ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে

স্বামীহারা নারীর আর্তনাদ

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭

স্বামীহারা নারীর আর্তনাদ

রাজন ভট্টাচার্য, উখিয়া (কক্সবাজার) থেকে ॥ জীবিকার প্রয়োজনে পাহাড়ে গাছ কাটতে যাচ্ছিলেন আসাদুল্লাহসহ অনেকেই। কিন্তু মাথার ওপর যে মিলিটারি হেলিকপ্টার টহল দিচ্ছে তা কে জানত। কিছুদূর যেতেই হেলিকপ্টার থেকে বৃষ্টির মতো গুলি ছোড়া হলো। রাস্তায় তিনিসহ ১০ জন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। স্বামীহারা হলেন ম-ুর দক্ষিণ খাইদ্যার বিল গ্রামের দিলবাহারসহ অনেক নারী। একদিন পর স্বামীর মৃত্যুর খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান দিলবাহার। খবর পান এখানে যাদের হত্যা করা হয়েছিল তাদের সবাইকে গ্রামবাসী মাটিচাপা দিয়েছে। স্ত্রী হিসেবে স্বামীর মুখটুকুও শেষবারের মতো দেখার সুযোগ পাননি। সন্তানরাও বাবার মুখ আর আর দেখতে পেল না। মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা নারীদের মধ্যে অনেকের জীবনের কাহিনীটা ঠিক এরকম। শনিবার কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বালুখালি বাজারে স্বামীহারা এ রকম অসংখ্য নারীদের সঙ্গে কথা হয়। তাদের প্রত্যেকের হৃদয়ে গেথে আছে জীবনের একেকটি করুণ গল্প। তাই নিভৃতে কাঁদেন। এর মধ্যে সন্তানদের নিয়ে বাঁচার সংগ্রাম করছেন ২৪ ঘণ্টা। সন্তানরা যখন বাবার খোঁজ করেন তখন নিশ্চুপ থাকেন মায়েরা। জবাব হারিয়ে গেছে এ রকম রোহিঙ্গা অনেক মায়ের। স্বামীকে হত্যার পর অসহায় দিলবাহার এবার বাঁচার চেষ্টা শুরু করেন। কিন্তু কিভাবে বাঁচবেন তিনি। একদিনে স্বামী হারানোর শোক। অন্যদিকে আশপাশে নির্মম অত্যাচার আর নির্যাতনের দৃশ্য। রাত দিনের যে কোন সময় আশপাশে বাড়িতে শুনতে পান নারীদের বাঁচার আর্তনাদ। সম্ভ্রম বাঁচানোর আকুতি। গ্রাম জ্বলছে। জনশূন্য হতে চলেছে আশপাশের এলাকাগুলোও। বসে থাকার সময় নেই। চার ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে বাংলাদেশে আসার চেষ্টা। কিন্তু হাতে টাকা নেই। বিক্রি করলেন স্বর্ণের কানের দুল। সেই টাকা দিয়ে নৌকা ভাড়া করে আসলেন টেকনাফ। সেখানে চারদিন থাকার পর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে গাড়ি করে আনা হয় বালুখালি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। খাবারের আশায় বালুখালি সড়কে দাঁড়িয়ে থাকা অসহায় এই নারী জানালেন, খাদ্য সঙ্কট খুব বেশি। বাচ্চারা কাঁদছে। দুদিন হলো এই ক্যাম্পে আসার পর খাবার জোটেনি। বললেন, খাবাবের অভাবে আর মিলিটারিদের নৃশংসতা দেখে আমি ঘুমোতে পারি না। নিজ চোখে দেখেছি আমাদের গ্রামের পুকুরে ৩০/৪০ জনকে গলা কেটে বস্তায় ভরে পুকুরে ফেলে দেয়া হয়েছে। শত আকুতির পর যুবতীরা নিজেদের সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারেনি। অনেকে সব হারিয়ে আত্মহত্যাও করেছে। বাবা আসবে মিয়ানমারের ম-ুর বাসিন্দা হাসিনা বেগম। তিন সন্তান নিয়ে স্বামী ফারুকের সঙ্গে সুখেই দিন যাচ্ছিল। হঠাৎ করেই যেন নেমে এলো ঘোর অন্ধকার। গোটা রাখাইন সম্প্রদায়ের ওপর শুরু হয় নিষ্ঠুর অত্যাচার নির্যাতন। গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ মানুষের সঙ্গে যা না করার কথা সবই করা হয়েছে। হাসিনা জানান, গত ১৫ দিন আগে আমাদের গ্রামসহ আশপাশের সবকটি পাড়া জ্বালিয়ে দেয়া হয়। শুরু হয় মানুষ হত্যা। হাসতে হাসতে মানুষকে হত্যা করে পাষ-ের দল। ঘরে তখন আমার