ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বর্ধমান বিস্ফোরণের হোতা পুরস্কারঘোষিত শাহনুর অসমে গ্রেফতার

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ৭ ডিসেম্বর ২০১৪

বর্ধমান বিস্ফোরণের হোতা পুরস্কারঘোষিত শাহনুর অসমে গ্রেফতার

শংকর কুমার দে ॥ বর্ধমানের খাগড়াগড়ের বোমা বিস্ফোরণের প্রধান হোতা ৫ লাখ টাকার পুরস্কার ঘোষিত জঙ্গী শাহনুর আলম ডাক্তারকে গ্রেফতার করেছে অসম পুলিশ। আরেক জেএমবি জঙ্গী সাজিদ ওরফে না’গঞ্জের মাসুদ রানা মাসুমকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ফের অন্য মামলায় রিমান্ডে নিয়েছে কলকাতার পুলিশ। খাগড়াগড়ের বোমা বিস্ফোরণ ঘটেছে তাড়াহুড়োর ভুল থেকে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা এনআইএর দাবি। মুখ্যমন্ত্রী মমতার ‘র’ মন্তব্যে জঙ্গীদের জামিনের রসদ যুগিয়েছে আদালতে। গোয়েন্দা সূত্র এ খবর দিয়েছে। সূত্র জানায়, ভারতের জাতীয় তদন্তসংস্থা ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ) খাগড়াগড় বিস্ফোরণে অভিযুক্ত চার বাংলাদেশীসহ যে ১২ জঙ্গীর জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছিল তার অন্যতম শাহনুরা তার মাথার ইনাম ঘোষণা করা হয় ৫ লাখ টাকা। অবশ্য তার স্ত্রী সুজেনা বেগমকে প্রায় ১ মাস আগে গ্রেফতার করা হয়। এই জঙ্গী দম্পতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার হত্যা ষড়যন্ত্রের ছক তৈরি করে বলে এনআইএর দাবি। শাহনুরকে শুক্রবার সন্ধ্যায় অসমের নলবাড়ী জেলা থেকে গ্রেফতার করা হয়। গুয়াহাটির স্পেশাল ব্রাঞ্চের সদর দফতরে তাকে জেরা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। গত ২ অক্টোবর বর্ধমান বিস্ফোরণের পর ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে শাহনুরের নাম আসার পর অনাবাসী বাসস্থল অসমের চৌতালা গ্রাম থেকে সস্ত্রীক পালিয়ে যায়। গ্রামবাসী শাহনূরকে হাতুড়ে চিকিৎসক (ডাক্তার) হিসেবে চেনেন। চিকিৎসা পেশার আড়ালে আসলে জঙ্গী তৎপরতাই চালাত শাহানুর। গত ৮ নবেম্বর সুজেনার গুয়াহাটিতে আসার খবর পেয়ে পুলিশ ও গোয়েন্দারা অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করে। শাহনুরের ভাই জাকারিয়াসহ পাঁচজনকে আগেই গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারকৃত শাহনুর ডাক্তারের স্ত্রী সুজেনা চৌতালা মাদ্রাসায় মেয়েদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিত। জঙ্গী তৎপরতা চালানোর জন্য বিদেশ থেকে আসা অর্থ শাহনুরের মাধ্যমেই লেনদেন হতো বলে ভারতের গোয়েন্দাদের দাবি। জঙ্গী নেটওয়ার্ক ॥ বাংলাদেশের জঙ্গীদের নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও অসমে জামা’তুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) সংগঠনটি পশ্চিমবঙ্গ ও অসমে যারা গড়ে তুলছিলেন তাদের অন্যতম শাহনুর আলম ডাক্তার ও তার স্ত্রী সুজেনা। বর্ধমান বিস্ফোরণের তদন্তে তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে হত্যায় জঙ্গীদের ছক সম্পর্কে জানতে পেরেছেন বলে ভারতের গোয়েন্দাদের দাবি। খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণ তদন্ত বাংলাদেশ ও ভারত-দুই দেশের গোয়েন্দারা একযোগে কাজ করছে। এনআইএর ৪ সদস্যের একটি দলের ঢাকা সফরের পর বাংলাদেশের ৭ সদস্যের একটি গোয়েন্দা প্রতিনিধি দল কলকাতা সফর করে এসেছে। দুই দেশের গোয়েন্দা প্রতিনিধি দলই জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের তালিকা বিনিময় করে এক সঙ্গে কাজ করছে। ডাক্তার পেশার আড়ালে জঙ্গী তৎপরতা ॥ খাগড়াগড় বিস্ফোরণের অন্যতম অভিযুক্ত অসমের শাহনুর আলম অবশেষে পুলিশের জালে আটকা পড়ার পর গুয়াহাটির স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের সদর দফতরে এনে জেরা করা হচ্ছে তাকে। এর আগে বারদুয়েক পুলিশের হাত ফস্কে পালিয়েছিল সে। এনআইএ শাহনুরের হদিস পেতে পাঁচ লাখ টাকা ইনাম ঘোষণা করেছিল। অসম থেকে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন মাদ্রাসায় এসে জেহাদের প্রশিক্ষণ দিত অনেক জঙ্গী দম্পতি। শাহনুর ‘ডাক্তার’-এদের অন্যতম। গোয়ালপাড়া থেকে দাঁতের ডাক্তারি শিখে বরপেটার চৌতালা গ্রামে চিকিৎসা করত শাহনুর। আড়ালে সে, তার স্ত্রী সুজানা বেগম ও ভাই জাকারিয়া জামায়াত-উল-মুজাহিদীনের হয়ে কাজ করত। বিদেশ থেকে আসা হাওয়ালার টাকা শাহনুর এ রাজ্যে নিয়মিত পাঠাত বলে জানতে পারে গোয়েন্দারা। তার স্ত্রী শিমুরালির মাদ্রাসায় প্রশিক্ষণ নিয়ে চৌতলার মাদ্রাসায় মেয়েদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিত বলেও জানা যায়। বর্ধমান বিস্ফোরণে অসমের যোগসূত্র মেলার পরেই দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে চৌতলার বাড়ি ছেড়ে পালায় শাহনুর। প্রথমে সে বাবা মুজিবর আলমের বাড়িতে ওঠে। পরে নলবাড়ীর মুকালমুয়ায় এক আত্মীয়ের বাড়িতেটি বাক্সে সমস্ত নথিপত্র পুঁতে রেখে পালায়। বরপেটা নলবাড়ী থেকে জেহাদী যোগের অভিযোগে ৯ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গত ৬ নবেম্বর রাতে গুয়াহাটির বাসটার্মিনাল থেকে দেড় বছরের সন্তানসহ ২২ বছরের সুজেনাকে ধরে পুলিশ। তাকে জেরা করে মুকালমুয়ায় শাহনুরের আত্মীয়ের বাড়িতে পুঁতে রাখা নথির হদিস মেলে। মাঝে শাহনুরকে আশ্রয় দেয়ার অভিযোগে তার সম্পর্কিত দুই ভাইকে গ্রেফতার করেও পরে ছেড়ে দেয় পুলিশ। দুইবার ফস্কে যায় ॥ শাহনুর আলম ডাক্তার একবার মেঘালয়, আর একবার ধুবড়ির নামাসেরসো গ্রামে পুলিশ হানা দিলেও তাদের হাত থেকে ফস্কে পালায়। কয়েক দিন আগে পুলিশ খবর পায়, মুকালমুয়ার লারকুচি গ্রামে ৪ দিন ধরে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে শাহনুর। গোয়েন্দাদের কাছে যে ছবি ছিল তাতে শাহনুরের দাড়ি ছিল। কিন্তু মুকালমুয়ায় গা ঢাকা দেয়া ব্যক্তির দাড়ি ছিল না। তাই সে শাহনুর কিনা, নিশ্চিত হতে দিন দুই সময় নেয় পুলিশ। এ দিন সন্ধ্যায় অসম পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের বিশেষ অপারেশন ইউনিট ওই গ্রাম থেকে তাকে গ্রেফতার করে। এর আগে যেভাবে শাহনুর নজর এড়িয়ে পালিয়েছিল দু’বার। গুয়াহাটির পাশেই নলবাড়ীতে লুকিয়ে ছিল সে। এলাকারই কারও সমর্থন সে পেয়েছে। এটা পুলিশের সন্দেহ। শাহনুর ডাক্তারকে গ্রেফতারের পরে জঙ্গী তৎপরতাসহ এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছে গোয়েন্দারা। সাজিদ ফের পুলিশী হেফাজতে ॥ সাজিদ ওরফে রহমতউল্লাহ শেখ ওরফে নারায়ণগঞ্জের মাসুদ রানা মাসুমকে গ্রেফতার করেছিল বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশ। খাগড়াগড় বিস্ফোরণ মামলায় সে অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত বলে তাকে হেফাজতে পেয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে এনআইএ। বৃহস্পতিবার আদালত ১৪ দিনের জন্য সাজিদকে বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশের হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে। আবারও ভারতে জেএমবির মাথা হিসেবেই সাজিদ ওরফে মাসুদ রানাকে ফের জিজ্ঞাসাবাদের জন্যই নিজেদের হেফাজতে পেয়েছে বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশ। খাগড়াগড় কান্ডের আগে বাগুইআটি থানায় অক্টোবরে রুজু গাড়ি চুরির একটি মামলায় নাম আসে