ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চৌধুরী শহীদ কাদের

দুঃসময়ের বন্ধু

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬

দুঃসময়ের বন্ধু

১১ আগস্ট ১৯৭১ আগরতলা কেন্দ্রীয় কারাগারের বন্দীরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবৈধ গ্রেফতারের প্রতিবাদে দুপুরে অনশন পালন করেন এবং তাদের দুপুরের খাবারের জন্য বরাদ্দকৃত ৩৫০ টাকা বাংলাদেশ ত্রাণ তহবিলে দান করেন। ত্রিপুরার মহারানী তুলসীবতী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রায় চার শ’ শিক্ষার্থী একাত্তরের এপ্রিল মাসে এক সপ্তাহ টিফিন করা থেকে বিরত থাকেন। টিফিনের টাকা জমিয়ে তারা প্রায় ২ হাজার টাকা দান করেন বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ‘বাংলাদেশ ত্রাণ তহবিলে’। মুর্শিদাবাদের সীমান্তবর্তী শেখপাড়ার স্কুল শিক্ষক আবদুর রশিদ একাত্তরের নয় মাস শরণার্থী ক্যাম্পে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করেছেন। নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন ৩টি পরিবারের ১৬ জন শরণার্থীকে। কলকাতা আর্ট কলেজের এম এ ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র বিষ্ণু দাস, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে সংঘটিত পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যা নারী-নির্যাতনকে রঙ-তুলিতে ফুটিয়ে তুলে এঁকে ফেলেন ১০টি চিত্রকর্ম। ভাবতে লাগলেন এগুলো কীভাবে সাধারণের নজরে আনা যায়। আগস্টের মাঝামাঝি একদিন ছবিগুলো নিয়ে বসে পড়লেন স্টেটসম্যান অফিসের সামনে। পথচারী, বিদেশী সাংবাদিক, শরণার্থীরা দেখেন তার রঙ-তুলিতে পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বরতার চিত্র। বিক্রি হয়ে গেল ৯টি ছবি। সেই অর্থ তিনি দান করলেন বাংলাদেশ ত্রাণ তহবিলে। শিলংয়ের অঞ্জলি লাহিড়ী মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস শরণার্থী সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। ঘুরে বেরিয়েছেন ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে। সংগ্রহ করেছেন বাড়ি বাড়ি ঘুরে ত্রাণ। মুক্তিযুদ্ধে বীরবিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎ জ্যোতিকে নিয়ে লিখেছেন বই। প্রচ- কষ্ট পেয়েছিলেন যখন শুনেছিলেন ধরা পড়ার পর পাকিস্তানী বাহিনী গ্রামের মানুষজনকে আতঙ্কিত করার জন্য তার লাশ গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখেছিল। শাহরিয়ার কবিরের ‘দুঃসময়ের বন্ধু’ প্রামাণ্যচিত্রে অঞ্জলি লাহিড়ীর সেই স্মৃতিচারণ অশ্রুসিক্ত করে সবাইকে। মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের খাগড়া গ্রামের বাসিন্দা ঈপ্সিতা গুপ্ত, একাত্তরে বহরমপুরে আশ্রিত শরণার্থীদের সেবায় গড়ে তুলেছিলেন ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সহায়তা সমিতি’। স্থানীয় বেশকিছু লোকজনকে সংগঠিত করে বহরমপুরম, লালগোলা, শেখপাড়া, জলাঙ্গী এলাকায় শরণার্থী সহায়তায় ত্রাণ সংগ্রহ করেছেন, আহত অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। সাধারণ লোকজনকে উৎসাহ-উদ্দীপনা