ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৭ জুন ২০২৪, ৩ আষাঢ় ১৪৩১

দুগ্ধ উৎপাদনে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয়

ড. মিহির কুমার রায়

প্রকাশিত: ২০:৪৩, ২৬ মে ২০২৪; আপডেট: ২০:৪৭, ২৬ মে ২০২৪

দুগ্ধ উৎপাদনে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয়

.

বাংলাদেশে জনসংখ্যা বাড়ছে। একই সঙ্গে দুগ্ধ সামগ্রীর চাহিদাসহ উৎপাদনও বাড়ছে। বাংলাদেশ সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের (২০২১) তথ্য মতে, দেশে প্রতিবছর ৯০ লাখ ২৪ হাজার টন দুধ উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু চাহিদা রয়েছে ১ কোটি ৫৮ লাখ টন অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ১০ লাখ টনের কিছু বেশি। এর মানে হলো বাংলাদেশ তার মোট প্রয়োজনের মাত্র ৬৩ শতাংশ উৎপাদন করছে এবং বাকি ৩৭ শতাংশ ঘাটতি পূরণের জন্য প্রতিবছর প্রায় এক হাজার পাঁচশত কোটি টাকার দুধ আমদানি করছে বিদেশ থেকে। বিদ্বজ্জনসহ সমাজ বিশ্লেষকগণ মনে করছেন, যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা গুঁড়া দুধ আমদানিতে ব্যয়িত হয়, তা যদি স্থানীয় দুগ্ধ উন্নয়নে ঋণ কিংবা প্রণোদনা হিসেবে ব্যবহৃত হতো, তাহলে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে চাহিদার ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হতো।

কিন্তু দেশে দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধির পথে প্রধান অন্তরায়গুলো হলো- জমির দুঃষ্প্রাপ্যতা, গবাদিপশুর পর্যাপ্ত খাবারের স্বল্পতা এবং গরুর উৎপাদন ক্ষমতা। সার্বিক ব্যবস্থাপনা তথা নীতি সহায়তা পেলে বাংলাদেশ যে দুগ্ধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রতিজনের প্রতিদিন ২৫০ মিলিমিটার দুধ পান করা প্রয়োজন। দেশে সেখানে একজন মানুষের প্রাপ্তির মাত্রা ৪০ মিলিমিটার। সেই হিসেবে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মতে, সারাদেশে প্রতিদিন মাথাপিছু দুধের চাহিদা ১৪.৪৮ মিলিয়ন টন এবং একই সময়ে উৎপাদন হয় ৬.৯৭ মিলিয়ন টন অর্থাৎ প্রতিদিনের ঘাটতি দাঁড়ায় ৭.৫১ মিলিয়ন টন। এই বিশাল ঘাটতি পূরণের জন্য এখন আমদানি বাণিজ্যই একমাত্র ভরসা। অথচ এই সকল পণ্যে যে স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে তা নিয়ে কেউ কোনো কথা বলছে না। অথচ এই শিল্পের বিকাশে বাংলাদেশের যে অপার সম্ভাবনা রয়েছে, তা বাস্তবায়ন করা গেলে দেশ পুষ্টিতে স্বয়ম্ভর হবে। ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১ দশমিক ৪৪ শতাংশ এবং কৃষি জিডিপিতে তা ১০ দশমিক ৬৯ শতাংশ। যদিও পশুপালন উপখাতে জিডিপির ভাগ কম, দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় প্রাণিজ আমিষের প্রয়োজন মেটাতে এর বিশাল অবদান রয়েছে। কয়েক বছর ধরে প্রাণিজ আমিষ যেমনÑ দুধ, মাংস (গরু, খাসি, মুরগি) এবং ডিম উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু এই সকল পণ্যের বার্ষিক গড় দরদাম তেমন বাড়ছে না। যা এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত উৎপাদনের ইঙ্গিতবাহী।

