ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

’৫২-এর ২১ শে ॥ ঝিনেদায় নারী মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন বেলা

প্রকাশিত: ০৬:৪৭, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

’৫২-এর ২১ শে ॥ ঝিনেদায় নারী মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন বেলা

বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে সারাদেশে ২১ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট আহ্বানে মফস্বলের ক্ষুদ্র শহর ঝিনাইদহও সাড়া দিয়েছিল। সেখানেও বিক্ষোভ মিছিল হয়েছিল নারী-পুরুষের। তার আগে ঝিনাইদহে আর কখনও ছাত্রীদের মিছিল হয়নি। ছাত্রীদের সেই মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন মাসুদা বেগম। ডাকনাম বেলা। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে ঢাকা যখন উত্তপ্ত সুদূর ঝিনাইদহ কিন্তু মোটেও তেমন ছিল না। ঢাকার ভাষা আন্দোলনের ঢেউ তখনও ঝিনাইদহে গিয়ে দোলা দেয়নি। বলাই বাহুল্য, যোগাযোগের অভাব তখন ছিল মস্ত একটা ব্যাপার। বিভিন্ন লেখালেখি থেকে জানা যায়, ১৯৫২ সালেও বহির্জগতের সঙ্গে ঝিনাইদহের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ খুব একটা ছিল না। খোদ জেলা সদর যশোরের সঙ্গেই যোগাযোগ যেখানে খুব একটা গভীর ছিল না সেখানে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংযোগ তো ঢের বেশি দুর্বল হওয়ারই কথা। রাজনৈতিক দলগুলোর তেমন কোন কর্মকা- ছিল না। বিরোধীদলীয় ছাত্র সংগঠন নিখিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ তত দিনে গঠিত হলেও ঝিনাইদহের ছাত্রসমাজের ওপর তার প্রভাব সেভাবে এসে পড়েনি। আবারও উল্লেখ করতে হয় এর কারণ মূলত, সুষ্ঠু যোগাযোগের অভাব। ঝিনাইদহ শহরে হাতেগোনা দু’তিনটি বাড়িতেই কেবল রেডিও ছিল। রাজধানী ঢাকা থেকে খবরের কাগজ যেত শুধু আজাদ। তাও ১০-১২ কপির বেশি নয়। সাপ্তাহিক ইত্তেফাক যেত অনিয়মিত। ঝিনাইদহের সম্পন্ন ও শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সিংহভাগই রাখত স্টেটসম্যান যা আসত কলকাতা থেকে। তবে ওতে ঢাকার রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের খবর সামান্যই থাকত। রাজধানী ঢাকা বা যশোর জেলা সদরের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক খবরের সিংহভাগই পাওয়া যেত এসব জায়গায় যাওয়া আসারত ছাত্রদের কাছ থেকে। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের সময় ঝিনাইদহে কোন কলেজ ছিল না। স্কুল ছিল দুটি। একটি ছেলেদের অন্যটি মেয়েদের। ছেলেদের স্কুলটির নাম ঝিনাইদহ হাই ইংলিশ স্কুল। ক্লাস টেন পর্যন্ত। মেয়েদেরটা ক্লাস এইট পর্যন্ত। নাম ঝিনাইদহ গার্লস স্কুল। ঢাকায় ছাত্ররা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন করছে এ কথা ঝিনাইদহের ছাত্রসমাজ জানত না তা নয়। তাদের মধ্যে এনিয়ে আলোচনা হতো, যুক্তিতর্ক হতো। কিন্তু আন্দোলনে নেমেপড়া বলতে যা বোঝায় সেটা তখনও হয়নি। বায়ান্নোর ফেব্রুয়ারি মাসের একদিন ঢাকা থেকে জনৈক ছাত্রের মাধ্যেমে ঝিনাইদহ হাইস্কুলের ছাত্রনেতাদের কাছে কিছু ইশতেহার আসে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠাতার দাবিতে লেখা সেই ইশতেহারটি জনসাধারণের মাঝে বিলি করার জন্য দেয়া হয়। এরই মধ্যে জানাজানি হয়ে যায় যে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ২১ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে হরতাল ডেকেছে ঢাকার সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। সিদ্ধান্তটি হাইস্কুলের ছাত্রদের আলোড়িত করে। তারা ঠিক করে সারা দেশের এই আন্দোলন থেকে তারা বিচ্ছিন্ন থাকবে না। হরতাল অবশ্যই করবে। কিন্তু কিভাবে করতে হয় তা তাদের জানা ছিল না। এনিয়ে স্কুলের সিনিয়র কিছু ছাত্র প্রথমে নিজেদের মধ্যে আলাপ করে। পড়ে শহরেরই দু’চারজন সুজন ব্যক্তি যারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সমর্থক তাদের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হয়। ঠিক হয় ২১ ফেব্রুয়ারি কোন ক্লাস হবে না। দোকানপাট খুলবে না। যানবাহন চলবে না। অর্থাৎ এগুলো হতে দেয়া হবে না। তার জন্য প্রচারপত্র বিলি করা হবে। পোস্টার লাগাতে হবে। ঝিনাইদহ হাই ইংলিশ স্কুলে হরতালের দিন যে ক্লাস হবে না তা নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল। মোটামুটি সব ছাত্রই হরতালের পক্ষে এককাট্টা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সমস্যা বাধল গার্লস স্কুল নিয়ে। সমস্যা সমাধানের জন্য স্কুলের প্রধান শিক্ষয়িত্রী মনোয়ারা আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করার ও তার সাহায্য চাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। এখানে মনোয়ারা আহমেদ সম্পর্কে দুটি কথা না বললেই নয়। তিনি ছিলেন সংস্কার মুক্ত, প্রগতিশীল ও তেজস্বী একজন মহিলা। ঝিনেদার সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে তিনি নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। অনেক রক্তচক্ষুকেও তিনি অবলীলায় অগ্রাহ্য করেছিলেন। তাঁর স্বামী ডাঃ কে. আহমেদ ছিলেন ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। মনোয়ারা আহমেদের বড় ছেলে বিশিষ্ট সাংবাদিক মনজুর আহমেদ বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী। মিসেস মনোয়ারা আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব দেয়া হয় তৎকালীন ছাত্রনেতা আনোয়ার জাহিদের ওপর। তাঁর সঙ্গে এই পরিবারটির ভাল যোগাযোগ ছিল। ডাঃ ও মিসেস আহমেদ দুজনেরই স্নেহাস্পদ ছিলেন তিনি। গার্লস স্কুলের মেয়েদের কিভাবে আন্দোলনে আনা যায় সে ব্যাপারে মিসেস মনোয়ারার পরামর্শ চাওয়া হলো। মিসেস মনোয়ারা বিকেলে আবার আসতে বললেন। বিকেলে গেলে ক্লাস এইটের দুজন মেয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় যারা এই আন্দোলনে মেয়েদের সংগঠিত ও সংশ্লিষ্ট করতে রাজি। শুধু কিভাবে করতে হবে সে ব্যাপারে বুদ্ধি পরামর্শ চাইল তারা। তাদের একজনের নাম বেলা। ১৯ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহ শহরের বিভিন্ন জায়গায় পোস্টার পড়ল ২১-এর হরতালের সমর্থনে। কিন্তু ২০ ফেব্রুয়ারি সকালেই সেগুলো হাওয়া। সরকারী মহলের লোকজন সেগুলো তুলে নিয়েছে। ২০ ফেব্রুয়ারি আবার পোস্টার পড়ল। ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল বেলা ছাত্ররা রাস্তায় নামার আগেই পুলিশ নেমে গেছে। কিন্তু দোকানপাট, যানবাহনবান্ধব ব্যাপারে প্রথম দিকে একটু বচসার মতো হলেও মারামারি হয়নি। পরে ব্যবসায়ী সমিতির হস্তক্ষেপে ঠিক হয় দুপুরের পর বাজার হাট খুলবে। দশটার দিকে ছাত্রদের মিছিল নামল রাস্তায়। এবং পরপরই মেয়েদের মিছিল। মিছিলের নেতৃত্বে ছিল বেলা। মিছিলের অগ্রভাগে পতাকাবাহীদের মধ্যে তার ছোট বোন ইলাও ছিল। মেয়েদের মিছিল যে এত বড় হবে কেউ ভাবেনি। ঝিনেদাতে এর আগে মেয়েদের কোন মিছিলও হয়নি। মিছিলে সেøাগান ওঠে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা, দিতে হবে দিতে হবে’ উর্দু ভাষা চাই না চাই না।’ মিছিলটি প্রধান প্রধান সড়ক হয়ে এসডিও অফিস অভিমুখে অগ্রসর হলো স্মারকলিপি দেয়ার জন্য। বেলার পুরো নাম মাসুদা বেগম। তাঁর বাবা একরামুল হক তখন ঝিনাইদহের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। এসডিও দুটিতে থাকায় তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারি এ্যাডভোকেটরাও ঝিনাইদহের কোর্ট বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু একরামুল হক সে কাজে তাদের নিবৃত্ত করে। বলেন ‘কথা দিচ্ছি আজ কোর্ট বসবে না’। বস্তুত সে দিন ঝিনাইদহের কোন কোর্ট বসেনি। অফিসের অন্যান্য রুটিন কাজকর্ম হলেও মামলার কোন কাজ হয়নি। ছাত্রছাত্রীদের মিছিল এসডিও অফিসে এসে শেষ হয়। একরামুল হক ও এসডিপিও আবদুল মান্নান তখন সেখানে উপস্থিত। তারা মিছিলের নেতৃত্বদানকারী কজনকে ডেকে এনে জানিয়ে দেন মিছিল শেষ করে চলে যেতে। জনসভা কিছুতেই করা যাবে না। তাদের কণ্ঠে সহানুভূতির সুর ছিল। বস্তুত জনসভার কোন কর্মসূচী সে দিন ছিল না। কাজেই মিছিল শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে দিবসের কর্মসূচীও শেষ হয়। কিন্তু নমনীয় ভূমিকা প্রদর্শনের জন্য একরামুল হককে ওপর মহলের ঝক্কি পোহাতে হয়েছিল। মিসেস মনোয়ারাকে বিদ্রুপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। বায়ান্নোর ২১ শের সেই নারী মিছিলের নেতৃত্বদানকারী বেলা তথা মাসুদা বেগম ঢাকার বদরুন্নেসা কলেজের সমাজবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপিকা থাকাবস্থায় ১৯৮৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
×