স্বামী ছিল না। গ্রামবাসী নিজেদের মতো করে পালাতে শুরু করে। আমি জীবন নিয়ে কোন রকম পালিয়ে বাঁচি। কিন্তু তার সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই। শুনেছি আমার স্বামী যাদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়েছিল তাদের সবাইকেই একযোগে হত্যা করেছে সেনা সদস্যরা। মিলিটারিরা আমার স্বামীকে বাঁচিয়ে রাখবে এমন চিন্তা করা যায় না। কিন্তু তার মৃত্যুর কোন খবর পাইনি। বারবার ছেলে মেয়েরা বাবার কথা জানতে চায়। আমি কি জবাব দেব। এই বলে কাঁদতে লাগলেন হাসিনা। বললেন, মাঝে মাঝে অবুঝ শিশুদের প্রশ্নের কোন জবাব দেই না। কোন কোন সময় বলি ‘বাবা আসবেন’। তিনি বলেন, সত্যিই যদি আমি আমার স্বামীকে ফিরে পেতাম তাহলে আর রাক্ষসের দেশে কোনদিন ফিরতাম না। পাশে স্বামী নেই। তাই অসহায় হাসিনা বেগম। একটু সাহায্য সহযোগিতার আশায় ঘুরছেন উখিয়ার পথে পথে। তিন সন্তানকে প্রাণে বাঁচানোই এখন তার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সন্তানদের বাঁচাতে মানুষের পায়ে পড়ছি উখিয়া টেকনাফের বালুখালি সড়কের পাশে বসে দুই কন্যা সন্তান কোলে নিয়ে মানুষের কাছে হাত পাতছিলেন ম-ুর বওচর গ্রামের বাসিন্দা আরেক হাসিনা। শিশুদের বয়স সর্বোচ্চ দুই বছর। রুগ্ণ শরীর। অনাহারে, অর্ধাহারে কাহিল প্রায়। ছাতা দিয়ে শরীর ঘিরে সন্তানদের দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করেন তিনি। অথচ প্রতিবারই ব্যর্থ হচ্ছেন। বারবার চেষ্টা করেও মার কাছ থেকে দুধ পাচ্ছে না ক্ষুধার্ত শিশুরা। এই বলে কাঁদছেন হাসিনা। তাই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মানুষের কাছে হাত পাতা ছাড়া আর কোন উপায় নেই তার। কখনও কখনও টাকার জন্য মানুষের হাত ধরছেন। পা ধরার চেষ্টাও করেন। কারও দয়া হলে টাকা পান, নয়ত নেই। হাসিনা জানান, পাহাড়ে লাকড়ি কাটত তার স্বামী। একদিন লাকড়ি নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সেনারা স্বামী শাহ আলমকে গুলি করে হত্যা করে। হাসিনা জানান, স্বামীর লাশের দাফন কাফনও করতে পারিনি। প্রাণ বাঁচাতে পালানোর চেষ্টা করি। কিন্তু টাকা ছাড়া নৌকা তোলা হবে না। শেষ পর্যন্ত স্বর্ণের নাকফুল নৌকার চালককে দেয়া হলে আমাকে বাংলাদেশে আনা হয়। এখানে তো রাস্তার পাশে ভিক্ষা করছি। টাকা নেই। তাই পলিথিন ও বাঁশ কিনে অস্থায়ী বাসস্তান গড়ে তোলাও সম্ভব হচ্ছে না। তিনি জানান, আমার স্বামী শুধু নয় আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী অনেককেই চোখের সামনে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করতে দেখেছি। আক্রোশে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। এখন আমার ভবিষ্যত কি নিজেও জানিনা। পাহাড় থেকে আর আমার স্বামী আর ফেরেনি প্রতিদিনের মতো পাহাড়ে গাছ কাটতে গিয়েছিলেন লতিফার স্বামী আলী জোহার। শুনেছি হঠাৎ করেই পাহাড়ের জঙ্গল ঘিরে ফেলে আর্মিরা। সেদিন যারা জঙ্গলে ছিলেন তাদের সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। কারও লাশ পরিবারের কাছে দেয়া হয়নি। বার্মার ম-ুর তামিল গ্রামের এই বাসিন্দা জানান, বনের ভেতরে ১৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন আমার স্বামী। আমাদেরসহ চারপাশের গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে যায়। একের পর এক গ্রামের বাড়ি ঘড় জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছিল। সবার সঙ্গে আমিও পালাতে শুরু করি। জীবন বাঁচাতে ১১ দিন বনের মধ্যে লুকিয়ে ছিলাম। সামান্য কিছু খাবার খেয়ে জীবন রক্ষা করেছি। ১২ দিনের মাথায় বাংলাদেশে আসি। এখন দুই ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে আমি অসহায়। কে দেবে সন্তানও আমার খাবার। স্বামী হারানোর শোক ভুলে বাঁচার চেষ্টা রেহেনার ম-ুর তমবাজার এলাকার বাসিন্দা রেহেনা। তার স্বামীও পাহাড়ে লাকড়ি আনতে দিয়ে আর্মিদের হাতে মারা যায়। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার পর কোন রকমে জীবন নিয়ে সমুদ্রের কাছে আসেন তিনি। কিন্তু টাকা না থাকায় নৌকায় তোলা হচ্ছিল না তাকে। স্থানীয় লোকজন সহযোগিতা করে কিছু টাকা দিয়ে নৌকায় তুলে দেন। দুই মেয়ে ও তিন ছেলেকে নিয়ে আসেন বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে কেটেছে পাঁচদিন। অর্থেও অভাবে রেহেনা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্থায়ী বসতি গড়তে পারছেন না। আছেন রাস্তায়। রেহানা জানালেন, গত দুই দিন কিছুই খাননি তিনি। এমনকি খাবার পানিও পাচ্ছি না। এই বলে ডুকরে কেঁদে ওঠলেন। বললেন, এভাবে চললে তো সন্তানসহ আমি নিজেও মারা যাব। শনিবার দিনভর একটি রিলিফ কার্ডের জন্য রেহেনাকে বালুখালি সড়কের পাশে বসে থাকতে দেখা গেছে। ১২ দিন পাহাড়ে লুকিয়ে ছিলেন ফুলমতি বার্মার ম-ুর বাসিন্দা ফুলমতি। তার দু’হাতে ছোট ছোট সাদা দাগ। দূর থেকে দেখলে মনে হবে স্বেতী রোগ। কিন্তু এ তা নয়। ভিন্ন রকম এক বাস্তবতায় হাতে এ রকম দাগ বসেছে। তিনি জানালেন, বার্মা সেনারা আমাদের গ্রামগুলো নির্বিচারে জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। যাকে পাচ্ছে হত্যা করছে। জ্বলছে ঘরবাড়ি। গ্রামের পর গ্রাম। চারদিকে ধ্বংসযজ্ঞ। তিনি জানান, আমাদের বাড়ির সামনে আমার স্বামী সহ ছয় জনকে মিলিটারিরা হত্যা করে। প্রাণ বাঁচাতে পাহাড়ের জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিলাম। টানা ১২ দিন জঙ্গলে লুকিয়ে ছিলাম। চারদিন পর সঙ্গে আনা খাবার শেষ হয়ে যায়। তারপর গাছের লতাপাতা, কলাগাঠ খেয়ে কোন রকম জীবন বাঁচাই। নিঃশ্বব্দে কেঁদেছি। যেন কেউ শুনতে না পারে। জঙ্গলে রাত দিন মশার কামড়ে হাতে সাদা সাদা দাগ হয়েছে। গেল পাঁচদিন হয় বাংলাদেশে আসি। নৌকা ভাড়া হিসেবে স্বর্ণেও দুটি কানের দুল দেই। এখন রাস্তায় রাস্তায় খাবারের সন্ধানে ঘুরছি। জানি না কপালে আজ কোন খাবার জোটবে কিনা। সাত মেয়ে নিয়ে অসহায় মনসুরা পাহাড় থেকে গাছ কেটে বাড়ি ফেরার পথে মিলিটারিরা শহিদুল্লাকে হত্যা করে। ঘটনার একদিন পর খবর পান স্ত্রী মনসুরা। তিনি জানান, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যাই। কিন্তু লাশ পাইনি। শুনেছি যাদের হত্যা করা হয়েছিল সবার লাশ সেনারা সরিয়ে নিয়েছে। বাড়ি ফিরে দেখি ঘর নেই। পোড়া মাটির গন্ধ। আমার বাড়ি আমিই চিনতে পারছিলাম না। সবাই জীবন নিয়ে পালানোর চেষ্টা করছে। আমিও সাত মেয়ে নিয়ে পালানোর চেষ্টা করি। বাড়ির সামনে দেখি মিলিটারিরা একের পর এক যুবকদের হত্যা করছে। মানুষকে জবাই করে পুকুরে লাশ ফেলে দিচ্ছে। এসব দেখে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল। অনেক কষ্টে সাগর পাড়ি দিয়ে মেয়েদের নিয়ে বাংলাদেশে আসি। উঠেছি বালুখালি শরণার্থী ক্যাম্পে। কিন্তু সন্তানদের খাবারের চাহিদা মেটোতে পারছি না। মাঝে মাছে ত্রাণ পেলেও কম। ক্ষুধার যন্ত্রণায় ঘরে কান্নার রোল। প্রয়োজনীয় খাবার না পেলে আমার মেয়েদের বাঁচাতে পারবও না এই বলে বালুখালি সড়কে কাঁদছিলেন তিনি।
×