মী, সাংবাদিক ও বাংলাদেশী কর্মকর্তাদের সাক্ষাতকার নেয়া হয়েছে। তবে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনার আগে সংস্থাটি কৃত্রিম উপগ্রহের ছবি ও বীভৎস হত্যাকা-ের ভিডিওকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করেছে। এ্যামনেস্টি বলেছে, মিন গি বা তুলাতলি গ্রামে সবচেয়ে নৃশংস হত্যাকা-গুলো ঘটেছে। সেনাবাহিনী ৩০ আগস্ট পর্যন্ত গ্রামটিতে ব্যাপক মাত্রায় গণহত্যা চালিয়েছে। সব ধরনের সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে জানা গেছে নারী, পুরুষ ও শিশুরা সেনাবাহিনীর ব্যাপক, পরিকল্পিত হামলার শিকার হয়েছেন; যা মানবতাবিরোধী অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। এ্যামনেস্টির সঙ্কট মোকাবেলাবিষয়ক পরিচালক তিরানা হাসান বলেন, উত্তর রাখাইন রাজ্যে সুপরিকল্পিত অভিযানে মিয়ানমারের নিরাপত্তাবাহিনী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর তাদের জঘন্য প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেছে। রোহিঙ্গাদের চিরতরে দেশছাড়া করতে তাদের সর্বস্ব ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। তাদের নৃশংসতায় গত কয়েক দশকে এ অঞ্চলে সবচেয়ে ভয়াবহ শরণার্থী সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, ন্যায়বিচারের পথ সুগম করার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে এই ঘৃণ্য অপরাধের কথা প্রকাশ করে দেয়া। যারা এই অপরাধের জন্য দায়ী তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এ্যামনেস্টির সঙ্গে সাক্ষাতকারে চল্লিশ বছর বয়সী সারা জাহান নামের এক রোহিঙ্গা নারী বলেন, তার স্বামী ও সন্তানকে হত্যা করা হয়েছে। যখন বাড়ির চালে অগ্নিসংযোগ করা হয় তখন তিনি ঘরের ভেতরে আটকা পড়েন। এমনকি তার কাপড়েও আগুন ধরে গিয়েছিল। এরপর কাপড় থেকে তা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। তখন তিনি গড়াতে শুরু করেন, গড়াতে গড়াতে তিনি ধানক্ষেতে গিয়ে সামান্য পানির নাগাল পান এবং কোন রকম প্রাণে বেঁচে যান। সারা জাহানের মুখম-ল ও বাহুতে আগুনে পোড়ার দগদগে ঘা দেখা গেছে। যে রোম চুক্তি অনুসারে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠিত সেই চুক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে এ্যামনেস্টি বলেছে, তাদের কাছে অন্তত ছয়টি মানবতাবিরোধী অপরাধের সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে। হত্যা, নির্বাসন, বলপ্রয়োগে বাস্তুচ্যুত, নির্যাতন, ধর্ষণ, নৃতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিপীড়ন, বিশেষভাবে ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, খাদ্য ও জীবনরক্ষাকারী জিনিস থেকে রোহিঙ্গাদের বঞ্চিত করে জঘন্য অপরাধ করেছে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। এ্যামনেস্টি জানিয়েছে, প্রত্যক্ষদর্শীরা সেনাবাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলীয় কমান্ডের ৩৩তম লাইট ইনফেন্ট্রি ডিভিশন ও সীমান্ত প্রহরার দায়িত্বরত পুলিশের জড়িত থাকার কথা জানিয়েছে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে স্থানীয়রাও সেই হামলায় অংশ নিয়েছে। সংস্থাটি জানায়, পাঁচটি গ্রামের অন্তত ১২ জনকে হত্যার প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে। মিন গি বা তুলাতুলি গ্রামের অন্তত দশ ব্যক্তি সাক্ষাতকার দিয়েছেন। তারা বলেছেন, সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধন অভিযানের অন্যতম একটি জ্বলন্ত উদাহরণ এই নৃশংসতা। পনেরো বছরের এক কিশোর বলেছে, সেনা সদস্যদের নির্দেশে তারা সবাই নদীতে গুটিসুটি মেরেছিলেন। চারপাশে বিষাক্ত সাপ। এর পর সৈন্যরা কয়েক নারী ও শিশুকে কাছের একটি খাদে নিয়ে যায়। নারী-পুরুষ ভেদে তাদের আলাদা করার পর সেনারা গুলি করে পুরুষ ও তরুণদের হত্যা করে। কিছু নারী ও শিশুকেও তারা আঘাত করে। প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসা কয়েকজন বলেন, কয়েকজনকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে। ধারালো ছুরি দিয়ে তাদের গলা কেটে ফেলা হয়েছে। কিশোরটি জানায়, সেনাবাহিনী এরপর নারীদের ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন চালায়। এক নারী নাম প্রকাশ না করে বলেছেন, নারীদের নগ্ন করে গাছের ডাল দিয়ে তাদের বেধড়ক পেটানো হয়েছে। এ্যামনেস্টি জানায়, হিউম্যান রাইটস ওয়াচও সেনাবাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়ে তাদের সঙ্গে একমত হয়েছে।
×