ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

রায়পুরে প্রাইভেট হাসপাতালে অপচিকিৎসা ॥ ডায়াগনষ্টিক সেন্টার ও চেম্বারে ভুয়া ডিগ্রিধারীদের ছড়াছড়ি

প্রকাশিত: ০১:৩৭, ১৮ মে ২০১৬

রায়পুরে প্রাইভেট হাসপাতালে অপচিকিৎসা ॥ ডায়াগনষ্টিক সেন্টার ও চেম্বারে ভুয়া ডিগ্রিধারীদের ছড়াছড়ি

সংবাদদাতা, রায়পুর, লক্ষ্মীপুর ॥ লক্ষ্মীপুরের রায়পুর শহরে অনুমোদনহীন ক্লিনিক ও ডায়গনষ্টিক সেন্টার ব্যাঙ্গের ছাতার মত গড়ে উঠছে। এসব প্রতিষ্ঠানে অপচিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে আসছে অসাধু ক্লিনিক মালিক ও ভুয়া সার্টিফিকেটধারি ডাক্তাররা। তারা রোগীদের সরকারি হাসপাতাল থেকে দালালের মাধ্যমের ভাগিয়ে এনে অনৈতিক অর্থ আদায় করছে। সেই সাথে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো সরকারি বিধি নিষেধ উপেক্ষা করে নানা পরিক্ষা নিরিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে। এতে করে একদিকে সরকার মোটা অংকের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অন্যদিকে অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছে নিরিহ রোগীরা। পাশাপশি ড্রাগ লাইসেন্সবিহীন ঔষুধ ফার্মেসী প্রতিদিন গড়ে উঠছে । যার ২২টি ছাড়া প্রায় ৪ হাজার ঔষুধের ফার্মেসী রয়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরে অনুসন্ধানকালে সরেজমিন ও ভূক্তভোগীদের অভিযোগ থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, সরকারি হাসপাতালকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ক্লিনিক বা ডায়গনস্টিক সেন্টারে ভুয়া ডাক্তাররা চিকিৎসা দিচ্ছেন। দালারের মাধ্যমে সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগীদের এনে ওই সবস্থানে রোগীদের চিকিৎসা করা হচ্ছে। কোন কোন ক্লিনিকে ভূয়া ডাক্তার অস্ত্রপাচার পর্যন্ত করে থাকে। মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি সার্টিফিকেট না নিয়ে তারা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে রোগী দেখছেন। এমবিবিএস পাশ করা ডাক্তারদের পাইলস ও ফেস্টুলা বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করে চিকিৎসা দেয়ার কথা। অথচ প্রতারকরা লিপলেট বিতরণ ও বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণা করে আসছেন। সরকারি হাসপাতালগুলোর বাইরে সক্রিয় রয়েছে দালাল চক্র। দুরদূরান্ত থেকে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা হাসপাতালের প্রবেশ পথেই দালালদের হাতে জিম্মি পড়ে। দালালরা রোগীদের বুঝিয়ে ভূঁয়া বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের কাছে নিয়ে যায়। তাছাড়া দালালরা নির্দিষ্ট হাসপাতাল, ক্লিনিক বা ডায়গানস্টিক সেন্টারে রোগী ভর্তি ও পরীক্ষা নিরিক্ষার নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় ভূয়া চিকিৎসক, ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়গনস্টিক সেন্টারগুলো এসব অবৈর্ধ চালিয়ে আসছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরদ্ধে জোড়ালো কোন অভিযানও চালানো হচ্ছেনা। মাঝেমাঝে কিছু অভিযান চালানো হয়। অভিযোগ রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীর সহায়তার তারা এ ব্যবসা চালাচ্ছে। ভূঁয়া চিকিৎসদের