জঙ্গী দমনে যতটা তৎপর ও সক্রিয়তা দেখা যায়, জঙ্গীদের বিচারের কাজ ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে ততই সময়ক্ষেপণ ও ঝুলিয়ে রাখায় অভ্যস্ত যেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বহু কাঠখড় পুড়িয়ে জঙ্গী গ্রেফতার করে কিন্তু চার্জশীট হয়ে পড়ে দুর্বল। ফলে জঙ্গীরা অনায়াসে জামিনে ছাড়া পেয়ে আবার অপতৎপরতায় জড়িত হচ্ছে। দেশে জঙ্গীবাদী অপরাধের তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে তাই প্রশ্ন ওঠে বার বার। জঙ্গীপনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বিচার চলছে ধীরলয়ে। বছরের পর বছর গড়ায় কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদন আর মেলে না সহজে। তদন্তে অনীহা, গাফিলতি, অবহেলা যেমন রয়েছে, তেমনি জঙ্গী সংযোগ থাকার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। জঙ্গীদের অর্থবলের কাছে অনেক কিছুই নতজানু হয়ে যায়। তাই কারাগারে আটক জঙ্গীরা ফোন ব্যবহারও করতে পারে। এমনকি বেশ আরাম-আয়াশে দিন গুজরান করে বলে গণমাধ্যমে খবর ছাপা হয়। এক হিসাবে দেখা যায়, গত বারো বছরে জঙ্গী অপরাধের বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছে, তার অর্ধেকের বেশির তদন্ত প্রক্রিয়া প্রায় থেমে আছে কিংবা চলছে ধীরগতিতে। আবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন না পাওয়ার কারণে অনেক জঙ্গীর বিরুদ্ধে তদন্ত মামলা পরিচালনা করা যাচ্ছে না। মন্ত্রণালয় পর্যালোচনা করে অনুমতি না দেয়ায় এসব ঝুলে আছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা শুধু নয়, মতাদর্শগত সমস্যার কারণেও মামলার অনুমতির জন্য চাওয়া আবেদনগুলো ফাইলবন্দী পড়ে আছে। প্রশাসনের অন্দরে জঙ্গী সমর্থক থাকা বিচিত্র কিছু নয়। বিএনপি-জামায়াত জোট শাসনামলে জঙ্গীবাদের বিকাশ ঘটানো শুধু নয়, জঙ্গী সংযোগের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সমর্থকরাও প্রশাসনে ঠাঁই পেয়েছে। তাই জঙ্গীরা অবলীলায় জামিন পেয়ে যায় এবং মুক্ত হয়ে আবার জঙ্গী হামলা চালিয়ে আসছে। তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার কারণে দায়ের করা মামলাগুলোর নিষ্পত্তি তো হচ্ছেই না, বরং গ্রেফতারের পরও জামিন নিয়ে পালিয়ে গেছে দুই শতাধিক জঙ্গী। ২০১৬ সালে সংঘটিত জঙ্গী হামলাগুলোর পেছনে জামিনে মুক্তদেরও ভূমিকা ছিল। বিচারকাজ বিলম্বের প্রধান কারণ দেখানো হচ্ছে যে, সাক্ষীরা ভয়ে আদালতে হাজির হচ্ছে না। তারা জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের ভয়ে ঝুঁকি নিতে চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক। মামলা পরিচালনার স্বার্থে সাক্ষীদের সুরক্ষা প্রদান আদালতের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সাক্ষীরা গরহাজির হলে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে তাদের হাজির করানো যায়। আইনগত ফাঁকফোকর দিয়ে জঙ্গীরা জামিন পেয়ে যায়। তদন্ত প্রতিবেদন এমন দুর্বলভাবে উপস্থাপন করা হয় যে, জঙ্গীরা অনায়াসে পার পাচ্ছে। জঙ্গীদের পক্ষে কোন আইনজীবী না থাকা সত্ত্বেও এরা মুক্ত হচ্ছে। দুর্ধর্ষ জঙ্গীরা কীভাবে জামিন পায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কেন মামলা দায়েরের অনুমতি ঝুলিয়ে রাখে, তদন্ত প্রতিবেদন দুর্বল হয়, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সক্ষমতায় ঘাটতি আছে কিনা বা বিচার-বিবেচনার কাজটি করার কোন কর্তৃপক্ষ কার্যকর কিনা তা অস্পষ্ট। জঙ্গীবাদ আন্তর্জাতিক উপসর্গ হলেও দেশী জঙ্গীদের নির্মূল সাধনের পাশাপাশি দ্রুত বিচার হওয়া উচিত। জনগণও চায় দ্রুত বিচারের মাধ্যমে পদক্ষেপ গ্রহণ, যা জঙ্গীবাদের শেকড় উপড়ে ফেলতে সহায়ক হবে। এত অসঙ্গতির মধ্যেও রংপুরে জাপানী নাগরিক হত্যা এবং কাউনিয়ার টেপামধুপুর মাজারের খাদেম হত্যা মামলার রায় হয়েছে। তাতে ৭ জনকে ফাঁসির দ-াদেশ দেয়া হয়েছে। জঙ্গীদের মৃত্যুদ- প্রদানের মধ্য দিয়ে আইনের শাসন আরও শক্তপোক্ত হয়েছে। নব্য জেএমবির সদস্যদের দ-াদেশ জঙ্গীদের তৎপরতা কমাতে সহায়ক হবে। লেখক ও শিক্ষক মুহম্মদ জাফর ইকবাল হত্যা চেষ্টার মামলাটিরও দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া জরুরী। জঙ্গীদের বিষয়ে গাফিলতি, অবহেলা ও দায়িত্বহীনতা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। জঙ্গীদের বিচার ‘দ্রুত বিচার আইনে’ করা না গেলে তাদের অপতৎপরতা বাড়তে পারে। তাই জঙ্গীমুক্ত দেশ রাখতে হলে সুপরিকল্পিত ও আন্তরিক প্রচেষ্টা জরুরী। শুধু কথায় নয়, বাস্তবেও আক্ষরিক অর্থে দেশ হোক জঙ্গীমুক্ত।
শীর্ষ সংবাদ: