একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মাঝে নানা রকমের হিসাব-নিকাশ শুরু হয়ে গেছে। ক্ষমতায় যাওয়ার একমাত্র গণতান্ত্রিক উপায় নির্বাচন এবং এটিই রাজনীতিবিদদের মাঝে প্রতীয়মান। তবে নানামুখী গুঞ্জন শোনা গেলেও নির্বাচনের বিকল্প অন্য কোন শক্তিকে এদেশের জনগণ মেনে নেবে না- এটা ১/১১-এর সময় পুরোপুরি বার্তা দিয়ে রেখেছে। তাই ছোট-বড় রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো নির্বাচনের হিসাব-নিকাশ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেÑ এটি নিঃসন্দেহে ভাল লক্ষণ।
সম্প্রতি ছোট দলগুলো নির্বাচনমুখী হয়ে সংগঠনের নিবন্ধন করতে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা মেনে আবেদন করেছে। যাচাই-বাছাইয়ে দেখা গেছে, অনেক সংগঠনের সভাপতি আছে আবার সাধারণ সম্পাদক বা মহাসচিব নেই। আবার তিন/চার সদস্যের কমিটি আছে অফিস নেই। কাগজে-কলমে অফিসের ঠিকানা আছে, কিন্তু বাস্তবে অফিস খুঁজে পাওয়া যায়নি। আরও মজার বিষয় হচ্ছে, অনেকে নির্বাচন কমিশনের ধার্যকৃত নির্ধারিত ফি পর্যন্ত জমা দিতে পারেনি। তবে রাজনীতি করছে, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে, ক্ষমতার অংশীদার হতে চায়- এই দিবাস্বপ্নে রীতিমতো দিশেহারা। কিন্তু ওইসব রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক সংগঠনের গ্রহণযোগ্যতা, জনপ্রিয়তা কতটুকু- এই প্রশ্নের উত্তর হয়ত তাদেরও জানা নেই। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আছে, সকাল-সন্ধ্যায় মিথ্যাচার করছে, শেখ হাসিনার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করার কাজগুলো আবার ঠিকঠাক মতোই করে যাচ্ছে। অনেকে ওইসব রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে সমালোচনা করলেও আমি মনে করি- গণতন্ত্রের চর্চা, প্রত্যেকের নিজেস্ব মতামত তুলে ধরার অধিকার কিংবা ব্যক্তির বাক স্বাধীনতাটুকু বজায় রাখতে সক্ষম হচ্ছে।
গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানতে পারি- জোট, মহাজোট কিংবা এই ফ্রন্ট বা ওই পরিষদের ব্যানারে সকালে ৩০-৪০টি আবার বিকেলে ৫০-৬০টি দল এক হলেও, সন্ধ্যা গড়াতে না গড়াতে আবার ভেঙ্গে যাচ্ছে। কার সঙ্গে কে থাকবে, কার কী অধিকার খর্ব হচ্ছে, কার কী ভূমিকা থাকবে- এ নিয়ে মতানৈক্য থেকে ভাঙ্গা-গড়ার খেলা হলেও মূলত ওইসব রাজনৈতিক নেতা বা দল আদৌ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে কিনা-এটি স্পষ্ট করতে পারেনি। স্বাধীনতাবিরোধীদের বয়কট করবে কিনা- এই সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি।
আমার ব্যক্তিগত তথ্য-উপাত্ত বলে, বিএনপি-জামায়াতের অনেক নেতাই দলছুট হয়ে বিভিন্ন নামে রং লাগিয়ে এবার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত প্রায় পাকাপোক্ত করে রেখেছে। অভাব শুধু নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল! কারণ, অনিবন্ধিত কোন রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। একদিকে জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক দল হিসেবে সংগঠনের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষিত হয়েছে ২০১৩ সালেই আবার অন্যদিকে রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী দল হিসেবে জাতির সামনে জামায়াতের অপকর্মগুলো দৃশ্যমান হয়েছে। তাই নতুন নামে, নতুন মোড়কে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কৌশল নির্ধারণের হিসাব-নিকাশ করছে। যার নমুনা বিভিন্ন দলে অর্থ দিয়ে হলেও নিজেদের অবস্থান নির্ণয় করা, অনলাইনে এবং একান্তভাবে খ- খ- মিটিংগুলোর মাধ্যমে জামায়াতের রাজনৈতিক কলাকৌশল নির্ধারণ করে চলেছে। কাগজে-কলমে ছোট ছোট থাকলেও জনগণ আদৌ ওইসব রাজনৈতিক নেতাদের নাম জানে কিনা- এটির যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বর্তমান সরকারের এমপি-মন্ত্রীদের অতিথি করে অনেক রাজনৈতিক দল তাদের কর্মসূচী বা আলোচনা সভা করলেও মূল গণমাধ্যম আবার কোন দলের ব্যানারে কোন অতিথি কী বলেছে- এটি এড়িয়ে যাচ্ছে। আমাদের মূল গণমাধ্যমও যে অনেক সময় শুধু অতিথিকে মূল্যায়ন করে, সংগঠনকে নয়, সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে তুলে ধরে থাকে।
এখানে কারণটাও স্পষ্ট! অনুষ্ঠান কাভার করা সংবাদকর্মী থেকে আরম্ভ করে প্রতিষ্ঠানের বার্তা প্রধান পর্যন্ত জানে, ওইসব সংগঠন নামে মাত্র। সভাপতি থাকলেও অন্যদের খুঁজে পাওয়া যায় না। তাদের মুখের মন্ত্র (শুধু বড় বড় কথা) থাকলেও সংগঠনের সুনির্দিষ্ট গঠনতন্ত্র নেই। জেলা-উপজেলা দূরের কথা, অনেক সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া কঠিন! আর তাই প্রতিষ্ঠানের সুনাম আর সংবাদের গ্রহণযোগ্যতা বজায় রাখতে অনেক সংগঠনের নাম উল্লেখ না করেই সংবাদ প্রচার-প্রকাশ করে থাকে।
বঙ্গবন্ধু একটি দেশ দিয়েছে, স্বাধীন-সার্বভৌম মাটি দিয়েছে এবং ঘরে ঘরে রাজনীতি করার অধিকার দিয়েছে। আর তারা রাজনৈতিক চর্চা করবে এটাই স্বাভাবিক। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, এসব রাজনীতিবিদের মধ্য থেকে নেতা তৈরি হবে এবং নেতৃত্ব দেবে দেশ ও জাতিকে। বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে একদিন তারাও অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু যাঁরা ইতোমধ্যেই জাতীয় রাজনীতির অংশ হিসেবে নিজেদের পরিচিতির খ্যাতি অর্জন করেছে (!) তাঁদের ভূমিকা কী, এটি পর্যবেক্ষণের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, দেশজুড়ে তাঁদের জনপ্রিয়তা আর গ্রহণযোগ্যতার চেয়েও আমাদের গণমাধ্যম জুড়ে তাঁদের জনপ্রিয়তা বেশ সুন্দর করে দেখানো হয়। এখানে এক দলের এক নেতা হলেও ওই নেতারা প্রতিনিয়ত টকশোতে যাচ্ছে। কোথায় কী করছে-এটিও ফলাও করে প্রচার-প্রকাশ করে থাকে।
সম্প্রতি বিজ্ঞ আইনজীবী ড. কামাল হোসেনকে ঘিরে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা দেখা যায়। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে একটানা গণফোরাম নামক দলটির প্রধান হয়ে তিনি বহাল তবিয়তে রয়েছেন। নিজের দলে গণতন্ত্র নেই আবার অন্যদের গণতন্ত্রের ছবক দিচ্ছেন- এই ধরনের সমালোচনা দেখা গেলেও আমি বলব, দলের অন্য নেতাকর্মীরা বার বার আমাদের বিখ্যাত আইনজ্ঞ ড. কামাল হোসেনকে একই পদে নির্বাচিত করলে- এটা দোষের কিছু নয়। তিনি আরও ত্রিশ বছর থাকলেও এটি অপরাধের মধ্যে পড়ে না, যদি গণফোরাম নামক সংগঠনের গঠনতন্ত্রে এমন কিছু উল্লেখ থাকে!
ড. কামাল হোসেন নিঃসন্দেহে এদেশের হেভিওয়েট রাজনীতিবিদ। বিদেশেও তিনি অনেক গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। অক্সফোর্ডে পড়া আমাদের ড. কামাল হোসেন আইনজীবী হিসেবে দেশে-বিদেশে জনপ্রিয়তা আর গ্রহণযোগ্য অর্জন করলেও নিজ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কতটুকু গ্রহণযোগ্য বা জনপ্রিয়- এটি একটি প্রশ্ন। কারণ, অনেকে বলেন- আইনমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের কাজে নেতৃত্বদানের কৃতিত্ব ছাড়া এই কামাল সাহেবের ঝোলাতে আর কোন ‘অবদান’ এর কথা খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনকি শোনাও যায় না। একজন দক্ষ আন্তর্জাতিক আইনজীবী হিসেবে দেশে-বিদেশে আইন পেশায় তিনি প্রচুর অর্থ রোজগার করেন। কিন্তু বিপুল এই অর্থ সম্পদ ব্যক্তিগত ভোগবিলাস ছাড়া আর অন্য কোন খাতে ব্যয় হতে দেখা বা শোনা যায়নি। সামাজিক কোন খাতে কখনও সামান্য অর্থ দান করার অবদানও তিনি রাখেননি।
আর ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন তাও বঙ্গবন্ধুর উদারতায়। সর্বকালের মহামানব জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের হেভিওয়েট এই আইনজীবী ড. কামাল হোসেনকে ভালবেসে শুধু সংসদ সদস্যই করেনি, তাকে মন্ত্রিপরিষদে আইনমন্ত্রী করে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের কাজে নেতৃত্বদানের কৃতিত্ব অর্জন করার সুযোগটিও করে দেন।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দেখা হয়। তিনি মন্ত্রী হিসেবে তাকে একটি বিবৃতি দিতে বললেও, তিনি তা দেননি। জাতির জনকের হত্যাকা- নিয়ে কোন বিবৃতি না দিলেও কোটা সংস্কারের নামে মুক্তিযোদ্ধা কোটাবিরোধী আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনাকে ব্যক্তিগত আক্রমণকারীদের পক্ষে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছেন। ঈদের আগেই তাদের জামিন আবেদনে প্রয়োজনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দশ মিনিট সাক্ষাত চেয়েছেন! দুঃখজনক হলেও সত্য, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ে চেনা মানুষগুলো কীভাবে রাতারাতি বদলে যেতে পারে এবং এদেরই একজন আমাদের বিজ্ঞ আইনজীবী ড. কামাল হোসেন। এর উদাহরণ- এটি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানার ভাষ্যমতে উঠে আসে।
আইন পেশায় ড. কামাল হোসেনের অসাধারণ জনপ্রিয়তা আর গ্রহণযোগত্যায় আমি ব্যক্তিগতভাবে মুগ্ধ এবং তার অসাধারণ জ্ঞান-প্রজ্ঞা নিয়ে কারও মধ্যে বিন্দুমাত্র সন্দেহ আছে বলেও আমার মনে হয় না। কিন্তু এত যোগ্যতা ও মেধা থাকা সত্ত্বেও তিনি গণমানুষের নেতা হতে পারেননি। রাজনৈতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে অন্ধকার নেমে এসেছিল, সেই অন্ধকার দূর করে জনগণকে আলোর পথ দেখাতে তিনি বরাবরই ব্যর্থ হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগেও তার ঠাঁই হলো না। ড. কামাল হোসেনের গণফোরামের শুরুটাও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। ঢাকার এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হল এবং কেরানীগঞ্জের এলাকায় একসময় মন্টু বাহিনী যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল সে মোস্তফা মহসিন মন্টুকে নিয়ে গণফোরাম গঠনকালে ড. কামাল হোসেন তার ভক্ত-অনুরাগীদের হতাশ করেছেন। কামাল সাহেবের সততা আর প্রাজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও তখন মন্টু ছিল প্রকাশ্য দিবালোকে বিতর্কিত একজন।
