ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জলজট সম্পর্কে চসিক মেয়র ও চউক চেয়ারম্যান স্বীকার করলেন সমন্বয়হীনতার কথা

চট্টগ্রামে দায়িত্বশীল সংস্থাসমূহ পরস্পরকে দুষছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২৬ জুলাই ২০১৭

চট্টগ্রামে দায়িত্বশীল সংস্থাসমূহ পরস্পরকে দুষছে

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রাম মহানগরীতে ভারি বর্ষণ ও জোয়ারে ভয়াবহ জলজট অনেকটা স্বাভাবিক চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু বর্ষা মৌসুম নয়, বছরের যে কোন সময়ে হঠাৎ বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় সড়ক। এমনকি বৃষ্টি ছাড়া জোয়ারের পানিতেও ডুবে রাতে নগরীর বিভিন্ন এলাকা। বছরের পর বছর এভাবে চলতে চলতে পরিত্যক্ত হতে চলেছে অনেক অভিজাত এলাকা। সমস্যার সমাধানে পরিকল্পনা গ্রহণেই বেশি উৎসাহী দেখা যায় সেবা সংস্থাগুলোকে। কিন্তু এর বাস্তবায়ন নেই। প্রত্যেকটি সংস্থা আলাদা আলাদাভাবে পরিকল্পনা পেশ করে সরকারের কাছে। কিন্তু সমন্বিত কোন পরিকল্পনা নেই। নগরীর জনভোগান্তির জন্য প্রধানত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (চউক) দুষছে নগরবাসী। তবে এর বাইরেও দায় রয়েছে ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ আরও কয়েকটি সংস্থার। চসিক মেয়র ও চউক চেয়ারম্যান স্বীকার করলেন সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কথা। বাংলাদেশ বৃষ্টি ও বন্যার দেশ। পৃথিবীর বৃষ্টিবহুল অঞ্চলে এদেশের অবস্থান। এদেশে বৃষ্টিপাত খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু সঠিকভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়িত হলে জনভোগান্তি এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছত না বলে অভিমত নগর পরিকল্পনাবিদদের। তারা প্রধানত দুষছেন চসিক এবং চউককে। কেন না, আরও অনেকগুলো সংস্থা থাকলেও এ দুটি সংস্থার প্রতি নাগরিকদের প্রত্যাশা সবচেয়ে বেশি। তাছাড়া নগরবাসীকেই জলজট এবং জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করার আশ্বাস এ দুই সংস্থাই দিয়ে থাকে। তাছাড়া প্রতিটি নির্বাচনের পূর্বে ভোটারদের আকর্ষণের জন্য ইস্তেহারে সংযোজিত অনেক দফার মধ্যে এ দফাটিকেই বেশ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু মেয়র যায়, মেয়র আসে নগরীর জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির কোনই উন্নতি নেই। বরং প্রতিবছরই বাড়ছে প্লাবিত এলাকার পরিধি। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ একের পর এক মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে সরকারের কাছে প্রেরণ করে চলেছে। সঙ্কট নিরসনে কাজের চেয়েও সংস্থাগুলো পরিকল্পনা নিয়েই বেশি ব্যস্ত বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে যে প্রকল্পগুলো অনুমোদন করে পাঠানো হয়, সেগুলো বাস্তবায়নের পরও ফলপ্রসূ উন্নতি ঘটে না। কারণ, সে পরিকল্পনাগুলোই অপরিকল্পিত, এমনই মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের। কেননা, এগুলো প্রেরিত হয় সংস্থারগুলোর নিজ নিজ বিবেচনা থেকে, যার সঙ্গে সামগ্রিক চিন্তার প্রতিফলন নেই। চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ইতোমধ্যেই পৃথক পৃথকভাবে তিনটি পরিকল্পনা সরকারের কাছে পেশ করেছে সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও পানি উন্নয়ন বোর্ড। এরমধ্যে চসিক ৫ হাজার ৬শ’ কোটি টাকার, চউক ৫ হাজার ৮শ’ কোটি টাকার এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রায় ২ হাজার ৬শ’ কোটি টাকার পরিকল্পনা দাখিল করে। সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে সংস্থা তিনটি নিজ নিজ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে আগ্রহী। এতে জলজট এবং জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশাবাদ শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের। কিন্তু অনেকেই মনে করছেন, অপরিকল্পিত পরিকল্পনার কোন ফল দেবে না। বরং স্থায়ীভাবে সঙ্কট নিরসনে প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা এবং প্রকল্প গ্রহণ। সাদার্ন ইউনিভার্সিটির উপ-উপাচার্য ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের প্রাক্তন চেয়ারম্যান বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী আলী আশরাফ এ প্রসঙ্গে বলেন, সকল সংস্থা একসঙ্গে বসে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা সরকারের কাছে পেশ করতে পারে। তা না করে আলাদা আলাদাভাবে যার যার মতো করে পরিকল্পনা করা হচ্ছে। সরকার ইতোমধ্যেই অনেক পরিকল্পনার অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু তাতে কাক্সিক্ষত ফল আসেনি। প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা। এমন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, যা বাস্তবসম্মত এবং বাস্তবায়নযোগ্য। চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে এ পর্যন্ত পরিকল্পনা কম গৃহীত হয়নি। প্রতিটি সিটি নির্বাচনের পূর্বে এটি থাকে প্রধান ইস্যু। কিন্তু এভাবেই কাটছে যুগের পর যুগ। জলাবদ্ধতা থেকে নগরবাসীর মুক্তি মেলেনি। চট্টগ্রাম নগরীকে একটি পরিকল্পিত শহর ও দুর্ভোগমুক্ত নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে প্রথম মাস্টার প্ল্যানটি গৃহীত হয়েছিল ১৯৬৯ সালে। এরপর ১৯৯৫ সালে গৃহীত হয় চতুর্থ মাস্টারপ্ল্যান। সর্বশেষ এ প্ল্যানটিও এখন আউটডেটেড হয়ে গেছে। এখন চলছে ৫ম মাস্টারপ্ল্যান প্রস্তুতের কাজ। একের পর এক মাস্টারপ্ল্যান গৃহীত হলেও সে অনুযায়ী কোন কাজই হয়নি। নগর পরিকল্পনাবিদগণ বলছেন, সংস্থাগুলো শুধুমাত্র প্ল্যান তৈরির কাজেই বেশি উৎসাহী। একেকটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করতে প্রচুর অর্থব্যয় হয়। কিন্তু বাস্তবায়িত না হলে এভাবে অর্থব্যয়ের কী যুক্তি থাকতে পারে? বাস্তবায়নের জন্য জনপ্রতিনিধি, সংশ্লিষ্ট সংস্থা এবং এতে কর্মরত দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনা হচ্ছে না। নাগরিকদের মধ্যেও দায়িত্বশীলতা সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন নিজেই বিভিন্ন সময় স্বীকার করেছেন সমন্বয় না থাকার অভিযোগ। চট্টগ্রামের সরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাসমূহের প্রধানদের মধ্যে একাধিক সমন্বয় সভায় তিনি সমন্বয়হীনতার প্রসঙ্গ এনেছেন। তিনি বলেন, সমন্বয় যেভাবে হওয়া দরকার সেভাবে হচ্ছে না। অনেকেই সাড়া দিচ্ছেন না। কেউ যদি সাড়া না দেন তাহলে ওই প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কোন সুযোগ সিটি কর্পোরেশনের নেই। কেননা, কোন পক্ষ সমন্বয় না করলে তার বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে তার কোন ব্যাখ্যা পরিপত্রে উল্লেখ নেই। সমন্বয়ের বিষয়টি কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান চসিক মেয়র। এদিকে, চউক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামও স্বীকার করেন সমন্বয়হীনতার বিষয়টি। তবে এও বলেন যে, এ ব্যাপারে তিনি চেষ্টা করছেন। জনকণ্ঠকে তিনি জানান, চট্টগ্রাম নগরবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিতে সরকারের অনুমোদনে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায় চউক। এ নিয়ে চসিকের সঙ্গে সমন্বয় হচ্ছে। একাধিক দফায় বৈঠক হয়েছে, চসিকও চউককে দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা প্রদানে সম্মত। চউক চেয়ারম্যান এরইমধ্যে গৃহীত প্রকল্প প্রসঙ্গে বলেন, কর্ণফুলীর তীর ঘেঁষে নগরীর চাক্তাই থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত একটি নতুন সড়ক এবং ১২টি খালের ওপর স্লুইসগেট নির্মাণের লক্ষ্যে ২ হাজার ৩শ’ কোটি টাকার একটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদিত হয়েছে। এ কাজ শুরু করতে এখন আর কোন বাধা নেই। প্রকল্পটির কাজ শেষ হলে নগরীর বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জসহ নগরীর বিরাট একটি এলাকা জলাবদ্ধতার হাত থেকে মুক্তি পাবে। সমন্বয়ের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, শুধু চসিক নয়, ওয়াসা, টিএ্যান্ডটি, বিদ্যুত, গ্যাস, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সকল সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন একান্ত জরুরী। বিলম্বে হলেও এ চেষ্টা এখন চলছে বলে জানান চউক চেয়ারম্যান। অপরদিকে, নগর বিভিন্ন স্থানে চলছে ওয়াসার পাইপ লাইন বসানোর খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। ওয়াসা বলেছে, খোঁড়াখুঁড়ির বিপরীতে তারা চসিককে নির্ধারিত অর্থ পরিশোধ করেছে। কিন্তু চসিক অর্থ গ্রহণ করেও রাস্তা সংস্কারে কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না। এসব মিলিয়ে চট্টগ্রামের সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগ বা পরিকল্পনার লেশমাত্র নেই। একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে যেন তারা পরিত্রাণ পেতে চায়।
×