ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভ্যাট নিয়ে আন্দোলন হলে দমন করবে সরকার-অর্থমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০২:৫৯, ৩০ এপ্রিল ২০১৭

ভ্যাট নিয়ে আন্দোলন হলে দমন করবে সরকার-অর্থমন্ত্রী

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন নিয়ে এক ব্যবসায়ী নেতার আন্দোলনের হুমকির প্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন রাস্তায় নামলে সরকারের পক্ষ থেকে তা দমন করা হবে। তিনি হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, আপনারা কতজন ভ্যাট জমা দেন। আন্দোলন করে কিছু হবে না, আন্দোলন করলে বরং তা দমন করা হবে। অর্থমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ভ্যাট আইনের বাস্তবায়ন নিয়ে ব্যবসায়ী নেতার হুমকির পর উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ও হয়েছে। রবিবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও এফবিসিসিআই আয়োজিত ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পরামর্শক কমিটির ৩৮তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন নিয়ে কথা বলেন ব্যবসায়ী নেতারা। সভায় ব্যবসায়ী ঐক্য ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আবু মোতালেব বলেন, নতুন ভ্যাট আইনে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এ আইনে ব্যবসায়ীদের দাবি না মানলে আমরা ছাত্রদের মত আন্দোলনে যাব। তার এমন মন্তব্যের তাৎক্ষনিক প্রতিবাদে অর্থমন্ত্রী এ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। এ সময় ব্যবসায়ীরা অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহারে হট্টগোল শুরু করেন। মন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানান। পরে এফবিসিআইয়ের সহ-সভাপতি মো. সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন ও এনবিআর চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। মহিউদ্দিন বলেন, বাজেটে কি আসছে আমরা এখনো জানি না। শেখ হাসিনার সরকার আমাদের ওপর কিছু চাপিয়ে দেবে না বলে আমাদের আশা। আমাদের ন্যায্য দাবি সরকার মেনে নেবে। ব্যবসাবান্ধব একটি বাজেট হবে। আবু মোতালেব বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তারা চরম ক্ষতিগ্রস্তের মধ্যে আছি। বন্ড সুবিধার কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভারত ও চীন থেকে ট্যাক্স ছাড়া মাল চলে আসছে। তাদের সাথে আমরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছি না। তিনি বলেন, ভ্যাট ১৫ শতাংশ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে কিন্তু ফলাফল জিরো। নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণ দিতে আইএমএফ একটি ফান্ড দিয়েছেন। প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ৩৭৭টি এ্যাসোসিয়েশন ও ৬৪টি জেলা চেম্বার আছে, সেগুলোতে কোনো ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করেছেন কি? লোক দেখানোর নামে ট্রেনিং এর নামে এফবিসিসিআই থেকে ৭-৮ জনকে বিদেশে নিয়ে গেছেন। তারা কি শিখেছেন, তারা কি আদৌ আমাদের সংস্পর্শে এসেছেন? আমরা যদি প্রশিক্ষিত না হই কিভাবে এ আইন বাস্তবায়ন করবেন? কি করে অনলাইন সিস্টেমস ও সর্বক্ষেত্রে ইসিআর ব্যবহার করবেন? আবু মোতালেব বলেন, টার্নওভার ট্যাক্স বাড়ানো না হলে দেশীয় পণ্য ধরা খাবে। দেশীয় শিল্প বাঁচবে না। প্যাকেজ ভ্যাট আইন না থাকলে ৩৬ লাখ টাকা পর্যন্ত ছাড় দেয়া হয়েছে। একটি মুদি দোকানে টার্নওভার বছরে দেড় কোটি টাকা হয়। সেখানে ৩ কোটি টাকা করার প্রয়োজন। তিনি বলেন, এসব বিবেচনা করে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করেন। না