ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মিরপুর বেনারসি পল্লীতে যেতে অনেক বিড়ম্বনা

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ২৯ জুন ২০১৬

মিরপুর বেনারসি পল্লীতে যেতে অনেক বিড়ম্বনা

রহিম শেখ ॥ খানা-খন্দে এমনিতেই সড়কের বেহাল অবস্থা। এর মধ্যেই সড়কের দুই পাশে বসেছে ফুটপাথ। দখল হয়ে গেছে ছোট-বড় অনেক গলি। যেন চেনা পথ অনেকটাই অজানা। মঙ্গলবার সরেজমিন রাজধানীর মিরপুরে অবস্থিত ১১ ও ১২ নম্বরে আদি বেনারসি পল্লীতে গিয়ে দেখা গেল এমন চিত্র। নানামুখী সমস্যার মধ্য দিয়ে বেনারসি পল্লীর বিক্রেতারা ব্যবসা করছেন। এর মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানের জর্জেট, নেট ও ক্যাটালগ শাড়িতে সয়লাব ঈদের বাজার। তুলনামূলক দামে সস্তা এবং নিম্নমানের এসব শাড়ির কাছে মার খাচ্ছে দেশী বেনারসি, কাতান আর জামদানি। ভিনদেশী পোশাকের আধিক্য বাড়লেও এখনও নারীদের প্রথম পছন্দ দেশী শাড়ি। সেই শাড়ি কিনতেই ফ্যাশন সচেতন নারীরা আসছেন বেনারসি পল্লীতে। ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মিশেলে গড়ে ওঠা শতাধিক দোকানে বাহারি নক্সা ও রঙের শাড়ির পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। মঙ্গলবার মিরপুরের ১০ নম্বর গোলচত্বরের কাছাকাছি আসতেই শোনা গেল ‘এই বেনারসি পল্লী, এই বেনারসি পল্লী’ সুরে রিক্সাওয়ালাদের হাঁকডাক। তাদের এই হাঁকডাকই বলে দিচ্ছে, কাছে-পিঠেই রয়েছে বেনারসি পল্লী। হাঁটা দূরত্বের পথ হলেও কেউ কেউ রিক্সায় চেপে, আবার কেউ নামীদামী গাড়ি হাঁকিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসছেন বেনারসি পল্লীর দিকে। উদ্দেশ্য একটাই পোশাক কেনা। ১০ নম্বর পার হয়ে ১১ নম্বর সেকশনের দিকে যেতেই পড়তে হলো বিড়ম্বনা। এলাকার সড়কের বেহাল দশা দেখে বোঝার উপায় নেই এটাই সেই আদি বেনারসি পল্লী। এখানকার ব্যবসায়ীরা জানালেন, ট্রাফিক ব্যবস্থা না থাকায় মূলত সমস্যা হচ্ছে। ১১ ও ১২ নম্বরের মাঝে সব পথই এখন বন্ধ। ফলে ক্রেতাকে সেই ১২ নম্বর সেকশন ঘুরে আসতে হচ্ছে। মিরপুর ১১ নম্বরে অবস্থিত হানিফ সিল্ক ইন্ডাস্ট্রিজের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ হানিফ জনকণ্ঠকে বলেন, আগে যেমন দূরের ক্রেতারা এখানে ছুটে আসতেন। এখন যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় দূরের ক্রেতারা খুব একটা আসছেন না। বড় বড় রাস্তা দখল করে ফুটপাথের কারণে চেনা পথ এখন অনেকটাই অচেনা। ছোট-বড় অনেক গলি দখল হয়ে গেছে। যেন দেখার কেউ নেই। সরেজমিন মিরপুর বেনারসি পল্লী ঘুরে বেশিরভাগ ক্রেতাকে বিদেশী, বিশেষত ভারতীয় শাড়ি কিনতে দেখা যায়। এগুলোর মধ্যে বিভিন্ন রকম কাতান, ক্যাটালগ শাড়ি, বুটিকস, সাউথ ইন্ডিয়ান ও শিফন বিক্রি হচ্ছে বেশি। ব্যবসায়ীদের মতে, গত বছরের তুলনায় এ বছরও ভারতীয় শাড়ির কদর বাড়ছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্রেতারা দেশী বেনারসি শাড়ির জন্য মিরপুরের এ পল্লীতে এলেও হরেক রকমের ডিজাইন ও মনকাড়া রঙের কারণে শেষমেশ ভারতীয় শাড়িই কিনছেন। হানিফ সিল্কের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ হানিফ বলেন, মোটামুটি ভালই বিক্রি করছি আমরা। তবে অন্যান্য বছর এই সময়ে ক্রেতাদের ভিড়ে খাওয়ার সময় পেতাম না। আর এবার সে তুলনায় একটু কম। কারণ হিসেবে তিনি জানান, ভারতীয় কিছু মানহীন শাড়ি আমাদের বাজার নষ্ট করছে। ওই শাড়িতে লাভ বেশি, কিন্তু সুতা ভাল না। ফলে ক্রেতারা কম দামে পেলেও প্রত্যাশা অনুসারে ব্যবহার করতে পারছেন না। এ জন্য আস্থা নষ্ট হচ্ছে। অনেকে এখন ভারতমুখী হয়ে পড়ছেন। এটাও ক্রেতা হ্রাসের অন্যতম কারণ। তবে চলতি সপ্তাহে ক্রেতা সমাগম বাড়বে বলে আশা করেন তিনি। এখন ব্যবসায়ীরা জানালেন, এবার ভারতীয় ভিসা সহজীকরণ করা ক্রেতা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। ঈদের আগে ভারতীয় ভিসা ক্যাম্প করা হয়েছে। এ সুযোগে পাইকারি অনেক ক্রেতা পণ্য কিনতে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত চলে গেছেন। এ জন্য এবারের ঈদ বাজারে মিরপুরের বিখ্যাত বেনারসি পল্লীতে ভিন্ন চিত্র। রমজানের আগে ক্রেতাদের ভিড় থাকলেও এখনও দেখা মেলছে না ঈদের আমেজ। মালিক সমিতি সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে মিরপুর-১০, ১১ ও ১২ মিলিয়ে মোট ২ হাজারের মতো কারখানা রয়েছে। আগে আরও বেশি ছিল। এছাড়া মিরপুর-১০ এ ১২০টি এবং মিরপুর-১১ ও ১২ মিলে আরও শতাধিক বেনারসির দোকান রয়েছে। বেনারসি পল্লী দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও দিয়া শাড়ির স্বত্বাধিকারী আবুল কাশেম বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এই বেনারসি পল্লী সম্প্রসারিত হতে থাকলেও আশির দশক থেকে এটি ব্যাপকতা লাভ করে আজকের পর্যায়ে এসেছে। আগে এখানে কারখানা ছিল বেশি, দোকান ছিল কম। এখন দোকান বেড়েছে, কিন্তু কমেছে কারখানার সংখ্যা। ব্যবসায়ীরা বলেন, বেনারসি পল্লীতে ২৫-৩০ প্রকারের বিভিন্ন নাম ও ডিজাইনের শাড়ি রয়েছে। এবারের ঈদে দেশী শাড়ির মধ্যে বেনারসি কাতান, বুটি কাতান, হাড্ডি কাতান, পিওর কাতান, সুতি ও বিভিন্ন প্রকারের জামদানি, দুপিয়ান সিল্ক, সানন্দা, গাদোয়ান, মাসলাইস কটন, জুটনেট, সুপারনেট, পুদনমা বা পাড় ছাড়া কাতান, অপেরাকাতান, টিস্যু কাতান, মিরপুর জামদানি, কোটাসিল্ক, কাঞ্জিবলনের চাহিদা বেশি। এছাড়া ভারতীয় শাড়ির মধ্যে নেট শাড়ি, গুপি, কোকিলা দির কাতান, রেম্বো, কলাবেরির কদর বেশি। বেনারসি পল্লী হলেও এখানে থ্রি-পিস, প্রিন্টের শাড়ি, টাঙ্গাইলের শাড়ি, লেহেঙ্গা, সিল্ক আর সুতি শাড়িও পাওয়া যাচ্ছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। মঙ্গলবার হানিফ সিল্কে শাড়ি কিনতে এসেছিলেন ধানম-ি এলাকার গৃহিণী আফরিন সুলতানা। তিনি বলেন, শাড়ি কেনার জন্য আদর্শ মার্কেট এটি। বিদেশে বৌমার জন্য শাড়ি পাঠাব। তাই এখানে চলে এসেছি। ইতোমধ্যে পছন্দ করে দুটি শাড়ি কিনেও ফেলেছি। আরও কিছু শাড়ি কিনব নিজেদের জন্য। তিনি বলেন, বাহারি কারুকাজের শাড়ির জন্যই মূলত বেনারসি পল্লীতে শাড়ি কিনতে আসি। ব্যবসায়ীরা জানালেন, মসলিন বেনারসি ৮ থেকে ১৭ হাজার টাকা, কাতান বেনারসি ১৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা, ব্রোকেট বেনারসি ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা, কার্পেট বেনারসি ৫ থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকা, মসলিন ২-৩ হাজার টাকা, নেট জুট সাড়ে ৪ থেকে ৮ হাজার টাকা, বিয়ের গর্জিয়াস শাড়ি ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা, সফট সিল্ক ৪ থেকে ৪২০০ টাকা, ঢাকাই জামদানি ৪ থেকে ৩০ হাজার টাকা, রেডি কোচা ৬ হাজার থেকে সাড়ে ৬ হাজার টাকা, জুট হাফ সিল্ক আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া হানিকোট বেনারসি সাড়ে ৪ হাজার টাকা, রাজকোট বেনারসি ৫ হাজার টাকা, সুতি বালুচুরি ১ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা, টিস্যু জুট সিল্ক জামদানি ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা, পিয়ান ও খাদি বেনারসি ৭ থেকে ১২ হাজার টাকা, কাঁথা স্ট্রিচ ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা, টাঙ্গাইল সুতি জামদানি ১ থেকে ১৫ হাজার টাকা, মাসলাইস কাতান ৫ থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকা, শাটিন বেনারসি ৪ হাজার থেকে ৪ হাজার ২০০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।
×