ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ভাষা সংগ্রামী রওশন আরা বাচ্চুর চিরবিদায়

প্রকাশিত: ১১:২০, ৪ ডিসেম্বর ২০১৯

ভাষা সংগ্রামী রওশন আরা বাচ্চুর চিরবিদায়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় তিনি রেখেছিলেন সাহসী ভূমিকা। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে নেমেছিলেন রাজপথে। বুলেটের আঘাতে মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে মিছিলে শামিল হয়ে ভেঙ্গেছিলেন পুলিশী ব্যারিকেড। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আহত হয়েছিলেন পুলিশের লাঠিচার্জে। শেষ হলো অসীম সাহসী এই সংগ্রামী নারীর জীবন পরিভ্রমণ। প্রিয় পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে পাড়ি জমালেন ভাষাসংগ্রামী রওশন আরা বাচ্চু। তিনি মঙ্গলবার সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজধানীর এ্যাপোলো হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি ... রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। রেখে গেছেন চার মেয়ে তাহমিদা খাতুন, তাহমিনা খাতুন, তাহসিনা খাতুন ও তানভির ফারহানা ওয়াহিদসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন ও শুভাকাক্সক্ষী। এই ভাষাসংগ্রামীর মেয়ে তাহমিদা খাতুন জনকণ্ঠকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন মা রওশন আরা বাচ্চু। এর মাঝে রবিবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে এ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নিউমোনিয়া ও ইউরিন ইনফেকশনে আক্রান্ত মঙ্গলবার সকাল সাড়ে দশটায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। বিকেলে তার মরদেহ বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে নিয়ে আসা হয়। সেখানে এই ভাষাসংগ্রামীকে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে প্রথম জানাজার পর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তার মিরপুরের পশ্চিম মনিপুরের বাসায়। বাসভবন সংলগ্ন বায়তুল আমান মসজিদে বাদ মাগরিব দ্বিতীয় জানাজার পর এই ভাষাসৈনিককে নিয়ে যাওয়া হয় মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার উছলাপাড়ার গ্রামের বাড়িতে। আজ বুধবার সকালে সেখানে তাকে সমাহিত করা হবে। বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে রওশন আরা বাচ্চুর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ। একাডেমির নজরুল মঞ্চে তার শ্রদ্ধানুষ্ঠানে ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা জানান জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, জাতীয় অধ্যাপক ভাষাসংগ্রামী রফিকুল ইসলাম, নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, লোক গবেষক শামসুজ্জামান খান, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী, ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল ও প্রাবন্ধিক মোনায়েম সরকার প্রমুখ। তার প্রতি প্রাতিষ্ঠানিক শ্রদ্ধা নিবেদন করে বাংলা একাডেমি ও লেখিকা সংঘ। শ্রদ্ধানুষ্ঠানে রওশন আরা বাচ্চুর ছোট মেয়ে তাহমিদা বলেন, বিভিন্ন জায়গায় ইংরেজীতে সাইনবোর্ড দেখলে মা কষ্ট পেতেন। তিনি সব সময় বাংলা ভাষার অবমাননা ও উপেক্ষার বিরুদ্ধে কথা বলতেন। বিশ^ব্যাপী বাংলাভাষাকে ছড়িয়ে দেয়ার স্বপ্ন দেখতেন। এটি হলেই আমার মায়ের আত্মা শান্তি পাবে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ’৫২ সালে ভাষাসংগ্রামী হিসেবে তিনি নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন। বাংলাভাষার প্রতি তীব্র মমতার কারণে দীর্ঘকাল ধরে সর্বস্তরে বাংলাভাষা প্রচলনের দাবি জানিয়েছেন। আমি তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি। রফিকুল ইসলাম বলেন, রওশন আরা বাচ্চু অত্যন্ত সাহসী মহিলা ছিলেন। ভাষা আন্দোলন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলা ভাষার প্রশ্নে তিনি সর্বদা সোচ্চার ছিলেন। রামেন্দু মজুমদার বলেন, ’৫২ সালে মেয়েরা প্রকাশ্যে সভা-সমিতি করতে বিব্রতবোধ করতেন। এমনকি বাইরে বেরোতেও ছিল বিধিনিষেধ। ওই সময়ে তিনি আন্দোলন করেছেন। ভাষা সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, তার স্মৃতি রক্ষার্থে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিশ্চয়ই কাজ হবে এবং বাংলা একাডেমি সেই দায়িত্ব পালন করবে। এর বাইরে রওশন আরা বাচ্চুর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদসহ বিশিষ্টজনরা। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী শোকবার্তায় বলেন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের উত্তাল সময়ে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চু। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে তাঁর নেতৃত্বে ইডেন মহিলা কলেজ এবং বাংলাবাজার বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা সংগঠিত হয়েছিলেন। ১৪৪ ধারা ভেঙ্গেছিলেন। ব্যারিকেড টপকে যারা সামনে অগ্রসর হন তাঁদের মধ্যে ছিলেন রওশন আরা বাচ্চুও। সেদিন পুলিশের নির্বিচার লাঠিচার্জে তিনি আহত হন। বাংলাভাষা ও বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চুও ততদিন এদেশের মানুষের মাঝে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ১৯৩২ সালের ১৭ ডিসেম্বর সিলেটের মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার উছলাপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চু । তার বাবা এ এম আরেফ আলী ও মা মনিরুন্নেসা খাতুন। পিরোজপুর গার্লস স্কুল থেকে ’৪৭ সালে ম্যাট্রিক ও ’৪৯ সালে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ’৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগ থেকে অনার্স পাস করেন। ১৯৬৫ সালে বিএড ও ’৭৪ সালে ইতিহাসে এমএ করেন। রওশন আরা বাচ্চু ‘গণতান্ত্রিক প্রোগ্রেসিভ ফ্রন্টে’ যোগ দিয়ে ছাত্ররাজনীতি শুরু করেন। সে সময় তিনি সলিমল্লাহ মুসলিম হল ও উইমেন স্টুডেন্টস রেসিডেন্সের সদস্য নির্বাচিত হন। রওশন আরা বাচ্চু সর্বশেষ বিএড কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। অবসরে যান ২০০২ সালে। ১৯৫২ সালের বাংলাভাষা আন্দোলনের সময় রওশন আরা বাচ্চু ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়র ছাত্রী। একুশে ফেব্রুয়ারি যেসব ছাত্রনেতা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে ছিলেন তিনি তাদের অন্যতম। এই সংগ্রামী নারী ইডেন মহিলা কলেজ ও বাংলাবাজার বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সংগঠিত করে আমতলার সমাবেশস্থলে নিয়ে আসেন। এখান থেকেই ছাত্রনেতারা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেন। তারা ব্যারিকেড ভেঙ্গে মিছিল নিয়ে এগোনোর চেষ্টা করলে পুলিশের বাধার মুখে পড়েন। ব্যারিকেড টপকানো বেশ কঠিন ছিল। এমন পরিস্থিতিতে রওশন আরা বাচ্চু তার দলের সবাইকে নিয়ে সেই পুলিশি ব্যারিকেড ভেঙ্গে ফেলেন। পুলিশ নির্বিচার লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে নিহত ও আহত হন অনেকে। রওশন আরা বাচ্চুও ছিলেন আহতদের একজন। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির রচিত ‘ভাষা আন্দোল ও নারী’ গ্রন্থে রওশন আরা বাচ্চু একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনাা সম্পর্কে বলেন, ‘তখন বেলা ১০/১১ টা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী আমতলায় জমায়েত হয়েছে। গাজীউল হকের সভাপতিত্বে ছাত্রসভা শুরু হয়েছে। তুমুল বিক্ষোভের মধ্যে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের তর্কবিতর্ক চলছে। শেষ পর্যন্ত ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে মেনে নেয়া হলো। সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গের মতো ছাত্র-ছাত্রীরা বিক্ষোভে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এই স্লোগানে বেরিয়ে যাচ্ছিল। সাফিয়া আপা, হালিমা আপা ও আমি প্রথম দলে গেটের কাছে আসি এবং প্রত্যেকটি ছাত্রী যাতে মিছিলে যোগ দিতে পারে সেই সুযোগ সৃষ্টিতে সাহায্য করি এবং তৃতীয় দলের সঙ্গে কর্ডন ভেদ করে মিছিলে যোগ দেই। আপোসহীন বিক্ষুব্ধ ছাত্র-ছাত্রীদের ধাক্কায় পুলিশের কর্ডন ভেঙ্গে যায়। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় লাঠিচার্জ ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ। কাঁদুনে গ্যাস ও লাঠিচার্জের মধ্যেই এ্যাসেম্বলি হলের দিকে ছুটে যাচ্ছিলাম।’
×