এস.ডি.জি  ও দুগ্ধখাত

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) একটি উপাত্তে দেখা যায়, দেশের মোট ২ কোটি ৮৭ লাখ লোক গৃহস্থালীর কৃষির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংযুক্ত রয়েছে। এই কৃষির উপখাত প্রাণিসম্পদ দেশের প্রবৃদ্ধিতে, পুষ্টি উন্নয়নে এবং খাদ্য নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখছে বিশেষত শ্রমঘন, স্বল্প পুঁজি ও স্বল্প জমির প্রয়োজনহেতু। বিবিএসের বৈদেশিক বাণিজ্য পরিসংখ্যান হতে দেখা যায় যে, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে এই খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে যথাক্রমে চামড়াজাত পণ্য (২০২৪.১০ কোটি টাকা), মাংস ও মাংসজাত (৯.৮৮ কোটি টাকা), দুগ্ধজাত পণ্য (১৫.৯৭ কোটি টাকা), প্রাণিজ উপজাত (১২৬.৮১ কোটি টাকা) অর্থাৎ সর্বমোট ২১৭৬.৭৭ কোটি টাকা। দুগ্ধ উৎপাদন ১২.৮৩ লাখ মেট্রিক টন, মাংস ৭১.৫৪ লাখ মেট্রিক টন এবং ডিম ১৪৯৩ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। তারপরও দেখা যায় যে, দেশের বাড়তি জনসংখ্যার কারণে এই পরিমাণ উৎপাদন দেশের চাহিদা পূরণে সামর্থ্য হচ্ছে না। এখনো দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। যাদের মধ্যে শিশু ও নারীর সংখ্যাই বেশি। এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, সবার জন্যই পুষ্টি নিশ্চিত করতে হলে প্রাণিসম্পদ উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই।

সাম্প্রতিক সময়ে এক গোলটেবিল বৈঠকে খাদ্য নিরাপত্তা তৈরি, সুষম পুষ্টি নিশ্চিতকরণ, কর্মসংস্থান, নারীর ক্ষমতায়নসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নে প্রাণিসম্পদের  গুরুত্বের কথা উঠে এসেছে। এই বিষয়গুলো জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এস.ডি.জি) এর প্রায় ৯টি লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিধায় এই খাতকে গুরুত্ব দিলে এসডিজির দারিদ্র্য দূরীকরণ ও সুস্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়ক হবে ২০৩০ সালের মধ্যে। আবার বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের ভিশন-২০২১ অর্জনে জনপ্রতি দিনে দুধ ১৫০ মিলিমিটার চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে কাজ করছে দেশের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। দেশকে মধ্য রেখা উন্নত আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে প্রথম প্রয়োজন মেধা, যার সঙ্গে প্রাণিজ আমিষের সম্পর্ক রয়েছে।

এই বিবেচনায় সরকার প্রথমে সহস্রাদ্ধ উন্নয়ন লক্ষ্য (এম.ডি.জি) এবং পরবর্তীতে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এস.ডি.জি) এর প্রাণিসম্পদ সেক্টর ৯টি অভীষ্ট ও ২৮টি লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এরই মধ্যে এ সকল অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে  কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, যেগুলোর বাস্তবায়নে প্রয়োজন আইন ও নীতিমালা সহায়তা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, ঋণ সহায়তা বৃদ্ধি, গবাদিপশুর জাত উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবার সম্প্রসারণ, প্রাণিসম্পদ বিমা ব্যবস্থার চালুকরণ ও বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি। আবার প্রাণিসম্পদ খাতে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে গৃহীত নীতি ও কৌশল সমূহের মধ্যে রয়েছে প্রাণিসম্পদ সেবা সম্প্রসারণ, দুগ্ধ ও মাংস উৎপাদন,  কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে জাত উন্নয়ন, পশু-পাখির রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিকার, প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইত্যাদি। এখন ২০৩০ সালের মধ্যে প্রাণিসম্পদ সেক্টরে এসডিজি অর্জনের চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে- (১) জনবলসহ প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি (২) পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ ও বাজার ব্যবস্থার উন্নতিকরণ (৩) পরিবেশ বাজার গবাদিপশু উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা (৪) তথ্যপ্রযুক্তির ঘাটতি (৫) খামার পর্যায়ের প্রণোদনার অপ্রতুলতা।

দুগ্ধ উৎপাদনে চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থিত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বদ্বীপ। কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাত বাংলাদেশে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী নয়। অথচ দেশটি এর ভুক্তভোগী। এই চ্যালেঞ্জসহ কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের অন্যান্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার কাজ করছে। চলতি মৌসুমের তাপমাত্রা এরই মধ্যে অতীতের সব  রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বিভিন্ন স্থানে উত্তাপ ছড়িয়েছে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। সড়ক-মহাসড়কের কোথাও কোথাও পিচ গলে গেছে। জীবিকার তাগিদে ছুটে চলা মানুষের জীবন প্রায় ওষ্ঠাগত।

