ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অরক্ষিত ম্যানহোল নিয়ে নির্বিকার ওয়াসা-সিটি কর্পোরেশন

প্রধান সড়ক থেকে অলিগলি- মৃত্যুকূপের ছড়াছড়ি

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ২৮ জানুয়ারি ২০১৭

প্রধান সড়ক থেকে অলিগলি- মৃত্যুকূপের ছড়াছড়ি

আরাফাত মুন্না ॥ রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেন রোড। হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল থেকে নেভি হাউস পর্যন্ত রাস্তায় অন্তত ১৫টি ম্যানহোল। রাস্তার ঠিক মাঝামাঝি এই ম্যানহোলগুলোর কোনটি সড়ক থেকে তিন থেকে চার ইঞ্চি উঁচু, আবার কোনটি তিন থেকে চার ইঞ্চি নিচু। এই পথে যেতে সব গাড়ির চালককেই বেগ পেতে হয়। মাঝে মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার খবরও আসে। টিএসসি মোড় থেকে দোয়েল চত্বর যেতে ওই রাস্তার চারটি ম্যানহোল সড়ক থেকে অনেকটাই গভীর। এর একটির গভীরতা ৬ ইঞ্চির বেশি পাওয়া গেছে। রাজধানীর কোন কোন সড়কে আবার উন্মুক্ত ম্যানহোলও দেখা গেছে। শুধু ইস্কাটন গার্ডেন ও টিএসসি-দোয়েল চত্বর সড়কই নয়, রাজধানীর অধিকাংশ রাস্তায়ই এমন অরক্ষিত ম্যানহোল বাড়িয়ে দেয় দুর্ঘটনার ঝুঁকি। শাহজাহানপুরের শিশু জিহাদ আর শ্যামপুরের নীরবের করুণ মৃত্যুতেও টনক নড়েনি ঢাকা ওয়াসা ও সিটি কর্পোরেশনের। শিশু জিহাদ আর নীরবের মৃত্যুর পর নগরীর ঢাকনাবিহীন ম্যানহোলের তথ্য জানতে চান হাইকোর্ট। তালিকা চূড়ান্ত করতে কাউন্সিলরদের সমন্বয়ে একটি কমিটিও করে দুই সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু কমিটি কাগজপত্রেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। সে তালিকা আর চূড়ান্ত হয়নি আজও। নগরবাসীকে ম্যানহোলের তথ্য জানাতে চালু করা হয় হটলাইন ১৬১৬২। এই নাম্বারে ফোন করে ঢাকনাবিহীন ম্যানহোলের তথ্য দিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই তা পুনঃস্থাপন করার কথা ছিল। কিন্তু সম্প্রতি ফোন করে দেখা গেছে নম্বরটি অকেজো। সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর রামপুরা ব্রিজ থেকে বাড্ডা লিংক রোড পর্যন্ত সড়কে ৭টি ম্যানহোল উন্মুক্ত অবস্থায় রয়েছে। ব্যস্ততম এ সড়কটি দিয়ে প্রতিদিন শত শত যানবাহন চলাচল করে। বনশ্রী এলাকার বিভিন্ন ব্লকেও একই চিত্র দেখা গেছে। একই অবস্থা মেরাদিয়া হাট থেকে দক্ষিণ বনশ্রী কাজীবাড়ী সড়কে। এ সড়কটির মাঝপথেই রয়েছে কয়েকটি ঢাকনাহীন ম্যানহোল। এছাড়া কাকরাইল, শান্তিনগর, মালিবাগ, মৌচাক, মালিবাগ রেলগেট, শান্তিবাগ, রামপুরা, সেগুনবাগিচা, গুলশান, বনানী, বারিধারার বিভিন্ন সড়কে উন্মুক্ত ম্যানহোল দেখা গেছে। কোথাও শুধু একটি বাঁশ বা কাঠের টুকরা দাঁড় করিয়ে সতর্ক চিহ্ন দিয়ে রেখেছেন স্থানীয়রা। তবে এসব বিষয়ে একেবারেই উদাসীন ওয়াসা-ডিসিসি। নগরীর প্রতিটি প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলি পর্যন্ত এমন চিত্র দেখা গেছে। একটু বেখেয়ালে চললেই ঘটবে দুর্ঘটনা। বিশেষ করে শিশুদের জন্য এসব ম্যানহোল মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, রাজধানীর অলিগলি সর্বত্রই এমন ঢাকনাবিহীন ম্যানহোলের ছড়াছড়ি। এসব ম্যানহোলের মধ্যে পা পিছলে পড়ে প্রতিনিয়ত কেউ না কেউ আহত হচ্ছেন। পুরান ঢাকা, শ্যামপুর, যাত্রাবাড়ী, শাহাজানপুর, ভাটারা, নূরেরচালা, শাহজাদপুর, রামপুরাসহ প্রায় এলাকায় এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ড্রেন, নর্দমা, খোলা স্যুয়ারেজ ও ম্যানহোল রয়েছে, যা এখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। নগরবাসীর অভিযোগ, নগরীর পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন করতে ম্যানহোল ও স্যুয়ারেজ লাইন স্থাপন করা হয়। কিন্তু ঢাকনাগুলো অত্যন্ত দুর্বল হওয়ায় খুব অল্প সময়েই ভেঙে যায়। তাছাড়া ভাসমান হকার ও ভাঙ্গাড়ি ব্যবসায়ীরা এসব ঢাকনা চুরি করে নিয়ে যায়। অপরদিকে কিছু কিছু ম্যানহোলের ঢাকা কংক্রিটের তৈরি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ঢাকনাগুলো দায়সারাভাবেই নির্মাণ করে চলে যায়। কিন্তু নির্মাণের পরপরই এসব ম্যানহোল ভেঙ্গে পড়ে। এরপর পুনরায় সহজে তা স্থাপন করা হয় না। এ বিষয়ে ইস্কাটন গার্ডেন এলাকার বাসিন্দা মোনায়েম সিদ্দিক জনকণ্ঠকে বলেন, ইস্কাটন গার্ডেনের এই রাস্তা দিয়ে মোটরসাইকেল চালাতে খুব সমস্যায় পড়তে হয়। এই অল্প রাস্তায় অনেক ম্যানহোল, এর মধ্যে কোনটি উঁচু আবার কোনটি নিচু। একটু খেয়াল না করলেই দুর্ঘটনা ঘটতে পাড়ে। এই ম্যানহোলগুলো সড়কের সমান হওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন। গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন জানান, রাজধানীর অধিকাংশ ম্যানহোল ঢাকা ওয়াসার নিয়ন্ত্রণাধীন। ঢাকা ওয়াসার নিয়ন্ত্রণে থাকা ম্যানহোলের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। এর মধ্যে ড্রেনেজ লাইনের ওপর প্রায় ১১ হাজার এবং স্যুয়ারেজ লাইনের ওপর প্রায় ২৯ হাজার ম্যানহোল রয়েছে। জানা গেছে, শুধু ঢাকা ওয়াসা ও দুই সিটি ছাড়াও নগরীতে ডেসা, টিএ্যান্ডটি, বাংলাদেশ রেলওয়ে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), বিটিসিএ ও বেসরকারী মোবাইল অপারেটর কোম্পানিসহ বিভিন্ন সংস্থার ম্যানহোল রয়েছে। নগরীর স্যুয়ারেজ ও পানি নিষ্কাশনের লাইনে এই ম্যানহোলগুলো স্থাপিত। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের গভীর ও অগভীর ড্রেন রয়েছে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ডিএসসিসির ১৪ হাজার ২৪০টি ম্যানহোল রয়েছে। ঢাকা ওয়াসার গভীর ড্রেন রয়েছে ৩৪৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে ম্যানহোল রয়েছে ১৮ হাজার ৩৫৮। ঢাকা উত্তর সিটির গভীর-অগভীর ড্রেনের পরিমাণ ২ হাজার ৬০০ কিলোমিটার। এসব ড্রেনের ওপর সø্যাব সিস্টেমের ম্যানহোল তৈরি করা হয়েছে। দুর্ঘটনার পর দুর্ঘটনাকবলিত ম্যানহোল ও স্যুয়ারেজ লাইনটি কার তা স্বীকার করতে কেউ রাজি হয়নি। শাহজাহানপুরের ঘটনায় ঢাকা ওয়াসা প্রথমে তার দায় এড়িয়ে রেলওয়ের ওপর চাপাতে চেয়েছিল। যদিও পরে তা স্বীকার করতে বাধ্য হয়। তবে এসব মৃত্যুর জন্য নগরবাসীর পক্ষ থেকে বারবারই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতাকেই দায়ী করা হয়েছে। এসব বিষয়ে সম্প্রতি এক সভায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বলেছেন, আমরা সেবাদানকারী প্রতিটি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের উদ্যোগ নিয়েছি। ম্যানহোলগুলোর বেশকিছু ঢাকনা ওয়াসার। তাছাড়া চলতি অর্থবছর নগরীর রাস্তাঘাট ও ড্রেন মেরামতে দুই হাজার কোটি টাকার কাজ চলমান। খুব অল্প সময়ের মধ্যে সমাধান হয়ে যাবে।
×