পাঠক! এখন প্রশ্ন আসতেই পারে, এই মন্টুকে নিয়ে আমাদের প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ ও আইন পেশায় জনপ্রিয় ড. কামাল হোসেন কি জনগণের জন্য রাজনীতি করেছিলেন? গণফোরাম কি আদৌ দেশের জনগণের জন্য কিছু করতে পেরেছে? জনগণের অধিকার আদায়ে ড. কামাল হোসেনের ভূমিকা কী? অবশ্য এই প্রশ্নের উত্তর বার বার জনগণ দিয়েছে তাদের ভোট প্রদানের মাধ্যমে। ড. কামাল হোসেন একাধিকবার নির্বাচন করেও জনগণের প্রতিনিধি হতে ব্যর্থ হয়েছেন। জনগণ প্রতিবারই তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
অনেকে বলেন, কামাল হোসেন জন্মেছেন কলকাতায়, বেড়ে উঠেছেন ঢাকায় আর বিয়েশাদি করেছেন পাকিস্তানে। আবার শোনা যায়, একাত্তরের নয় মাস তিনি সেই পাকিস্তানের শ্বশুরবাড়িতেও বেশ আরাম আয়েশে ছিলেন। আরেকটি প্রশ্ন এমনিতেই উঠে আসে, তাহলে মহান মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা কী ছিল? যদিও বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকা-ের সময় তার ভূমিকা ছিল বিতর্কিত এবং হতাশার।
মূলত আমাদের বিজ্ঞ আইনজীবী ড. কামাল হোসেন তার আইন পেশায় যতটা সফলতা পেয়েছেন ঠিক তার বিপরীত ব্যর্থতাগুলোও পরিসংখ্যানের বাইরে নয়। ১৯৮১ সালে বিএনপি প্রার্থী বিচারপতি সাত্তারের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট পদে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে ‘জঙ’ এর ময়দানে কামাল হোসেন থাকলেও ষাটের দশকের মোনেম খানের পা-াখ্যাত আবুল হাসানাতের হুমকি শুনেই প্রতিযোগিতার মাঠ থেকে তিনি রীতিমতো পালিয়ে গেছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বিনা লড়াইয়ে মাঠ ছেড়ে এভাবে চলে যাবেন, এমনটা স্বপ্নেও কারও ভাবনায় আসেনি। হতাশ করেছেন নীতিনির্ধারকদের। হতাশ করেছেন তার ভক্ত-অনুরাগীদের। পরে আওয়ামী লীগ সিনিয়র নেতাদের অনেক অনুরোধের পর তিনি বিদেশ থেকে ফিরে আসেন নির্বাচনী মাঠে। কিন্তু তার সেই জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর আর শোনা যায়নি। পরিবর্তিত এক কামাল হোসেনকে দেখতে পেয়েছে দেশ ও জাতি।
দেশের ও জাতির জন্য ড. কামাল হোসেনের ভূমিকা নিয়ে আজকাল অনেকেই দেখি সমালোচনা করছেন। আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে তার অবদান খুঁজে দেখার চেষ্টা করে বরাবরই ব্যর্থ হয়েছি। সত্যিই তো, তিনি কী করেছেন এদেশের মানুষের জন্য? দেশের কঠিন সময়ে কামাল হোসেনের অবস্থান কতটা আপোসহীন ছিল? মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ নিয়েও তার অবস্থান কোন পর্যায়ে ছিল (?)-এই ধরনের প্রশ্ন তুলতেও দ্বিধা করছে না।