একই সঙ্গে প্রাণিকুলেরও। এ সময় দেশের প্রাণিসম্পদ বিশেষ করে দুগ্ধ খামারিরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। তাপপ্রবাহের কারণে সবুজ ঘাস মরে যাচ্ছে। সংকট দেখা দিয়েছে ঘাসের। গরুর খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। তাপপ্রবাহ  থেকে গরুকে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রাখতে খামারিদের বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে। একদিকে বেড়েছে ব্যয়, অন্যদিকে কমেছে দুগ্ধ উৎপাদন। ফলে, খামারিরা আর্থিকভাবেও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। সিরাজগঞ্জ ও পাবনা  থেকে দেশে উৎপাদিত দুধের বড় অংশ আসে। বিস্তীর্ণ চারণভূমি ও উচ্চ উৎপাদনশীল বিভিন্ন জাতের গরুর আধিক্য থাকায় এ দুধ উৎপাদনে বাড়তি সুবিধা দিয়েছে। দেশে চলমান তাপপ্রবাহের কারণে এ দুই অঞ্চলেই দুধ উৎপাদন কমেছে। গরমে কাঁচা ঘাস না থাকা এবং গবাদিপশু স্বাভাবিক খাবার খেতে না পারায় দুধ উৎপাদন কমেছে। তীব্র গরমে গরু মারা যাচ্ছে। নদীর পাশে যেসব খামার রয়েছে, তারা সহজেই পানি পাচ্ছে। যারা বাড়িতে খামার করেছে, সেসব খামারে গরুর উপযোগী তাপমাত্রা বজায় রাখতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। মিল্কভিটা সূত্র বলছে, মিল্কভিটার লক্ষ্য প্রতিদিন গড়ে ৯০ হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ করা। তবে প্রচন্ড গরমের কারণে খামারিরা ৫০-৫২ হাজার লিটারের  বেশি দুধ সরবরাহ করতে পারছেন না। ফলে, আর্থিকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন খামারিরা। প্রাণিসম্পদ খাতে খামারিরা তাপপ্রবাহের মতো চরম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতির মুখে পড়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। তাদের সহায়তা ও সুরক্ষায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে আসতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় খামারিদের সুরক্ষায় কাজ করতে হবে। পুষ্টিমানের বিচারে দুগ্ধপণ্যের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য হলেও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে এই স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠার তেমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

দুগ্ধ খামারিদের সুরক্ষায় করণীয়

দুধকে একটি আদর্শ খাদ্য বলা হয়, যেখানে পুষ্টির সকল গুণাবলি রয়েছে, যা বিশেষ করে শিশুদের শারীরিক গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তাই দুধের বিশুদ্ধতা রক্ষা করা সকলেরই দায়িত্ব, বিশেষ করে উৎপাদক (চাষি), ব্যবসায়ী (ঘোষ) ও প্রক্রিয়াজাতকরণ (কোম্পানি) পর্যায়ে, যার সঙ্গে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা/ খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত রয়েছে। তাই পুষ্টি, খাদ্য নিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্য ও শিশুর দুধে ভেজালজনিত বিষয়গুলোর একটি শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। বিশেষত ২০২৬ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে পৌঁছানোর আগে আমরা একটি দারিদ্র্যমুক্ত, পুষ্টিহীনমুক্ত, ভেজালমুক্ত ও দুর্নীতিমুক্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সুশাসিত বাংলাদেশ দেখতে চাই।

পৃথিবীব্যাপী বিশেষত উন্নত দেশে দুধের মান পরীক্ষার অনেক প্যারামিটার থাকে। যেমন- সিঙ্গাপুরে এই সংখ্যাটি ৩৮টি আর বংলাদেশে দুধের মান নির্ণয়ের প্যারামিটার মাত্র ৮টি। যার মধ্যে এন্টিবায়োটিক পরীক্ষা করার সামর্থ্য বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড ও টেস্টিং ইনস্টিটিউটের (বিএসটিআই)  নেই। এর সক্ষমতা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। এর মধ্যে দুগ্ধশিল্পের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে  এবং জনস্বাস্থ্যেরও যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও সাবেক 

জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি, ঢাকা

×