ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মফিদুল হক

হেনরি কিসিঞ্জার তৈরি করেন বুদ্ধিজীবী হত্যার সুযোগ

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬

হেনরি কিসিঞ্জার তৈরি করেন বুদ্ধিজীবী হত্যার সুযোগ

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বের কিছু ঘটনা এখনও তলিয়ে দেখার রয়েছে, তথ্যানুসন্ধান ও তথ্য-বিশ্লেষণের আরও কাজ আরাধ্য রয়ে গেছে। পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের দিনটি ঘিরে অনেক প্রশ্ন জাগে। যুদ্ধের সেই শেষ ক্ষণে অনেক স্থানে চলছিল অনেক খেলা, যুদ্ধের ময়দান তার কেবল একটি দিক মেলে ধরে। পাকিস্তানীদের পরাজয় বরণ অবধারিত ছিল, কিন্তু সেটা কি ১৬ ডিসেম্বরে হওয়ার ছিল, নাকি এর আগেও ঘটতে পারত? তেমন সম্ভাবনার ক্ষেত্রে দেখতে হয় বিলম্ব যদি ঘটে তবে এর জন্য দায়ী কারা বা কোন্ ঘটনা? ৩ ডিসেম্বর ভারত-পাক সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলে দ্রুতগতিতে ঢাকার দিকে ধাবিত হতে থাকে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর উদ্যোগে গঠিত যৌথ বাহিনী। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের মধ্যে তখন দিশেহারা ভাব। তারা তো যুদ্ধ করছে হাজার মাইল দূরে, পশ্চাদপসরণ করে যে নিজ ভূমিতে ফিরে যাবে এর উপায় তাদের নেই। তারা বুঝে নিয়েছিল আত্মসমর্পণ তাদের করতেই হবে, কবে কীভাবে করবে সেটা নিয়ে চলছিল ছলাকলা। যুদ্ধ শুরুর মাত্র চার দিনের মাথায় ৭ ডিসেম্বর গবর্নর এ এম মালিকের কাছ থেকে আত্মসমর্পণের অনুমোদন চেয়ে বার্তা পাঠানো হয় ইসলামাবাদে। পরে জেনারেল নিয়াজী বলতে চেয়েছেন তার অগোচরে গবর্নর মালিক ও জেনারেল রাও ফরমান আলী মিলে এই বার্তা পাঠিয়েছিল। অন্যদিকে ফরমান বলেছেন তারা একত্রে বার্তার মুসাবিদা করেছিলেন এবং পাঠাবার দায়িত্ব তার ওপর বর্তায়। বার্তায় বলা হয়, আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে যদি বন্ধুদের কাছ থেকে সাহায্য না আসে তবে সম্মানজনকভাবে আত্মসমর্পণের পথ বেছে নিতে হবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উদ্দেশে গবর্নর মালিক বলেন যে, একটি শান্তিপূর্ণ ও সুসভ্য উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা আপনি নিন। এই বার্তায় সুস্পষ্ট যে যুদ্ধ শুরু হলে বন্ধুদের দিক থেকে সাহায্য আসবে, এমন এক প্রত্যাশা ইস্টার্ন কমান্ডের ছিল এবং সেই প্রত্যাশা জাগানো হয়েছিল। কারা কীভাবে সেটা করেছিল তা বড় বিবেচনা দাবি করে। এরপর ৮ ডিসেম্বর পিন্ডি থেকে বার্তায় জানানো হয় যে, কূটনীতিক আঙিনায় সব ধরনের চেষ্টা নেয়া হচ্ছে, সামরিক স্ট্যাটেজি সম্পর্কে জেনারেল নিয়াজিকে আলাদাভাবে জানানো হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত পতন ঠেকিয়ে রাখা যায় সেই চেষ্টা করতে তাদের বলা হয়। তারপর সামরিক বার্তায় লেখা হয়, ঈশ্বর আপনাদের সহায় হোন। আমরা সবাই দোয়া করছি (গড বি উইথ ইউ। উই আর অল প্রেয়িং)। রাওয়ালপিন্ডি থেকে ১০ ডিসেম্বর আরেক বার্তায় নিজেরা দায় না নিয়ে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব গবর্নরের ওপর অর্পণ করা হয়। এরপর গবর্নর তার কমান্ডারদের সম্মতিক্রমে ঢাকাস্থ জাতিসংঘের দূত মার্ক হেনরির কাছে বার্তা পাঠান সম্মানজনক আত্মসমর্পণের ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। কূটনীতিক চ্যানেলে যখন আত্মসমর্পণের বার্তা চালাচালি চলছিল সেই পটভূমিকায় ১২ ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডি থেকে জেনারেল গুল হাসান ফোন করে নিয়াজীকে জানান যে, হলুদেরা আসবে উত্তর থেকে, শ্বেতাঙ্গরা