সাজিদের। এ ছাড়াও বাংলাদেশের নাগরিক সাজিদ ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে নিজেকে ভারতের নাগরিক প্রতিপন্ন করেছিল। আমরা ওই বিষয়টি তদন্ত করছি। পুলিশ বলেছে, সাজিদ বাংলাদেশে বহু অপরাধে অভিযুক্ত। সেখানকার দেশের পুলিশ ও গোয়েন্দারা বহু দিন ধরেই খুঁজছিলেন তাকে। খাগড়াগড় সূত্রে হদিস পাওয়া জঙ্গী গোষ্ঠীতে সাজিদের ভূমিকা জানার পর তার হদিস পেতে এনআইএ ১০ লাখ টাকা ইনাম ঘোষণা করে। বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশ তাকে ৮ নবেম্বর গ্রেফতার করে। কলকাতা বিমানবন্দরের কাছ থেকে তাকে ধরা হয়েছে বলে পুলিশের দাবি। সাজিদকে এনআইএ নিজেদের হেফাজতে নেয়ার পরেই ১০ নবেম্বর সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার অস্থায়ী কার্যালয়ের সামনে একটি রহস্যজনক বিস্ফোরণ হয়। তাকে কঠোর নিরাপত্তায় আদালতে হাজির করানো হয়। ১ ডিসেম্বর সাজিদকে নিয়ে এনআইএর তদন্তকারীরা মুর্শিদাবাদ ও বীরভূমের বিভিণœ এলাকায় তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহে যান। কলকাতা থেকে হেলিকপ্টারে করে বহরমপুর পৌঁছানোর পর সিআরপি এবং বিএসএফের নিরাপত্তায় বিভিন্ন জায়গায় ঘোরানো হয় তাকে। সেই সাজিদকে নিছক গাড়ি চুরি ও বিদেশী নাগরিক আইনের মামলায় হেফাজতে নিতে বিধাননগর কমিশনারেটের উদ্যোগী হওয়াকে খুব স্বাভাবিক বলে পুলিশের অনেকেরই মনে হচ্ছে না। বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশ আসলে বাবুভাই নামে এক সন্দেহভাজন বাংলাদেশী জঙ্গীর ব্যাপারে সাজিদের কাছ থেকে বিশদে জানতে চায়। ‘বাবুভাই’ ভারতীয় জাল নোটের কারবারে জড়িত এবং ভারতে ঘাঁটি গেড়ে থাকা জঙ্গীদের অর্থ সরবরাহের ক্ষেত্রে তার বড় ভূমিকা রয়েছে বলে গোয়েন্দাদের দাবি। এরই মধ্যে ওই জঙ্গী গোষ্ঠীর কয়েকজনকে আটক করেছে পুলিশ। যাদের আটক করেছে তাদের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার দরকার। সাজিদকে দিয়ে তাদের শনাক্ত করাতে চান গোয়েন্দারা। অদক্ষ হাত, তাড়াহুড়ো ও ভুল উপকরণে বিস্ফোরণ ॥ বর্ধমান খাগড়াগড়ের বোমা বিস্ফোরনের ঘটনা কারণ কি তা তদন্ত করেছে তদন্ত সংস্থা এনআইএ। অদক্ষ হাতে তাড়াহুড়ো করে রাসায়নিক ও অন্যান্য উপকরণ মেশাতে গিয়ে ভুল করার কারণে বোমার বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে এনআইএর দাবি। গোয়েন্দাদের দাবি, বিস্ফোরণের একমাত্র জীবিত প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুল হাকিমের কাছ থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। হাকিমের দেয়া তথ্যের সঙ্গে ভারতে জেএমবির মাথা ও বাংলাদেশের নাগরিক সাজিদ ওরফে মাসুদ রানা এবং মিয়ানমারের বাসিন্দা বিস্ফোরক-বিশেষজ্ঞ খালিদ মহম্মদের বক্তব্যও মিলে গেছে। গত সপ্তাহে সাজিদ, খালিদ ও হাকিমকে একসঙ্গে বসিয়ে জেরা করেছে এনআইএ। তদন্তকারীদের দাবি, গত ১ অক্টোবর সন্ধ্যায় খাগড়াগড়ের ডেরায় কওসর এসে জানায়, এক দিনের মধ্যেই ১০টি গ্রেনেড প্রয়োজন। ‘বিষয়টা খুব জরুরী’ বলে দাবি করে সে। কওসর জরুরী দাবি পূরণ করতে গিয়ে কাজের চাপ খুবই বেড়ে গিয়েছিল। তদন্তকারীদের এই তথ্য জানিয়েছে প্রত্যক্ষদর্শী হাকিম। জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, গত অক্টোবর ২ সন্ধ্যায় স্ত্রী রাজিয়া ও শিশুসন্তানকে নিয়ে নদীয়ায় শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার উদ্দেশে কথা ছিল শাকিলের। খাগড়াগড় ছাড়ার আগে দশটা গ্রেনেড তৈরির কাজ যাতে শেষ হয়, সে জন্য ২ তারিখ সকাল থেকেই তাড়াহুড়ো করছিল সে। আর এতেই ঘটে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা।
×