মধ্যে অনেকেই এসএসসি পর্যন্ত পাশ করতে পারেনি। অথচ তারা এমবিবিএস বা বিশেষজ্ঞ বলে প্রচারনা চালাচ্ছে। আবার কেউ কেউ নিজেকে প্রফেসর পর্যন্ত আখ্যা দিয়ে সাইনবোর্ড বা ভিজিটিং কার্ড বানিয়ে বড় চেম্বার গড়ে তুলেছেন। প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আসা সহজ সরল রোগী ও তাদের পরিবার বেশি প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। এক শ্রেণির অসাধু ক্লিনিক মালিক ও দালাল চক্র এসব ঘটনায় জড়িত। বিএমডিসির (বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল) নির্দেশনা অনুযায়ী কোনো ডাক্তার কোনো নির্দিষ্ট কোর্স সমাপ্ত করে বিএমএন্ডডিসিতে রেজিস্ট্রেশন না হওয়ায় পর্যন্ত ওই ডিগ্রী ব্যবহার না করার নির্দেশনা থাকলেও বহু ডাক্তার নিজেকে পাট-১, পার্ট-২, পার্ট-৩, ফাইনাল পার্ট এরকম শব্দকে ব্র্যাকেটবন্ধী করে নিজেকে ওই ডিগ্রীধারী হিসেবে উল্লেখ করে প্রাকটিস করছেন। ডিগ্রী অর্জন না করেই নিজেকে ডিগ্রীধারী বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রচারণা চালিয়ে রোগীদের আকৃষ্ট করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। অথচ বিএমএন্ডডিসির নিয়মানুযায়ী এ ধরণের ডিগ্রীধারীদের জন্য জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে। কিন্তু বিধানে থাকলেও রায়পুরের কোথাও এ বিধান কার্যকরের নজির অদ্যাবধি পরিলক্ষিত হয়নি। এদিকে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো সরকারি বিধি নিষেধ না মেনে রোগ নির্ণয়ের মতো গুরুত্ব স্পর্সকাতর এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে টেস্ট অনুযায়ী প্রশিক্ষিত টেকনোলজিস্টের পরিবর্তে অশিক্ষিত অদক্ষ লোক দিয়ে বহির্ভূত ব্যবস্থায় কার্যক্রম পরিচালনা এবং অতিরিক্ত ফি নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, প্রায় ৭ লাখ লোকের বসবাস এ রায়পুর উপজেলায়। বর্ধিত জনসংখ্যার স্বাস্থ্য সেবায় ৫০ শয্যার একটি মাত্র সরকারি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে। রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা রক্তের কয়েকটি পরীক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ এ হাসপাতালটি। ফলে ভুক্তভোগীরা রোগ নির্ণয়ের জন্য ছুটে যেতে বাধ্য হন বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়গনস্টিক সেন্টারগুলোতে। এসব প্রতিষ্ঠানের মাথায় বিশাল আকারের নাম করা চিকিৎসক ও টেকনোলিজিস্টের নামে সাইনবোর্ড ঝুললেও পাওয়া যায়না ডিগ্রিধারী কাউকে। জনসাধারণের রোগ নির্ণয়ে রক্ত প্রস্রাব, মলসহ এক্সরে পরীক্ষা নিরিক্ষা চলে প্রতিষ্ঠানের অশিক্ষিত ও অদক্ষ জনবল দিয়ে। পরীক্ষা নিরিক্ষা করতে আসা লোকজনের অজ্ঞতাকে পুঁজি করে প্রতিষ্ঠানগুলোর নামকরা চিকিৎসকের ভূঁয়া স্বাক্ষর ও সিল ব্যবহার করে রিপোর্ট দিয়ে থাকে। এতে সুফল পায়না রোগীরা। তাদের বিরুদ্ধে ভুল রিপোর্ট দেয়ার অভিযোগও রয়েছে। রায়পুর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ৯টি প্রাইভেট হাসপাতাল, ১০টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ৭৫টি দন্ত চিকিৎসাকেন্দ্র ও প্রায় ৩ সহ¯্রাধিক ঔষধের ফার্মেসী রয়েছে। প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে ১০টি করে বেডের অনুমতি থাকলেও