ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

মোরসালিন মিজান

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ০৬:২০, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৫

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

টানা নয় মাস প্রাণপণে লড়লেন মুক্তিযোদ্ধারা। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে লড়লেন। নয় মাস জলে-জঙ্গলে কাটালেন তারা। মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার জন্য লড়লেন। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর দম্ভ চূর্ণ করে দিল বীর বাঙালী। সে গৌরবময় বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর ছিল বুধবার। দিবসটি মহা আনন্দে উদ্যাপন করল গোটা দেশ। বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির শহর ঢাকার প্রতিটি প্রান্ত মুখরিত ছিল। কত কত আয়োজন! কথা কবিতা গান নাচের শিল্পভাষায় ফুটিয়ে তোলা হলো দেশমাতৃকার প্রতি প্রেম। সব মঞ্চ থেকে, উৎসব অনুষ্ঠান থেকে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের কথা স্বীকার করা হলো। স্মরণ করা হলো; কৃতজ্ঞতা জানানো হলো। শ্রদ্ধা জানানো হলো দেশের ত্রিশ লাখ শহীদদের প্রতি। বীরাঙ্গনা মা-বোনদের যে বেদনা, এদিন উপলব্ধি করার কিছুটা হলেও চেষ্টা করা হয়েছে। হ্যাঁ, হুজুগের উদ্যাপন, আন্তরিক উপলব্ধির বাইরে লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা প্রচুর থাকবে। এবারও ছিল। বার বার সামনে এসেছে। এরপরও সত্য যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূলসুর বহু বাঙালীর বুকে বেজেছে। বিশেষ দিবস তাদের আবেগাপ্লুত করেছে। এদিন পতাকার লাল-সবুজ রঙে সেজেছিল ঢাকা। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় অধিকাংশ মানুষ লাল-সবুজ পোশাক পরেছেন। আর পতাকা কোথায় ছিল না? যে দিকে চোখ গেছে, জাতীয় পতাকা। দেখে মন ভরে গেছে। বিজয় দিবস গত হয়েছে। তবে রেশ এখনও বর্তমান। বৃহস্পতিবারও রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় গাড়িতে এমনকি রিক্সায় উড়তে দেখা গেছে পতাকা। বিজয় দিবসের উৎসব অনুষ্ঠানও পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। এই রেশ আরও কয়েক দিন থাকবে বলে আশা করা যায়। অবশ্য একটা সীমাবদ্ধতার কথাও বলতে হয়। কোনবারই বিজয় দিবসের আলোচনায় ভারত তেমন আসে না। এবারও তা-ই হলো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পার্শ্ববর্তী দেশটির যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের বলা চলে কেউ-ই স্মরণ করলেন না। রাজধানী শহরের বড় বড় শিক্ষিতরা সভা সেমিনারে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেলেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, এটি এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কারও কারও ধারণাÑ একাত্তরে ভারতের সহযোগিতার কথা স্বীকার করলে বাঙালীর অবদানকে ছোট করা হয়। আদৌ কি সঠিক? সহযোগিতা সহমর্মিতার জন্য একবার ধন্যবাদ বললে বাঙালী ছোট হয়ে যাবে! নাকি আরও বড় হবে? বড় হওয়ারই কথা কিন্তু। স্বাধীন দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক এমনকি মন্দ হতে পারে। তাই বলে ইতিহাস তো বদলে যায় না। ইতিহাসকে ইতিহাসের জায়গা থেকেই দেখতে হবে। সম্মান জানাতে হবে। এ সরল ইচ্ছা থেকে হয়ত ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। সেটি ২০০৬ সালে; বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে। তবে উদ্যোগ পর্যন্তই। বাস্তবায়ন হয়নি। অথচ চলছে অবমাননা। ভিত্তিপ্রস্তর ঘিরে এক ধরনের মূর্খ শ্রেণীর, ইতিহাস অজ্ঞ নাগরিক শ্রেণীর আড্ডা বসছে প্রতিদিন। বিজয় দিবসের আগে ও পরে সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, ফলকটি ঘিরে যে লোহার শিকল তার উপর বসে পা দোলাচ্ছে টনটনে বোধ-বুদ্ধির ছেলেমেয়েরাই! এক তরুণীকে নিজের ভ্যানিটি ব্যাগের প্রতি খুব যতœবান বলে মনে হলো। ব্যাগটি মাটিতে রাখলেন না তিনি। আশঙ্কাÑ ধূলো লাগতে পারে। ভ্যানিটি ব্যাগটি তাই ফলকের উপরে রাখলেন! খুব গরমের সময় এর উপরে গায়ের জামাও খুুলে রাখা হয়। ফলকটিকে চেয়ার বানিয়ে বসেন লেখাপড়া জানা ছেলেমেয়েরা। সবচেয় ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছেÑ সবাই এই দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এটি অভ্যাস? নাকি হীনমন্যতা? বিজয় দিবসে প্রশ্নটি উঠানো তো যায়! আসি আসি শীত আসলো শেষতক। আজ ৪ পৌষ। বাংলা এই মাসের প্রথম দিন আনুষ্ঠানিক শুরু হয়েছিল শীতের। প্রিয় ঋতুর আগমনী বার্তা এখন সর্বত্র। অনেকটা হঠাৎ করেই অনুভূত হতে শুরু করে শীত। বিশেষ করে শৈত্যপ্রবাহ থাকায় গত দুই দিনে জবুথবু অবস্থা হয়েছে নগরবাসীর। সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার মধ্যে পার্থক্য কমে আসায় এমনটি হয়েছে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। পাশাপাশি রয়েছে ঘনকুয়াশা এবং ঠা-া বাতাস। বর্তমানে রাজধানীতে হিমেল বাতাস বইছে ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার বেগে। এ অবস্থা আরও কয়েক দিন চলতে পারে বলে মত আবহাওয়া অফিসের। আবহাওয়া অফিস জানায়, সর্বনিম্ন তাপমাত্রা হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্যও বেশ কমে এসেছে। বুধবার দিনের তাপমাত্রা ৪ থেকে ৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস কমে যায়। বৃহস্পতিবার সূর্যের দেখা মেলেনি বললেই চলে। মুখ ভার করে ছিল প্রকৃতি। তাতেই শীতটা বোঝা গেছে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, আপাতত তারা উপভোগ করছেন নতুন ঋতু। তবে আরও বাড়লে সমস্যা হবে। বিশেষ করে রাজধানীর ফুটপাথে করুণ জীবন যাদের, সেই মানুষগুলোর কষ্ট অসহনীয়ভাবে বেড়ে যাবে। তার আগেই ছিন্নমূল হতভাগ্য মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানো জরুরী। আমরা কী সে দায় অনুভব করব না? রাজধানী ঢাকা সারাবছরই পোস্টারে ঢাকা থাকে। সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক দলের প্রচার-প্রচারণা। এসব পোস্টারে যথারীতি এগিয়ে সরকারী দলের নেতাকর্মীরা। শহরের দেয়ালগুলো কী যে বিচ্ছিরি করে রাখেন তারা। এসব পেস্টারের প্রধান বৈশিষ্ট্য স্থানীয় নেতাদের নিজস্ব প্রচার। একটা কোন ইস্যু পেলেই হলো, পোস্টার সেঁটে দেয়া হয়। ব্যানার ছাপিয়ে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। এসবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি যেমন থাকে, তেমনি থাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবিও। কিন্তু এই ছবিগুলো কখনই মুখ্য হয়ে ওঠে না। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র করে দেখানো হয়। বিশাল আকারে দৃশ্যমান হন স্থানীয় নেতা ও মন্ত্রীরা। নির্লজ্জ এই প্রচার নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হচ্ছিল অনেক দিন ধরে। আর তারপর সম্প্রতি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিশেষ বার্তা। দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত নির্দেশনায় বলা হয়েছেÑ এ ধরনের ব্যানার পোস্টারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি ছাড়া আর কারও প্রতিকৃতি ব্যবহার করা যাবে না। এ নিষেধের ফলে রাজধানীবাসীর চক্ষু কিছুটা হলেও আরাম পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
×