ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গমবোঝাই লাইটারেজ অর্ধনিমজ্জিত বান্দরবানে ভূমিধসে তিন স্থানে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ ॥ হত ১, নিখোঁজ ২

ভারি বর্ষণে বৃহত্তর চট্টগ্রামে ফের পাহাড়ধস

প্রকাশিত: ০৪:৩৫, ২৪ জুলাই ২০১৭

ভারি বর্ষণে বৃহত্তর চট্টগ্রামে ফের পাহাড়ধস

মোয়াজ্জেমুল হক/হাসান নাসির/বাসু দাশ/মোহাম্মদ আলী ॥ শনিবার রাত থেকে কখনও ভারি কখনও মাঝারি আকারে বর্ষণে বৃহত্তর চট্টগ্রাম তথা চট্টগ্রাম মহানগরী, বান্দরবান, রাঙ্গামাটির পরিস্থিতিতে আবারও বিপর্যয় নেমে এসেছে। বান্দরবানে আবারও পাহাড়ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। তিনটি স্থানের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। রাঙ্গামাটিতে পাহাড়ী ঢলে ভেসে গেছে এক মহিলা। চট্টগ্রামে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ভারিবর্ষণের সঙ্গে ভর জোয়ারের পানিতে একাকার হয়ে গেছে বিভিন্ন এলাকা। বহির্নোঙ্গর থেকে বেসরকারী আমদানির গম পরিবহনকালে ১৬শ’ মেট্রিক টন বোঝাই একটি লাইটার জাহাজ মাঝপথে তলা ফুটো হয়ে অর্ধনিমজ্জিত অবস্থায় পতেঙ্গার কূলে চরে আটকা পড়েছে। রবিবার সন্ধ্যা ৭টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বর্ষণ অব্যাহত ছিল। এর ফলে বৃহত্তর চট্টগ্রামের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা আবারও বিপর্যয়ের কবলে পড়েছে। সবচেয়ে বিস্ময়ের ঘটনা হচ্ছে, বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগরীতে জলজটের কারণে জন চলাচলে নৌকা ও রিক্সাভ্যান ব্যবহার করছে পথচারীরা। গত জুনের শুরু থেকে প্রাকৃতিক বৈরী আবহাওয়ার কারণে সৃষ্ট এ দুর্যোগ যেন থামছেই না। প্রতিনিয়ত কোন না কোন স্থানে পাহাড় ধসছে, জলজট সৃষ্টি হচ্ছে, ঢলের পানি নামছে। কাপ্তাই লেকে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় স্পীলওয়ের ১৬টি গেট খুলে দেয়া হয়েছে। এতে করে রাঙ্গুনিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকায় আবারও পানিতে তলিয়ে গেছে। নতুন করে ফসলের ক্ষেত ডুবে গেছে। চট্টগ্রাম পরিস্থিতি প্রবল বর্ষণ ও জোয়ারের পানিতে ফের ডুবেছে চট্টগ্রাম নগরীর বিরাট এলাকা। ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের ভোগ্যপণ্যের বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ এবং আছাদগঞ্জের বিভিন্ন গুদাম। সাগরে প্রবল বাতাসের কারণে সৃষ্ট উত্তালতায় গমবাহী একটি লাইটার জাহাজ তলা ফুটো হয়ে আটকা পড়েছে চরে। এছাড়া বান্দরবানের রুমায় পাহাড়ধসে নিহত হয়েছে একজন। ঝড়ো হাওয়া এবং উঁচু ঢেউয়ে ব্যাহত হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর বহির্নোঙ্গরে পণ্য লাইটারিং কাজ। আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় বর্ষণ আরও কয়েকদিন দীর্ঘায়িত হতে পারে। সমুদ্র বন্দরসমূহের জন্য ৩ নম্বর সতর্কতা সঙ্কেত বহাল রয়েছে। রবিবার দিনভর ছিল বৃষ্টিপাত। মাঝে দুটি দিন বৃষ্টির প্রকোপ কম থাকায় পানি নেমে গিয়েছিল। কিন্তু আবারও তলিয়েছে নগরীর বিভিন্ন এলাকা এবং নিচু সড়ক। এতে জনসাধারণের ভোগান্তি চরমে উঠে। অনেক সড়কে নৌকা চলাচল করতেও দেখা যায়। সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রিক্সা এবং রিক্সা ভ্যানই ছিল ভরসা। তবে এর জন্য ভাড়া গুণতে হয় দ্বিগুণ থেকে পাঁচগুণ পর্যন্ত। হাঁটু থেকে বুক পানিতে ডুবে যাওয়া নগরীতে এক ধরনের অচলাবস্থা দেখা দেয়। স্থবির হয়ে পড়ে জনজীবন। আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, রবিবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত চট্টগ্রামে ৯৯ দশমিক ৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। দিনভর বর্ষণের মাত্রা ছিল মাঝারি থেকে ভারি। সাগরে এ মুহূর্তে কোন নি¤œচাপ কিংবা লঘুচাপ নেই। তবে বায়ুচাপের তারতম্যের আধিক্য এবং মৌসুমি বায়ু বেশ সক্রিয় থাকায় সমুদ্র বন্দরসমূহকে ৩ নম্বর সতর্কতা সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা মোঃ রেজাউল করিম খান জানান, ঋতু বৈচিত্র্যের ধারাবাহিকতায় বছরের জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এটি প্রকৃতির স্বাভাবিক আচরণ। রবিবারের বর্ষণ ও জোয়ারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ, আছাদগঞ্জ ও চাক্তাই। এখানকার অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে বিনষ্ট হয়েছে চাল, গম, পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ বিভিন্ন ধরনের খাদ্যপণ্য। খাতুনগঞ্জ ট্রেড এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ছগীর আহমেদ জানান, ১৯৯১ সালের পর এত বেশি পানি খুব একটা দেখতে পাইনি। দেশের বৃহত্তম ভোগ্যপণ্যের এ পাইকারি বাজারে প্রায় ৬ হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এরমধ্যে কয়েক হাজার প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকেছে। প্রায় সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই কম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গুদামগুলোতে পানি প্রবেশ করায় থরে থরে রাখা পণ্যের নিচের কয়েকটি স্তর বিনষ্ট হয়ে গেছে। তিনি জানান, বৃষ্টির পাশাপাশি জোয়ার থাকায় এ ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। তিনি জলাবদ্ধতা এবং জলজট থেকে খাতুনগঞ্জকে রক্ষায় সিটি কর্পোরেশন, চউকসহ সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের দাবি জানানোর পাশাপাশি কার্যক্রম মনিটরিংয়ের জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠনের দাবিও জানান। চট্টগ্রামে রবিবার প্রথম জোয়ার ছিল সকাল ৭-১২ মিনিট থেকে। এরপর ভাটা শুরু হয় দুপুর ১২টা ৪২ মিনিটে। সন্ধ্যা ৭টা ৫১ মিনিটে শুরু হয় দ্বিতীয় জোয়ার। এরপর ভাটা হয় রাত ১২টার পর। সকালের জোয়ারের সময় হয়েছে প্রচ- বৃষ্টিপাত। বেলা ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছিল ৮৭ দশমিক ৬ মিলিমিটার। ভাটা থাকার কারণে পানি নামতে না পেরে নগরীকে ডুবিয়ে দেয়। রবিবার বৈরী আবহাওয়ায় প্রচ- বাতাস ও ঢেউয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ‘সিটি-১১’ নামের গমবাহী একটি লাইটার জাহাজ। প্রায় ১৬শ’ মেট্রিক টন গম নিয়ে জাহাজটি মাদার ভেসেল থেকে তীরের দিকে ফিরছিল। বিদেশ থেকে আমদানি করা এ গমের মূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা বলে জানা গেছে। ঢেউয়ের কবলে পড়ে এর তলা ফুটো হয়ে পানি ঢুকতে শুরু করে। এরপর এটি চরে এসে আটকে যায়। জাহাজের সকল নাবিক নিরাপদে নেমে আসতে সক্ষম হয়। ফায়ার সার্ভিস ও কোস্টগার্ড কর্মীরা উদ্ধার অভিযান চালান। এদিকে, অব্যাহত বৃষ্টিপাতের কারণে চট্টগ্রাম বহির্নোঙ্গরে পণ্য খালাস ব্যাহত হয়। লাইটার জাহাজগুলো বহির্নোঙ্গর পর্যন্ত যেতে পারছে না। ফলে পণ্য খালাস এক প্রকার বন্ধ। রবিবার বহির্নোঙ্গরে জাহাজ ছিল ৪৬টি। অধিকাংশ জাহাজেই রয়েছে খাদ্যপণ্য। আবহাওয়া অনুকূলের অপেক্ষায় রয়েছে মাদার ভেসেলগুলো। এছাড়া সাগরে জেলেদের স্বাভাবিক মাছ ধরা বন্ধ রয়েছে। আবহাওয়া বিভাগের সতর্কতা অনুযায়ী মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারগুলো উপকূলের কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে রয়েছে। বান্দরবান পরিস্থিতি বান্দরবানে আবারও পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছে। তিন দিনের টানা বর্ষণে রুমা উপজেলার দলিয়ানপাড়া এলাকায় সড়কের ওপর পাহাড়ধসে মাটিচাপা পড়ে ১ জন নিহত হয়েছে। নিহতের নাম চিংমেহ্লা মারমা (১৯)। এ ঘটনায় নিখোঁজ ৬ জনের মধ্যে ৪ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানানো হয়েছে, এখনও নিখোঁজ সিংমেচিং (১৭), মুন্নি বড়ুয়া (৩৫) নামের দু’জন। নিখোঁজ মুন্নি পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা। রবিবার সকাল নয়টার দিকে জেলার রুমা থেকে সড়ক পথে পায়ে হেঁটে তারা বান্দরবান সদরে আসার সময় পাহাড় ধসে পড়ায় তারা এ ঘটনার শিকার হন। স্থানীয় সূত্রে আরও জানা গেছে, ঘটনার পর আহতদের উদ্ধার করে রুমা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও বান্দরবান সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এদিকে ঘটনার পর জেলার দমকল বাহিনীর সদস্য, সেনা সদস্য ও রেডক্রিসেন্টের সদস্যরা উদ্ধার অভিযান শুরু হয়েছে। কিন্তু বর্ষণ অব্যাহত থাকায় উদ্ধার তৎপরতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ফলে নিখোঁজ দুজনের এখনও কোন সন্ধান মেলেনি বলে প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে। পাহাড়ধসের ঘটনায় সকাল থেকে বান্দরবানের সঙ্গে রুমা ও থানচি উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে। রাঙ্গামাটি পরিস্থিতি আবারও ভারিবর্ষণে রাঙ্গামাটির জনজীবন নতুন করে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ভারিবর্ষণের ফলে ঢলের পানিতে ভেসে গেছে ক্রায়োচিং মারমা (২৬) নামে এক গৃহবধূ। সড়ক ধসের আশঙ্কায় রাঙ্গামাটি সড়ক বিভাগ রাঙ্গামাটি খাগড়াছড়ি সড়ক রবিবার দুপুর থেকে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ভারিবর্ষণে কাপ্তাই লেকে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কাপ্তাই বাঁধের ১৬টি স্পিলওয়ে ২ ফুট করে খুলে দেয়া হয়েছে। যা দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ৩৬ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহিত হচ্ছে। রবিবার দুপুরে জেলার রাজস্থলী উপজেলার তাইদং চুচকপাড়া এলাকায় নাড়া খাল পার হওয়ার সময় পানির স্রোতে ক্রায়চিংকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সে কৃষি ক্ষেতে কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পথে এই ঘটনা ঘটেছে বলে পুলিশ সূত্রে জানানো হয়েছে। একইভাবে বর্ষণের ফলে রাঙ্গামাটি খাগড়াছড়ি ৮ কিমি. এলাকায় সদ্য ভরাট করা ৭০ ফুট সড়ক ভাঙ্গনের কবলে পড়ায় সড়কটি আবারও ঝুকিঁপূর্ণ হয়েছে। ফলে রাঙ্গামাটি সড়ক বিভাগ রবিবার দুপুর থেকে সড়কটি দিয়ে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করেছে বলে সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী এমদাদ হোসেন জানিয়েছেন। তবে রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়কে যান চলাচল এখনও স্বাভাবিক রয়েছে। ভারিবর্ষণ অব্যাহত থাকায় পাহাড়ী শহর রাঙ্গামাটির ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাসমূহ হতে সকল লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরে আসার জন্য জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে তথ্য অফিসের মাধ্যমে শহর এলাকায় ফের মাইকিং করা হয়েছে। উল্লেখ্য, গত ১৩ জুন মহাদুর্যোগের পর ক্ষতিগ্রস্ত ২ হাজারের অধিক লোক এখনও আশ্রয় কেন্দ্রে রয়েছে। এর ওপর নতুন করে এই ভারিবর্ষণ শুরু হওয়ায় জেলাবাসী মধ্যে আবারও উদ্বিগ্নতা সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে চালু থাকা চারটি আশ্রয় কেন্দ্রে নতুন করে লোকজন আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সড়ক সংলগ্ন পাহাড়ে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তাই নয়, ১৩ জুনের মহাদুর্যোগের পর যেসব সড়কে মাটি ভরাট করে হালকা যানবাহন চলাচল উপযোগী করা হয়েছিল সেগুলোর বিভিন্ন পয়েন্টে সৃষ্টি হয়েছে খানাখন্দক এমনকি কোথাও কোথাও আবারও সড়ক ধসের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
×