দিয়ে সম্পৃক্ত করেছেন শরণার্থী সহায়তায়। স্বামী প্রখ্যাত আরএসপি নেতা রাধারজন গুপ্তের সাপ্তাহিক ‘জনমত’ পত্রিকায় একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের নানা সংবাদ প্রচার করে চেষ্টা করেছেন বাংলাদেশের সমর্থনে জনমত সৃষ্টির। মুক্তিযুদ্ধের সময় নাম না জানা ৫২ জন মুক্তিযোদ্ধাদের কবর দিয়েছিলেন শিলংয়ের আহমদ হোসেন ও মোজাফফর হোসেন ভাতৃদ্বয়। একদিন সকালে শিলং-এ তাঁর বাড়িতে উপস্থিত হয়ে জানতে চেয়েছিলাম সেই অজানা লাশ দাফনের কাহিনী। বলছিলেন সেই সময়ের কথা, স্থানীয় সেনাবহিনীর অনুরোধে তারা লাশ দাফনের সিদ্ধান্ত নেয়। গঠন করে বেওয়ারিশ লাশ দাফন কমিটি। ধর্মীয় রীতিতে একে একে একাত্তরে দাফন করেন ৫২টি লাশ। কিন্তু একাত্তরের পরে কেটে যায় ৪০ বছর কেউ খবর নিতে আসে না। ৪০ বছর পর কর্নেল সাজ্জাদ জহির খুঁজে বের করেন সেই দুই ভ্রাতা ও নাম না জানা ৫২ জন শহীদের করব। বাংলাদেশের শরণার্থীদের সহায়তায় কিংবা রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একাত্তরে অকাতরে দান করেছেন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সীমান্তবর্তী রাজ্যসমূহের সাধারণ মানুষজন। একাত্তরের পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে বিভিন্ন রাজ্যের শ্রমিক ইউনিয়ন, শিক্ষক সমিতি, পেশাজীবী সংগঠন, নারী সংগঠন, গৃহবধূ, রাজনৈতিক কর্মী, স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের সহায়তার নানা সংবাদ। একাত্তরের কলকাতার অমৃতবাজার পত্রিকার ২৫ মে সংখ্যায় চোখ আটকে যায়। পশ্চিমবঙ্গের হাসনাবাদের এক শ’ রিকশাশ্রমিক তাদের সারাদিনের উপার্জন দান করেছে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। ত্রিপুরার উদয়পুরের রিকশা শ্রমিকরা রাজপথে মিছিল বের করেছিল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য। বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে, তরুণ সম্প্রদায় পাড়ায় পাড়ায় মুষ্টি ভিক্ষা সংগ্রহ করে, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে, লটারি ও প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করে, জেলখানার কয়েদিরা অভুক্ত থেকে, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী-কর্মকর্তারা এক বা অর্ধদিনের বেতন দিয়ে, শিল্পী ছবি এঁকে ইত্যাদি নানাবিধ কর্মকা-ের মাধ্যমে উত্তর-পূর্ব ভারতের তৃণমূল জনগণ অর্থ সংগ্রহ করেছে। এসব সংগৃহীত অর্থ শরণার্থীদের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। আবার অন্যদিকে এই অর্থ দ্বারা মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও চিকিৎসা সহায়তা দেয়া হয়েছে। ত্রিপুরার সোনামুড়া সীমান্ত এলাকায় কথা হচ্ছিল ছমিরন বিবির সঙ্গে। বলছিলেন, একাত্তরে আমার অধিকাংশ সময় কেটেছে উনুনে বসে। এমনও হয়েছে দিনে ২০ বার ভাত রান্না করেছি। আমার স্বামী ছিল বড় গৃহস্থ। ধান চালের কোন অভাব ছিল না। এপ্রিলের শুরুতে যখন আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে শত শত অভুক্ত লোক ভারতে প্রবেশ শুরু করে, তাদের করুণ কাহিনী, পথের কষ্ট, স্বজনহারানোর বেদনা