সেখানে ২০-৩০টি বেডও বসানো হয়েছে। প্যাথলজিগুলোতে নেই ডিপ্লোমাধারী টেকনিশিয়ান। ৪জন মাত্র দন্ত চিকিৎসকের অনুমোদন থাকলেও রয়েছে ৭৫টি দন্ত চিকিৎসা কেন্দ্র । রোগ নির্ণয়ে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক উপকরণ নেই। দক্ষতা ও পরীক্ষার ধরন অনুযায়ী জনবল থাকার কথা। যেমন আলট্রাসনোগ্রাম করবেন এমবিবিএস সনদ প্রাপ্ত চিকিৎসক, এক্সরে করবেন রেডিওগ্রাফি টেকনোলজিস্ট কিন্তু রিপোর্ট লিখবেন এমবিবিএস সনদ প্রাপ্ত চিকিৎসক। কিন্তু রায়পুরের ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে শ্রেণিভিক্তিক দক্ষ লোকজন নেই। এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পরীক্ষা নিরিক্ষার সঠিক ফলাফলে সহায়ক উপাদান হচ্ছে রিজেন। নির্ধারিত মেয়াদ, উন্নত রিএজেন্ট ব্যবহারে সঠিক রোগ নির্ণয় রোগ করা সম্ভব। কিন্তু এখানকার প্রতিষ্ঠানগুলো তা মানছেন না ও করছেন না। তারা মেয়াদোর্ত্তীর্ণ ও কমদামী রিজেন্ট ব্যবহার করছেন। ফলে রোগী যত জটিল রোগেই আক্রান্ত হননা কেন রিপোর্ট আসে স্বাভাবিক। এসব ডায়গনস্টিক সেন্টারে আধুনিক পদ্ধতিতে এক্সরে কার্যক্রম হয়না বলেও জানা যায়। সূত্রটি দাবি করে- এক্সরে রশ্মীতে তিন ধরনের আলোকচ্ছটা থাকে। এরমধ্যে বিটার রশ্মী মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারত্মক ক্ষতিকর। এ রশ্মিটি ১০ ইঞ্চি দেওয়াল ভেদ করতে পারে। অথচ এ রশ্মি নিয়ন্ত্রন বা প্রতিরোধে প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়গনস্টিক সেন্টারগুলো এক্সরে রুমে নেই কোন কার্যক্রম ব্যবস্থা। এ রশ্মির ক্ষতিকর প্রভাবে ক্যান্সারের মতো জটিল রোগও হতে পারে। এবং গর্ভবতীর সন্তান বিকলাঙ্গও হতে পারে। প্রশাসনের নাকের ডগায় প্রতারকরা ঢাকায় থেকে মফস্বলে এসে চক্রটি বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে। এছাড়াও উপজেলার ৭৫টি দন্ত চিকিৎসালয়ের মধ্যে অনুমোদন আছে মাত্র ৪টির। ভুয়া ডাক্তারদের প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলেও তারা বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের উপাধি দিয়ে রোগীদের সাথে প্রতারণা করছে। এলোপ্যাথিকের পাশাপাশি হারবাল ও হোমিও সার্টিফিকেট ব্যবহার করছেন। আবার প্রতারকরা পত্রিকা ও টেলিভিশনে বিভিন্ন স্থানে বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। ভূয়া ডাক্তারদের সম্পর্কে বিভিন্ন ক্লিনিক ঘুরে চাঞ্চল্যকর এ তথ্য পাওয়া গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডায়গনস্টিক সেন্টারের একজন কর্মচারী জানান, যে ডাক্তার বা ইউনিয়ন পরিদর্শীকা এখানে রোগী পাঠান তাকে শতকরা হারে টাকা দিতে হয়। এ কারনে সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে দ্বিগুন ফি রোগীদের কাছ থেকে নেয়া হয় এবং আরো অনিয়মতো আছেই। নবগঠিত ফার্মেসী কমিটির আহবায়ক মো. দুলাল জানান, ২২ জনের ড্রাগ লাইসেন্স ছাড়া উপজেলায় প্রায় ৩ সহস্রাধিক ফার্মেসী রয়েছে। প্রতিদিন ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠছে। তাদের নেই কোন সনদপত্র। লক্ষ্মীপুরের সিভিল সার্জন ডা.গোলাম ফারুক ভূঁইয়া বলেন, এসব অনিয়মের অভিযোগ তিনিও পেয়েছেন। সহসা এদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম বরদাস্ত করা হবে না বলে জানান।
×