হলে ভ্যাট আইনের পরে ব্যবসায়ীরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আইন করে লাভ হবে না, আমরা আন্দোলনে নামলে আপনারা ব্যর্থ হবেন। এসময় মন্ত্রী আবু মোতালেবকে থামিয়ে দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে দেশে ৮ লাখ ৬৪ হাজার নিবন্ধিত করদাতা আছেন। তাদের মধ্যে ৩২ হাজার রিটার্ন দাখিল করেছেন। আপনারা ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্পের কতজন রিটার্ন দিয়েছেন তার তালিকা আমাকে দেন। আপনারা কতজন ভ্যাট জমা দেন। শেষে মন্ত্রী তার বক্তব্যের বিষয়ে আরও বলেন, আজ আমরা আলোচনা করতে বসেছি কিন্তু আবু মোতালেব হুমকি দিচ্ছেন, আমি কথাগুলো একটুও পছন্দ করি নাই। আবু মোতালেবের কথাগুলো তুলে নেয়া উচিত। এখানে আলোচনা হচ্ছে, এখানে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে লাভ নেই। তিনি থ্রেট করছেন। এটা ঠিক হয়নি। আবার আমারও উত্তেজিত হওয়াটা ঠিক হয় নাই। অতিরিক্ত হয়েছে। এটা আপনারা একটু চিন্তা করবেন। প্রঙ্গত, ২০১২ সালের এই ‘মূসক ও সম্পূরক শুল্ক আইন’ কার্যকর করার কথা ছিল গত বছরের ১ জুলাই থেকে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে তা পিছিয়ে দেয় সরকার। তখন বিদ্যমান প্যাকেজ ভ্যাটের হার বাড়িয়ে বলা হয়, ২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট নেয়া হবে। ব্যবসায়ীরা তা আরও পিছিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়ে এলেও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সম্প্রতি ওই তারিখ থেকেই নতুন আইন কার্যকরের সিদ্ধান্তের অটল থাকার কথা জানান। এদিকে, আসছে বাজেটে সব ধরনের কোম্পানির করপোরেট কর হার কমানোর প্রস্তাব দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা ২ লাখ ৫০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা করার সুপারিশ করেছেন তাঁরা। করপোরেট করের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন পরামর্শ দেয় এফবিসিসিআই। করপোরেট করের ক্ষেত্রে এফবিসিসিআইয়ের প্রস্তাব হলো, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের করপোরেট কর হার ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ২২ শতাংশ, শেয়ারবাজারে তালিকাবহির্ভূত অন্য উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ (মূসক নিবন্ধনের শর্ত থাকবে), অন্য ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সাড়ে ৩২ শতাংশ কর আরোপ। এছাড়া যেসব ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত, তাদের করহার ৪০ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৩৭ শতাংশ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। সভায় শুধু মূল্য সংযোজনের ওপরেই কর আরোপের প্রস্তাব দিয়েছে এফবিসিসিআই। এ ছাড়া বেশ কিছু খাতে রেয়াতি হারে মূসক আরোপের প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে। আবার যাঁরা নতুন আইনে উপকরণ রেয়াত নিতে পারবেন না, তাঁদের ওপর সাড়ে ৪ শতাংশ হারে মূসক আরোপ করার সুপারিশ করা হয়েছে। ৩৬ লাখ টাকা থেকে ৫ কোটি টাকার লেনদেন পর্যন্ত ৩ শতাংশ হারে টার্নওভার কর আরোপের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান বলেন, এই ধরনের পরামর্শক সভায় আন্দোলনের হুমকি দেবেন না। এ ধরনের ফোরামের একটি আলাদা ভাষা আছে। এছাড়া আগামী অর্থবছরের বাজেটে কর্পোরেট কর কমানো এবং ব্যক্তি করমুক্ত আয়সীমা ৩ থেকে ৫ বছর ও মহিলাদের করমুক্ত আয়সীমার একটি কাঠামো তৈরি নির্দেশনার ইঙ্গিত দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। মুহিত বলেন, আমরা যদি ট্যাক্স রেট ৩ থেকে ৫ বছরের জন্য ঘোষণা করতে পারলে ভালো হয়। কর্পোরেট ট্যাক্স কমানোর চিন্তা করছে সরকার। আইটি খাতে করমুক্ত সনদের বিষয়ে বেসিস সভাপতি মোস্তফা জব্বারের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রী বলেন, করমুক্ত সনদ এনবিআর কেন দেয়নি? দিস ইজ রিয়েলি অবজ্যাকশান্যাবল। এটা মাস্ট ইস্যু করা উচিত। ১ সপ্তাহের মধ্যে এটা ইস্যু করতে হবে। বাংলাদেশ উইমেন চেম্বারের সভাপতি সেলিমা আহমেদের নারীর করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর প্রস্তাবে মুহিত বলেন, আগামী বছর থেকে আয়কর সীমা স্থায়ী করে দেয়া হবে। আমেরিকাসহ উন্নত দেশগুলোর মতো আয়ের লিমিট দেয়া হবে। লিমিটের বেশি আয় হলে অবশ্যই ট্যাক্স দিতে হবে। ভোক্তা স্বার্থ সুরক্ষায় আইনের প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, টোব্যাকো ট্যাক্সে বাংলাদেশ দুর্বল। আগামী অর্থবছর টোব্যাকো ট্যাক্স ভালো হবে। বিড়িকে দেশ থেকে বিদায় করতে হবে। বিড়ি নিয়ে অনেক মিথ আছে। বিড়ি এখন নেই, সব লো কোয়ালিটির সিগারেটের পরিণত হয়েছে। কর্পোরেট ট্যাক্স, সিম ট্যাক্স কমানোসহ অ্যামটবের মহাসচিব নুরুল কবীরের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রী বলেন, মোবাইল অপারেটররা হায়েস্ট কর্পোরেট ট্যাক্স দেন। এবার সর্বোচ্চ কর্পোরেট কর পুনঃবিবেচনার চিন্তা করছি। স্পেকটামের লাইন্সেসে ভ্যাট প্রত্যাহারেরও চিন্তা আছে। ডিসিসিআই সভাপতি আবুল কাসেম খানের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে মুহিত বলেন, মোবাইল মানি ট্রান্সফারে মানি লন্ডারিং হচ্ছে। বিকাশের ব্যাপারে ইতোমধ্যে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। মোবাইল মানি ট্রান্সফারের বিষয়েও পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। দেশীয় শিল্পকে বাঁচাতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। আগামী বাজেটকে উচ্চাবিলাসী বাজেট উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, আগে ট্যাক্স দেয়ার সময় হয়রানি ঘটনা ঘটতো, সেজন্য অনেকেই ট্যাক্স নেটে আসতে চাইতো না। এ সংস্কৃতিকে আমরা সফলভাবে বিদায় করেছি। এখন মানুষ ট্যাক্স দিতে চায়। ট্যাক্স দেয়াকে বাহাদুরী মনে করে। তরুণ প্রজন্মও ট্যাক্স দিতে আগ্রহী। আমাদের ই-টিআইএন নিবন্ধন সাড়ে ২৮ লাখ ছাড়িয়েছে, এ সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। তাই আগামী বাজেট উচ্চাবিলাসী। এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমাদের সভাপতিত্বে ও এনবিআর চেয়ারম্যানের সঞ্চালনায় বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিরা সভায় বক্তব্য রাখেন। এনবিআর চেয়ারম্যার আরও বলেন, নতুন ‘মূল্য সংযোজন ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২’ আইনে রেয়াত গ্রহণ অত্যন্ত সহজ হবে। তিনি বলেন, ১৯৯১ সালের আইনে রেয়াত গ্রহণ অনেক জটিল ছিল। ২০১২ সনের নতুন আইনে তা অনেক সহজ করা হয়েছে। শুধু ক্রয় চালান (আমদানির ক্ষেত্রে বিল অব এন্ট্রি এবং স্থানীয় ক্রয়ের সময় কর চালানপত্র) থাকলেই রেয়াত নিতে পারেন। ব্যবসায়ীকে ক্রয়-বিক্রয়ের হিসাব রাখলেই চলবে। নতুন আইনে রেয়াত গ্রহণকে যারা জটিল বলে প্রচার করছেন-তাদের আইন ও বিধি অভিনিবেশ সহকারে পরীক্ষা করে দেখার জন্য অনুরোধ করছি। এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, গত ২৩ মার্চ ভ্যাট অনলাইন সিস্টেম উদ্বোধন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এরপর থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ এর বেশি নিবন্ধন হচ্ছে। যারা নতুন আইনে হয়রানি বাড়ার কথা বলছেন-অনলাইনে নিবন্ধনের পর তারা স্বীকার করবেন, এ ব্যবস্থায় হয়রানির কোনো সুযোগ নেই।
×