দুঃখজনক হলেও সত্য, এই কামাল হোসেনের জামাতা ব্যারিস্টার সারা হোসেনের স্বামী ডেভিড বার্গম্যান পরিকল্পিতভাবে রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচারকাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করার লক্ষ্যে কাজ করেছে। তার একান্ত ব্লগ সাইটে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে দেশ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার ষড়যন্ত্র করেছে। শুধু এটিও নয়, ব্যক্তিগত ব্লগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে মন্তব্য করায় আদালত অবমাননার দায়ে ২০১৪ সালে ২ ডিসেম্বর বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ ডেভিড বার্গম্যানকে আদালতে দাঁড়িয়ে থাকার দ-ের পাশাপাশি পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে সাত দিনের কারাদ- দেয়। কিন্তু কামাল হোসেন একবারও কি তার জামাতা ডেভিড বার্গম্যান কর্তৃক বিভ্রান্তি ছড়ানো থেকে তাকে বিরত থাকার আহ্বান করেছিলেন? একবারও কি বুঝিয়েছিলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এ জাতির আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন? হয়ত করেননি! হয়ত অন্য কোন জায়গায় তার প্রতিবন্ধকতা ছিল, নয়ত আদর্শগত জায়গা তার বিতর্কিত।
ইদানীং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আমাদের বিজ্ঞ আইনজীবী ড. কামাল হোসেন বেশ তৎপর হয়ে উঠেছেন। শোনা যাচ্ছে, ভেতরে ভেতরে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে তার একটা সমঝোতা হয়েছে। এটা কী আদর্শগত নাকি অর্থনৈতিক-এটা নিয়ে বিশ্লেষণ চলছে। আর তার সঙ্গে কিছু দলছুট বা ছন্নছাড়া এতিম রাজনৈতিক নেতা ভিড় করেছে। বিভিন্ন ব্যানারে আয়োজিত সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে একই টেবিলে তাদের দেখতে পাই। আবার বিভিন্ন বাসা-বাড়িতেও বৈঠক করেন ভাইবার মান্নাখ্যাত মাহমুদুর রহমান মান্না, আসম রব, ডা. বদরুদ্দোজ্জা চৌধুরী, ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, কাদের সিদ্দিকী, সুলতান মনসুরসহ আরও অনেকে।
পাঠক! এখানে রাজনৈতিক এতিমখানা বলার কারণ আমার চেয়েও আপনারা বেশ ভালভাবেই অবগত আছেন বলেই দৃঢ় বিশ্বাস। মিডিয়ায় প্রচারিত-প্রকাশিত এই হেভিওয়েট নেতাদের অবস্থান পত্রিকায় পাতায় পাতায়। রাজধানীর বাইরে জেলা, উপজেলায় তাদের কর্মী তো দূরের কথা, সমর্থক খুঁজে পেতে অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সহযোগিতা নিতে হবে।
আর তাই ওইসব নেতা নিজেদের সমর্থক-কর্মী সঙ্কটের অভাববোধ থেকেই কখনও কোটা সংস্কারের মতো বিতর্কিত আন্দোলনকে পুঁজি করে গা ভাসিয়ে দিতে চেষ্টা করে। আবার নিরাপদ সড়ক দাবির একটি যৌক্তিক ও সুন্দর আন্দোলনকে বিতর্কিত করতে বিএনপি-জামায়াতের চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের দিয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে ষড়যন্ত্র করে। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান-অপদস্থ করলেও, স্বাধীন-সার্বভৌমত্ব নিয়ে ষড়যন্ত্র করলেও, আমি রাজাকার বলে রাজাকারের বাচ্চারা নিজেদের সত্যিকারের পরিচয় তুলে ধরলেও এসব অসহায় নেতা তাদের সমর্থন পেতে তাদের পক্ষে বক্তব্য-বিবৃতি দিতে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে দেখা যায়। এমনকি নিজেদের দোকান খ্যাত এক নেতার এক সংগঠনের ব্যানারেও অনেক সময় ভাড়া করা লোক দিয়ে কর্মসূচীর নামে ষড়যন্ত্রের অংশীদার হয়ে পড়ে। আর এই এতিমখানার নেতাদের নেতাকে এদেশের জনগণ বার বার ভোটের বাজারে প্রত্যাখ্যান করেছে। তবে লবিস্ট হয়ে, কোন রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে, মিথ্যাচার করে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে এরা আবার বেশ সফল। এই যেমন, আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের ধারাবাহিক অপরাধের সুনির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেফতার নিয়ে শুরু হয়েছে মিথ্যাচার। একদিকে খুব জঘন্যভাবে এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে মিথ্যাচার-অপপ্রচার করছে এই বলে যে, বাংলাদেশে গণহত্যা চালাচ্ছে, বাক স্বাধীনতা নেই, গণতন্ত্র নেই, মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করছে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। আবার অন্যদিকে বিতর্কিত এবং দীর্ঘদিন অবৈধভাবে পরিচালিত দৃক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে ‘বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তি’ বলে ফাঁপানো-ফুলানো হচ্ছে। একজন কীর্তিমান আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে বিশ্বখ্যাত করে তুলে ধরার মূল উদ্দেশ্য কী? আর কারা এই নেপথ্যে কাজ করছে?
পাঠক! একটি ব্যাপার লক্ষ্য করলে আপনিও বুঝে যাবেন এই যে, বিশ্বের ২৮ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি, যাদের মধ্যে ১১ জনই নোবেলজয়ী ব্যক্তিত্ব, তারা বাংলাদেশে শহিদুল আলম নামের এক আলোকচিত্রশিল্পীকে গ্রেফতার, তার ওপর পুলিশের শারীরিক অত্যাচার-নির্যাতনের তীব্র প্রতিবাদ করেছেন এবং এমন কথাও তারা বলেছেন, বাংলাদেশে মতামত প্রকাশের ন্যূনতম স্বাধীনতাও নেই (!) বিবৃতি দিয়েছে এটি নিয়ে একান্তভাবে চিন্তা করলে বুঝবেন, শহিদুল আলমের ওপর যে অত্যাচার হয়নি, তাই সাজিয়ে-গুছিয়ে সত্য হিসেবে কারা বাজারে ছড়াল?
সম্প্রতি মিয়ানমার সরকার কর্তৃক রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর অত্যাচার, নির্যাতন, ধর্ষণ, গণহত্যার ক্ষেত্রেও এমনটা দেখা যায়নি। তাহলে এদেশে বসবাস করে, এদেশের আলো-বাতাসে বড় হয়ে আবার এই দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে কারা ষড়যন্ত্র করছে এটা অবশ্যই গভীরতম চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আর এই ষড়যন্ত্র ইদানীং ঘনীভূত হয়েছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে। বক্তব্য-বিবৃতির ডামাঢোল বাজাতে শুরু করেছে। পর্দার আড়ালে চলছে নানামুখী গেম প্ল্যান! বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া এতিমের টাকা আত্মসাতের অপরাধে কারাগারে। জিয়াপুত্র তারেক বিচারের রায় মাথায় নিয়ে দেশের বাইরে পলাতক। জামাতের শীর্ষ নেতাদের অপরাধে ফাঁসি হয়েছে। বিচার চলমান আছে। জামায়াত রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীর দল। জাতির কাছে বিএনপি-জামায়াত ইতোমধ্যই অপরাধী সংগঠন হিসেবে মূল্যায়িত হয়েছে। তাই এতিমের টাকা আত্মসাতের নেত্রীর জায়গায় এতিমখানার এতিম রাজনৈতিক নেতাদের দিয়ে এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার ষড়যন্ত্র করছে যা- দেশ, দেশের জনগণ ও স্বাধীন-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন
এ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)
[email protected]
শীর্ষ সংবাদ: