ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১

কিউবা দর্শন ও অর্জন

ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

প্রকাশিত: ২০:৩৯, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

কিউবা দর্শন ও অর্জন

কিউবায় এবারের যাওয়াটা ছিল দ্বিতীয়বারের মতো

একটিতে চিকিৎসা নিতেন ভেনিজুয়েলার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুগো চ্যাভেজ আর কিংবদন্তির ফুটবলার দিয়াগো ম্যারাডোনা। প্রতিটি হাসপাতালে হেপাটাইটিস বি রোগীর চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে ন্যাসভ্যাক আর এমনকি সুদূর চীন থেকে রোগী এসে ন্যাসভ্যাক নিয়ে সুস্থ হয়ে দেশে ফিরেছে

কিউবায় এবারের যাওয়াটা ছিল দ্বিতীয়বারের মতো। গত দশকে দেশটিতে প্রথম যে যাওয়া তা ছিল ন্যাসভ্যাকের ওপর ওখানে একটা সাইন্টিফিক মিটিংয়ে পেপার প্রেজেন্ট করার জন্য। হেপাটাইটিস বি’র এই নতুন ওষুধটির ফেজ-১ থেকে ৩ পর্যন্ত সবকটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর হওয়ার সুবাদে সেবার কনফারেন্সটির অর্গানাইজারদের আমন্ত্রণে প্রথমবারের মতো কিউবা যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল।

দেশটিতে নামার আগে আর দশজনের মতো ধারণা ছিল মার্কিন স্যাংশনে পর্যদুস্ত, দারিদ্র্যপীড়িত কোনো পুলিশি রাষ্ট্র দর্শনের অভিজ্ঞতা আমার হতে যাচ্ছে। যেখানে থাকবে শুধু ভাঙাচোড়া বাড়িঘর, দারিদ্র্যক্লিষ্ট নাঙ্গা-ভুখা মানুষ আর মোড়ে মোড়ে পুলিশ। সঙ্গে অবশ্যই থাকবে পঞ্চাশ আর ষাটের দশকের জরাজীর্ণ কিছু শেভ্রোলে আর ফোর্ড গাড়ি। সেবারে বাস্তবতাটা ধারণার কিছুটা কাছাকাছি হলেও পুরোপুরি ছিল না। ছিল পুরনো গাড়ি আর বাড়ি, কিন্তু ছিল না ভুখা মানুষ আর পুলিশ।

বরং মুগ্ধ হয়েছিলাম ভেরাদেরোর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে। একপাশে আটলান্টিক আর আরেকপাশে ক্যারিবিয়ান সাগর আর তার মাঝে ভেরাদেরো শহরটি। সোভিয়েত ইউনিয়নের যে সময় পতন হয়, তখন কিউবার আশি শতাংশ বাজেট আসত সে দেশটি থেকে। রাতারাতি সেই পাইপলাইনটি শুকিয়ে গেলে, ফিদেল ক্যাস্ট্রো কিউবার রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যৎসামান্য যা কিছু অবশিষ্ট ছিল, তা বিনিয়োগ করেন পর্যটন আর চিকিৎসাবিজ্ঞানে। এরই সফল বাস্তবায়ন ন্যাসভ্যাক আর ভেরাদেরো।

কিউবার অন্যতম বায়োটেক ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বায়োকিউবাফার্মা এখন এক দশমিক দুই বিলিয়ন ডলারের প্রতিষ্ঠান। অসংখ্য বায়োটেক ওষুধের উদ্ভাবক আর উৎপাদক প্রতিষ্ঠানটি। এই বায়োকিউবাফার্মার সহযোগী প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি সংক্ষেপে সিআইজিবি, ন্যাসভ্যাকের উৎপাদক।

বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত জাপানি চিকিৎসাবিজ্ঞানী শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর আর সিআইজিবির যৌথ প্রযোজনা এই ন্যাসভ্যাক, যা এখন মানবদেহের কোনো ক্রনিক ইনফেকশনের বিরুদ্ধে কার্যকর পৃথিবীর প্রথম ইমিউনোথেরাপি হিসেবে স্বীকৃত। অন্যদিকে স্রষ্টার বিশেষ যতেœ সৃষ্ট ভেরাদেরোতেই শুধু তারকা খচিত হোটেল রুমের সংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশি। সেবারের কনফারেন্সটা যেহেতু ছিল ভেরাদেরোর একটা হোটেলে, সেই সুবাদেই আমার ভেরাদেরো যাওয়া।
কনফারেন্সের ফাঁকে একদিন ক্যাটামারানে চেপে ক্যারিবিয়ানের স্বচ্ছ নীল জলরাশি চিড়ে ক্রুজে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। কিউবা থেকে ফ্লোরিডা উপকূল মাত্র নব্বই নটিক্যাল মাইল। ধারণা ছিল, হাভানা আর ভেরাদেরোর রাস্তায় না হোক, অন্তত সাগরে কিউবার নৌবাহিনীর টহলের দেখা মিলবে। সে আশায় গুড়েবালি। কোস্ট গার্ডের দেখা পেয়েছিলাম ঠিকই, তবে সেটা মার্কিন কোস্ট গার্ডের টহল জাহাজ। কিউবা থেকে কেউ মার্কিন মুলুকে পাড়ি জমাতে মনস্থ করলে তাদের স্বাগত জানাতে মার্কিন কোস্ট গার্ড সাগরে টহল দেয়, ঠেকাতে নয়। কিউবা আর ক্যাস্ট্রোকে ব্যর্থ প্রমাণে মার্কিনীরা তাদের অপচেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখেনি।
প্রায় বছর সাতেক পর এবারে কিউবায় যাওয়াটা ভিন্ন কারণ। দেশটির মহামান্য প্রেসিডেন্ট এক ডিক্রি বলে ডা. আকবর ভাই আর আমাকে সর্বোচ্চ বৈজ্ঞানিক সম্মাননা কার্লোস জে. ফিনলে অর্ডারের জন্য মনোনীত করেছেন। গর্বে আমার বুক তাই আকাশ ছুঁইছুঁই। তার ওপর মহামান্য ডিক্রিটিতে স্বাক্ষর করেছেন আমাদের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চে। কাজেই শুধু আহ্লাদে আটখানা নই, বরং পুরোখানাই।

আমাদের দুজনকে এহেন সম্মানে সম্মানিত করার কারণ, কালেকালে যখন বয়ে গেছে অনেক বেলা, ততক্ষণে ন্যাসভ্যাক পৌঁছে গেছে অন্য একটি মার্গে। ন্যাসভ্যাক এখন কিউবায় একটি রেজিস্টার্ড ওষুধ। সে দেশের ইনস্টিটিউট অব গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিসহ একাধিক হাসপাতালে এ যাত্রায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। এর মধ্যে একটিতে চিকিৎসা নিতেন ভেনিজুয়েলার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুগো চ্যাভেজ আর কিংবদন্তির ফুটবলার দিয়াগো ম্যারাডোনা। প্রতিটি হাসপাতালে হেপাটাইটিস বি রোগীর চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে ন্যাসভ্যাক আর এমনকি সুদূর চীন থেকে রোগী এসে ন্যাসভ্যাক নিয়ে সুস্থ হয়ে দেশে ফিরেছে। 
প্রেসিডেন্টের ডিক্রির জোড়ে পাওয়া পদক। সেই পদক নিতে এতবড় পথ পাড়ি দিয়ে রাষ্ট্রের অতিথি হিসেবে কিউবায় গেছি, রাষ্ট্র তাই যত্নের কমতি রাখেনি। হাভানার হোসে মার্টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রটোকল কর্মকর্তাদের বরণ করে নেওয়ায় বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে বসে খুব একটা ভিরমি খাইনি। ভিরমিটা খেলাম বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে। পঞ্চাশ আর ষাটের দশকের ওই ভিনটেজ গাড়িগুলো আছে ঠিকই, তবে সেসব এখন টুরিস্ট বাহন। টুরিস্টরা চড়াদামে সেসব গাড়িতে চেপে ঘুরছেন, সেলফি তুলছেন আর পটাপট ফেসবুক আর ইন্সটাগ্রামে আপলোড করছেন।

ইন্টারনেটের অবারিত প্রবাহে কোথাও কোনো সমস্যা নেই। ব্যক্তিগত কিংবা পাবলিক পরিবহন এ ভিনটেজ গাড়িগুলোকে হটিয়ে সে জায়গায় এখন চীন, দক্ষিণ কোরিয়া আর ইউরোপের তৈরি গাড়ির দৌরাত্ম্য। হাভানায় যে বিশাল পাঁচ তারকা হোটেলটিতে কিউবার সরকারি পয়সায় থাকার সুযোগ হলো, সেই মুথু গ্র্যান্ড হোটেলটি দক্ষিণ ভারতের এমজিএম গ্রুপের ইনভেস্টমেন্ট। পাশেই বীচের ওপর কড়াই রেস্তোরাঁ।

এই প্রথম জানলাম- কড়াই জাপানি শব্দ, যার অর্থ ঝাল আর রেস্তোরাঁটিতে সার্ভ করা হচ্ছে চমৎকার জাপানিজ মেনু। হাভানা থেকে ভেরাদেরো যাওয়ার সেই দুই লেনের হাইওয়ে এখন ইতিহাস। সে জায়গায় এখন প্রশস্ত চার লেনের মহাসড়ক। বাড়ি-ঘরে উন্নতির তেমন ছোয়া লাগেনি ঠিকই, কিন্তু এক কোটি দশ লাখ কিউবান এখনো আগের মতোই বিনামূল্যে চিকিৎসা, শিক্ষা আর বসতবাড়ি পাচ্ছে রাষ্ট্রের কাছ থেকেই।

সাত বছরের ব্যবধানে ভেরাদেরোতে শুধু হোটেল রুমের সংখ্যাই বাড়েনি, বেড়েছে হোটেলের সংখ্যা আর চাকচিক্যও। আছে প্রায় প্রতিটি ইউরোপিয়ান চেইন হোটেলের সরব উপস্থিতি। ভেরাদেরোতে কিউবার সরকারের আতিথেয়তায় আমাদের থাকা হলো মিলিয়া ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে আর বায়োহাভানা ২০২৪ নামের যে আন্তর্জাতিক কনফারেন্সটিতে পুরস্কার নেওয়ার ফাঁকে ন্যাসভ্যাকের ওপর কি-নোট লেকচারটি দিলাম, সেই প্লাজা আমেরিকা কনভেনশন সেন্টারটির সঙ্গেই লাগোয়া মিলিয়া ভেরাদেরো হোটেলটি। এক ভেরাদেরোতেই আছে মিলিয়া গ্রুপের তিন তিনটি হোটেল।

লেখক : অধ্যাপক, ডিভিশন প্রধান,
ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও 
সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

×