আমার স্বামী রমজান আলীকে আহত করে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যারাই এই পাশ হয়ে ভারতে ঢুকবে তাদের তিনি ভাত আর আলু, ডাল দিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করবেন। এপ্রিলের শুরু থেকে পুরো মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় পর্যন্ত আমাদের ঘরটি ছিল শরণার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। প্রতিদিন গড়ে ১০০-১৫০ লোক আহার করেছে আমাদের ঘরে। অনেকে নিয়েছে আশ্রয়। যারা অবরুদ্ধ বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে শরণার্থী হয়েছেন তাদের পথের সেই কষ্ট বোঝা যায় একাত্তরের অন্যতম বন্ধু ত্রিপুরার অন্যতম নারী সংগঠক দীপ্তিরায় চৌধুরীর বর্ণনায়, ‘আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল ওদের খাওয়াটা দেখে যে মানুষ কতোখানি ক্ষুধার্ত হলে এ রকম ভিজে চিড়ে শুধু চিনি দিয়ে খেতে পারে।’ বিলোনিয়ার বর্ডার চেকপোস্ট ঘেঁষে বাড়ি দুলাল মহাজনের। পূর্ববঙ্গের চট্টগ্রামে আদি নিবাস। চল্লিশের দশকে বিলোনিয়া এসে বসতি গড়েছে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দুলাল মহাজনের পূর্বপুরুষের ভিটা থেকে আত্মীয় পরিচিত ৪টি পরিবারের ২৫ জন লোক তার বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সীমান্তের প্রান্তিক এই পরিবারটি সর্বস্ব নিয়ে পাশে এসে সহায়তা করে এই ৪টি পরিবারকে। একাত্তরের মুক্তিসংগ্রাম উত্তরপূর্ব ভারতের সীমান্তবর্তী জনপদে লক্ষাধিক বিপন্ন নর-নারী-শিশু আশ্রয় নিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ এসব রাজ্যের মানুষের প্রাত্যহিক জীবন, আর্থ-সামাজিক স্থিতি ও বসবাসকে বিপন্ন করেছিল। রক্তে রণন, চেতনায় দ্রোহ ঢেলে ফেলে আসা জীবনের কথা মনে করিয়েছিল অনেককেই। একাত্তরের মুক্তিসংগ্রাম এখানে এসে সত্যিকার জনযুদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করেছে। সভা, সমিতি, বিক্ষোভ মিছিল, শোভাযাত্রায় জীবন যাত্রার অষ্টপ্রহর ছিল কোলাহলমুখর। কত শতবার যে ইয়াহিয়া ভুট্টোর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। সীমান্তবর্তী এই উত্তরপূর্ব ভারতের প্রত্যেকটি নাগরিক কোন না কোনভাবে জড়িয়ে পড়েছিল এক জনযুদ্ধে। গ্রামের খুব সাধারণ গৃহস্থ নিজের আহার যোগানোটা যার কাছে অনেক কঠিন, আশ্রয় দিয়েছেন কোন উদ্বাস্তু পরিবারকে। যার পক্ষে আশ্রয় দেয়া সম্ভব হয়নি সেই হয়ত পুকুরের একটি মাছ, কিংবা একটি কচু, শাক বা দু’মুঠো চাল দিয়ে সহায়তা করেছেন কোন এক শরণার্থীকে। ড. সরওয়ার আলী লিখেছেন, তিনি তাঁর কয়েক মাসের শিশুসন্তানের জন্য রাস্তার মোড়ের দোকান থেকে বোতলের দুধ নিয়ে আসতেন। তাঁর চেকলুঙ্গি দেখে দোকানি তাকে শরণার্থী হিসেবে শনাক্ত করে এবং এরপর থেকে দুধের দাম নিতে অসম্মতি জানায়। পাড়ার যুবক থেকে শুরু করে, স্কুল পড়ুয়া ছেলেটি, বয়স্ক প্রোঢ় লোকটি, স্কুল কিংবা কলেজ পড়ুয়া তরুণীটি কখনও বা শরণার্থী ক্যাম্পে, কখনও বা ত্রাণ সংগ্রহে, কখনও বা মিছিলে দীর্ঘ নয় মাস জড়িয়ে পড়েছিল এক অন্যরকম জনযুদ্ধে। পরিণত হয়েছিল আমাদের দুঃসময়ের অন্যতম বন্ধুতে।
×