দক্ষিণ থেকে। এই বার্তা পেয়ে আত্মসমর্পণের উদ্যোগ থমকে গেল। কেননা মার্কিন সপ্তম নৌবহর তখন ফিলিপিন্সের উপকূল ছেড়ে রওনা হয়েছিল বঙ্গোপসাগরের দিকে। সেই সঙ্গে হলুদেরা অর্থাৎ চৈনিকরা ভারত সীমান্তে কোন সামরিক ব্যবস্থা নেবে এই ছিল প্রত্যাশা। কেন পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়া থেমে গেল এবং শেষ পর্যন্ত ৬ দিন পর তাদের নিঃশর্ত পরাজয় মেনে নিতে হলো সেটা বুঝতে হলে আমাদের চলে যেতে হবে নিউইয়র্কে, যেখানে অনুষ্ঠিত হয় একান্ত গোপন এক সভা। ১০ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ছয়টা থেকে প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে চলে গোপন বৈঠক। এই সভার উদ্যোক্তা ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার। একাত্তরের জুলাই মাসে ভারত ও পাকিস্তান সফরের এক পর্যায়ে অসুস্থতার ভান করে গোপনে চীন সফর ছিল কিসিঞ্জারের কূটনীতিক জীবনের বড় সাফল্য। তৎকালীন দুই পরাশক্তি বিভাজিত বিশ্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে নতুন আঁতাত গড়তে এই সফর পালন করে যুগান্তকারী ভূমিকা। আমেরিকার কাছে জোটনিরপেক্ষ ভারত বিবেচিত হয়েছিল সোভিয়েত-বন্ধু হিসেবে। তদুপরি চিনের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত বিরোধ তো ছিল অমীমাংসিত। তাই কিসিঞ্জারের কাছে চিনের সঙ্গে মৈত্রী ছিল নতুন আন্তর্জাতিক ভারসম্যা রচনার বড় উপায়। এক্ষেত্রে কাঁটার মতো বিঁধে ছিল বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি সংগ্রাম, যে সংগ্রামকে ভারত-সোভিয়েত বলয়ের পক্ষের ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন কিসিঞ্জার, আর তা কীভাবে ঠেকানো যায় সে জন্য ক্রমে হয়ে উঠছিলেন মরিয়া। প্রত্যাশা করা গিয়েছিল সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে জাতিসংঘে শুরু হবে তৎপরতা এবং অবিলম্বে ঘটবে যুদ্ধবিরতি। তেমন হলে দুই পক্ষের সৈন্য থাকবে যুদ্ধরেখা বরাবর দুই পাশে এবং জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী আসবে তদারকিতে, শুরু হবে শান্তি আলোচনা, শিকেয় উঠবে বাংলাদেশ। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদে একের পর এক ভেটো প্রদান করে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব ঠেকিয়ে রাখে রাশিয়া। দেশের ভেতর যৌথবাহিনী কর্তৃক অবস্থানে ঘিরে ফেলে পাকবাহিনীকে, দ্রুত এগিয়ে চলে ঢাকার দিকে। এমন নাজুক পরিস্থিতি বুঝতে ভুল করেননি কিসিঞ্জার, যুদ্ধবিরতি ঘটাতে হলে সংঘাতের আন্তর্জাতিকীকরণ দরকার, আর তাই ভারত-সীমান্তে চিনের পক্ষ থেকে আঘাত বা আক্রমণ হয়ে পড়ল জরুরী এবং সেই কাজ সম্পাদনে মরিয়া হলেন তিনি। জাতিসংঘে চিনের প্রতিনিধি হুয়ং হোকে গোপন বার্তা পাঠালেন দ্রুত আলোচনার জন্য। নিউইয়র্কের লোয়ার ম্যানহাটানে এক এ্যাপার্টমেন্টে আয়োজিত হলো সভা, বিদেশ দফতরকে কিছু জানানো হলো না, নিক্সনের সঙ্গে শলা করে আয়োজিত এই সভায় কিসিঞ্জারের সঙ্গে ছিলেন জাতিসংঘে তৎকালীন মার্কিন স্থায়ী প্রতিনিধি জর্জ বুশ এবং আর দু’জন সঙ্গী। সিআইএর সেফ হাউসে আয়োজিত সভার বিস্তারিত বিবরণ এখন উদ্ঘাটিত হয়েছে এবং তাতে দেখা যায় সব রকম কূটনীতিক, শিষ্টাচার বর্জন করে কিসিঞ্জার বার বার চীনা পক্ষকে প্ররোচিত করছেন ভারত সীমান্তে সংঘাত বাধাতে, কোন ধরনের আক্রমণ ঘটাতে। এমন উলঙ্গ ও সরাসরিভাবে নিজেদের মেলে ধরাটা কূটনীতিতে সাধারণত ঘটে না, কিন্তু কিসিঞ্জার তাই করেছিলেন। সভার সবিস্তার বিবরণ না দিয়ে আমরা কেবল এর দু-একটি দিক তুলে ধরব। কিসিঞ্জার অতিরিক্ত উৎসাহ নিয়ে কথা বলেছেন বেশি, গোপন কিছু কাগজপত্র দেখালেন হুয়াং হোকে, বোঝাতে চাইলেন রুশ-ভারত চক্রান্ত রুখতে চীন-আমেরিকার এখনই কিছু করতে হবে। কিসিঞ্জার জানান, এই সভার কথা হোয়াইট হাউসের বাইরে জর্জ বুশ ছাড়া আর কেউ জানে না। ৬ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট নিক্সন সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভকে বার্তা পাঠিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন যে, ভারতীয় আগ্রাসনের প্রতি সোভিয়েত সমর্থনের মুখে পাকিস্তানের বন্ধুরা নিষ্ক্রিয় থাকবে না। তিনি কূটনীতিক রীতি অতিক্রম করে পত্রের কিছু অংশ হুয়াং হোকে দেখান। কিসিঞ্জার বলেন, পূর্বে পাকিস্তানী আর্মি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। পশ্চিমে তাদের তেল ও রসদ ফুরিয়ে আসছে। আক্ষেপ করে কিসিঞ্জার বলেন যে, ভারতের ভুটান হবে পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান হবে নেপাল। তিনি বলেন, আমাদের নৌবহর মালাক্কা প্রণালীর কাছাকাছি পৌঁছেছে এবং কখন তা পেরুবে সেটা রবিবার সন্ধ্যার আগে বোঝা যাবে না। তিনি আরও বলেন, আমাদের কাছে গোপন খবর রয়েছে ইন্দিরা গান্ধী পশ্চিমে পাকিস্তান আর্মিকে শেষ করে দিতে চাইছে, চাইছে আজাদ কাশ্মীর দখল করতে। এরপর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কথাটি বলেন কিসিঞ্জার, তিনি বলেন, ‘বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নিতে হবে আমাদের। আগামীকালের মধ্যে পূর্বে পাকিস্তান আর্মি আত্মসমর্পণ করবে। তাই আমাদের কি পশ্চিম রণাঙ্গণে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আনতে হবে?’ চীনকে নানাভাবে প্ররোচনা যোগান কিসিঞ্জার। তিনি উদ্ভূত পরিস্থিতিকে চীনের নিরাপত্তার প্রতি হমকি হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন, ‘বস্তুত আমরা আপনার সঙ্গে মিলে অভিন্ন অবস্থান নিতে চাই। আমরা জানি পাকিস্তানকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে চীনের বন্ধু হওয়ার কারণে, আমেরিকার বন্ধু হওয়ার কারণে।’ সভায় চিনা প্রতিনিধি কোন সুস্পষ্ট কথা বলেননি, তবে কিসিঞ্জার তখন খরকুটো ধরেও ভাসতে চাইছেন। তাই তিনি এই সভাকে ইতিবাচক ধরে নিয়ে ফিরে এলেন ওয়াশিংটন, প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে আলাপ করে বার্তা পাঠালেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে। সেই বার্তায় কি ছিল আমরা জানি না, জানি কেবল এর পর পর রাওয়ালপিন্ডি থেকে জেনারেল গুল হাসান ফোন করে নিয়াজিকে জানালেন, চিনারা বা পিতরঙারা আসছে উত্তর থেকে, চালিয়ে যান লড়াই। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াও বার্তা পাঠিয়ে আত্মসমর্পণের প্রয়াস বাদ দিতে বলেন নিয়াজীকে। পিছিয়ে গেল আত্মসমর্পণের আলোচনা, আবার কিছুটা চাঙা হয়ে উঠল পাকবাহিনী, চীনারা আসছে এমন খবর পৌঁছে গেল ট্রেঞ্চ থেকে ট্রেঞ্চে। অবস্থা এমন হয়েছিল যে, টাঙ্গাইলের অদূরবর্তী পুংলিতে যখন ভারতীয় ছাত্রীসেনা অবতরণ করল তখন ট্রেঞ্চ থেকে ছুটে গিয়েছিল পাকিস্তানী সৈন্যরা, চীনা দোস্তরা এসে গেছে ভেবে। তবে এই অবকাশে পাকবাহিনীর নেতৃত্বের সহযোগিতায় ঘৃণিত ঘাতক সহযোগী আলবদর দল চরম হিংস্র ও কাপুরুষোচিত আঘাত হানবার পরিকল্পনা করে। ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করে ফেলে রাখে রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে। হেনরি কিসিঞ্জার যদি হোয়াং হোর সঙ্গে সভা করে পাকবাহিনীর পতন ঠেকাবার অমন ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত না হতেন, তবে আত্মসমর্পণ ঘটত ১২ কি ১৩ ডিসেম্বর, বুদ্ধিজীবীদের হত্যার সুযোগ পেত না ঘাতক দল।
×