ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্বজনদের আহাজারিতে বাতাস ভারি ॥ মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৬

শোকস্তব্ধ সিলেট

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ২৭ মার্চ ২০১৭

শোকস্তব্ধ সিলেট

স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট থেকে ॥ শুক্রবার ভোররাতে জঙ্গী আস্তানা আতিয়া মহলে অভিযান শুরু হলে ডেকে আনা হয় পুলিশের পরিদর্শক মনিরুল ইসলামকে। তিনি বিশেষ প্রশিক্ষণে ছিলেন। বোমা নিষ্ক্রিয় করার বিশেষ প্রশিক্ষণ থাকায় ডাক পড়ে তার। শনিবার বিকেলে ঢাকা থেকে ছুটে এসে অভিযানে যোগ দেন তিনি। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সেখানেই বোমার বিস্ফোরণে চিরদিনের মতো হারিয়ে যান মনিরুল। কে জানত সাহসী এই বীর পুলিশ অফিসারকে মৃত্যুই টেনে এনেছিল এখানে। শুধু মনিরুল ইসলাম নন এই ঘটনায় নিহত হয়েছেন আদালত পুলিশের পরিদর্শক চৌধুরী মোঃ আবু কয়ছর। দুই পুলিশ সদস্য ছাড়াও নিহত হয়েছেন আরও চারজন। এরা হলেন স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা জান্নাতুল ফাহমি, কলেজছাত্র অহিদুল ইসলাম অপু ও নগরীর দাঁড়িয়াপাড়ার শহীদুল ইসলাম ও ছাতকের দয়ারবাজার এলাকার কাদিম শাহ। আর হাসপাতালে ৫০ জন গিয়েছিলেন চিকিৎসা নিতে। এর মধ্যে ১৭ জন প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। আর ২৬ জন এখনও হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন। রবিবার সারাদিনই সিলেটে স্বজনহারাদের আহাজারিতে ভারি ছিল বাতাস। রবিবার সকালে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে নিহত স্বজনদের আহাজারিতে। পরিবারের উপার্জনক্ষম একমাত্র ব্যক্তিকে হারিয়ে তাদের অনেকেই দিশেহারা। হাসপাতালের মর্গে পরিদর্শক মনিরুল ইসলামের ভাই সাইফুল ইসলাম জানালেন, তাদের সব ভাষা হারিয়ে গেছে। শোকে পুরো পরিবার এখন পাথর প্রায়। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, আমার ভাই ঢাকায় ট্রেনিং করতে গেছে। শনিবার বিকেল ৫টায় তাকে ঢাকা থেকে আনা হলো। এখানে র‌্যাব ছিল, সেনাবাহিনী ছিল। ওরা আজ তিনদিন ধরে কী করছে? মনিরুলের বোন দিল আফরোজ রোজি বলেন, তার ভাইয়ের একটি মেয়ে আছে। তেমন কোন সঞ্চয় তিনি রেখে যাননি। ফলে ভবিষ্যত নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তায় পড়েছে তার পরিবার। জালালাবাদ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনিরুলের বাড়ি নোয়াখালী জেলা সদরের মান্নান নগরে। রবিবার সকালে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে লাশ নিতে আসেন তাঁর ভাই সাইফুল ইসলাম শামীম ও বোন দিল আফরোজা রোজী। এ সময় হাসপাতালে হৃদয় বিদারক পরিস্থিতি তৈরি হয়। ভাইয়ের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তারা। সেখানে উপস্থিত লোকজনের বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। বক্তব্য নিতে গিয়ে চোখের জল আটকে রাখতে পারেননি সংবাদকর্মীরাও। রবিউলের ভাই সাইফুল জানান, তারা চার ভাই ও তিন বোন। দীর্ঘদিন থেকে মনিরুল সিলেটে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন। ব্যক্তি জীবনে বিবাহিত মনিরুলের ১৫ মাস বয়সের এক পুত্র আছে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাইফুল বলেন, আমার ভাইয়ের কি দোষ? প্রসাশনের মানুষ হয়েও যদি নিরাপত্তা না থাকে তাহলে কোথায় যাব? ১৫ মাসের ভাতিজা এতিম হলো, তার কি হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আহ্বান জানাই আমার ভাতিজার দায়িত্ব নিন। সে দেশের কাজ করতে গিয়ে শহীদ হয়েছে। মনিরের বোন রোজি অভিযোগ করে বলেন, আহত উর্ধতন অফিসারদের ঢাকায় পাঠানো হলো, আমার ভাইকে কেন নেয়া হলো না? আমরা প্লেনের ভাড়াও দিতে বলেছি। জরুরীভিত্তিতে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হলে হয়ত আমার ভাই বাঁচত। সিলেট সিটি এসবির ওসি (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম মৃত নুরুল ইসলামের ছেলে। তার মৃত্যুতে ওই গ্রামে এখন চলছে শোকের মাতম। শনিবার সন্ধ্যায় সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার শিববাড়ি এলাকায় জঙ্গীবিরোধী অভিযানস্থলের বাইরে পরপর দুটি বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় মনিরুল ইসলাম গুরুতর আহত হন। পরে রবিবার রাত ২টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। জানা যায়, মৃত নুরুল ইসলামের চার ছেলে ও তিন মেয়ে সন্তানের মধ্যে মনিরুল ছিলেন দ্বিতীয়। তিনি ২০০৩ সালে উপ-পরিদর্শক হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন। পরে পদ্দোন্নতি পেয়ে পুলিশের পরিদর্শক হিসেবে সিলেটের সিটি এসবি শাখায় বদলি হন। এরপর থেকে তিনি সেখানেই কর্মরত ছিলেন। ২০১০ সালে বিয়ে করেন মনিরুল। তাদের সংসারে মোজাক্কেরুল ইসলাম ফরাবি নামের এক বছর ৬ মাসের এক ছেলে সন্তান রয়েছে। স্বামীর মৃত্যুর সংবাদ শুনে হতবাক হয়ে পড়েছেন স্ত্রী পারভিন আক্তার। অন্যদিকে ছেলের মৃত্যুতে বৃদ্ধ মা আমেনা খাতুন মুর্ছা যাচ্ছেন বারবার। মৃত্যুর সংবাদে পুরো এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া। নিহতের বড় ভাই সোহাগ জানান, শুক্রবার ছোট ভাই সাইফুল ইসলামের বিয়েতে যোগ দিতে গ্রামের বাড়ি আসেন মনিরুল। অনুষ্ঠান শেষে কর্মস্থলে যোগ দিতে শনিবার ভোরেই সিলেট রওয়ানা হন। বিকেল ৩টায় কর্মস্থলে যোগ দেন তিনি। কর্মরত অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রে বোমা বিস্ফোরক বিষয়ে এক বছরের বিশেষ প্রশিক্ষণ নেন মনিরুল। কর্মস্থলে বেশ প্রশংসিতও হন তিনি। পরিবারকে সমবেদনা জানাতে নিহতের বাড়িতে ছুটে যায় সুধারাম মডেল থানা পুলিশের একটি দল। রবিবার দুপুর ২টায় সিলেট পুলিশ লাইন মাঠে জানাজা শেষে মনিরুলের মরদেহ নোয়াখালীতে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে সেখানে দ্বিতীয় দফা জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করার কথা রয়েছে। অন্যদিকে বোমা বিস্ফোরণে নিহত সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের পরিদর্শক চৌধুরী আবু কয়ছর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে তাঁর পরিবারসহ গোটা সুনামগঞ্জ শহরে। রবিবার সন্ধ্যায় তাকে দাফন করা হয়। তার মৃত্যুর সংবাদ শুনে স্বজন হারিয়ে বিলাপ করছেন পরিবারের লোকজন। প্রতিবেশীরা এসে তাঁদের সান্ত¡না দিচ্ছেন। আর স্মৃতিচারণ করছেন চৌধুরী আবু কয়ছরের নির্লোভ ও সুন্দর জীবনের। নিহত কয়ছরের সহপাঠী, বন্ধু ও স্বজনরা জানান, একজন সৎ, সাহসী, বিনয়ী ও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি হিসেবে পাড়ায় ও বন্ধুমহলে তার ব্যাপক পরিচিতি ছিল। তিনি আমেরিকায় যাওয়ার ডিভি লটারি পেয়েও উন্নত জীবন যাপনের সুযোগ ছুড়ে ফেলে দেশে ফিরে এসে মানুষের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। শেষ পর্যন্ত দেশের জন্য কাজ করতে গিয়েই তিনি শহীদ হয়েছেন। তাঁর স্বজন ও প্রতিবেশীরা এই নির্লোভ ও সৎ পুলিশ অফিসার জঙ্গী হামলায় নিহতের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে জঙ্গী নির্মূলে সর্বাত্মক অভিযান চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন। রবিবার বিকেলে চৌধুরী আবু কয়ছর এর মরদেহ সুনামগঞ্জ নিয়ে যাওয়া হয়। সুনামগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক চৌধুরী আছদ্দর আলী মোক্তারের ৭ ছেলের মধ্যে তৃতীয় ছিলেন কয়ছর। ১৯৭১ সনে সুনামগঞ্জ শহরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যে ৫টি বাড়িতে আগুন জ্বালিয়েছিল, এর মধ্যে একটি ছিল তাঁদের। ১৯৯১ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স শেষে পুলিশ বাহিনীতে সহকারী পরিদর্শক হিসেবে যোগদান করেছিলেন তিনি। ওসমানী হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে মাহবুবুল হক জানান, শনিবার সন্ধ্যায় ঘটনার পরে ৫০ জনকে ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। এর মধ্যে চারজন ছিলেন মৃত। রাতেই র‌্যাব কর্মকর্তা লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। বাকি ৪৫ জনের মধ্যে দুজন পরে মারা গেছেন। বর্তমানে হাসপাতালে ২৬ জন চিকিৎসাধীন আছেন জানিয়ে মাহবুবুল হক বলেন, ১৭ জন চিকিৎসা নিয়ে ফিরে গেছেন। তিনি বলেন, ঘটনার পরই হাসপাতালের সকল ডাক্তার, নার্স, কর্মকর্তা, কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়। দ্রুততম সময়ে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করায় আর কোন প্রাণহানি ঘটেনি। এদিকে, নিহত ছয় জনের মধ্যে ৩ জনের ময়নাদন্ত শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওসমানী হাসপাতালের পরিচালক। তার মধ্যে দুই পুলিশ কর্মকর্তাও রয়েছেন। নিহত বাকি তিন জনের ময়নাতদন্ত অপেক্ষায় রয়েছে।
×