ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

আপীল ও হাইকোর্ট বিভাগে শীঘ্রই বিচারপতি নিয়োগ

প্রকাশিত: ১১:০১, ২০ অক্টোবর ২০১৯

আপীল ও হাইকোর্ট বিভাগে শীঘ্রই বিচারপতি নিয়োগ

বিকাশ দত্ত ॥ মামলা জট নিরসন ও কয়েকজন বিচারপতি অবসরে যাওয়ার কারণে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে শীঘ্রই বিচারপতি নিয়োগ করা হচ্ছে। হাইকোর্ট বিভাগে নিয়োগের পর আপীল বিভাগে বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হবে। হাইকোর্ট বিভাগে ১০ থেকে ১৫ জন বিচারপতি নিয়োগ হচ্ছে বলে সুপ্রীমকোর্ট অঙ্গনে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা চলছে। তবে শেষ মুহূর্তে এই সংখ্যা কমবেশিও হতে পারে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী, আইন কর্মকর্তা ও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের (জেলা জজ) মধ্য থেকে বিচারপতি নিয়োগ করা হয়। এদিকে এই নিয়োগ সামনে রেখে সুপ্রীমকোর্ট বার সমিতির সভাপতি ও সম্পাদক তাদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। সর্বশেষ গত বছরের মার্চে হাইকোর্টে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে ১৮ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। বর্তমানে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনসহ আপীল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ মিলিয়ে বিচারপতি রয়েছেন ৯৯ জন। এর মধ্যে হাইকোর্টে ৯২ ও আপীল বিভাগে ৭ জন। এর মধ্যে ৩ জন ছুটিতে থাকায় আপাতত বিচারকাজে অংশ নিচ্ছেন না। এছাড়া উচ্চ আদালতসহ নি¤œ আদালতে ৩৫ লাখ ৯৮ হাজার ২৬৩টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে আপীল বিভাগে ২১ হাজার ৪১০টি এবং হাইকোর্টে ৪ লাখ ৮৮ হাজার ৫৬১টি মামলা বিচারাধীন। এছাড়া নিম্ন আদালতে বিচারাধীন ৩০ লাখ ৮৮ হাজার ২৯১টি মামলা। সে দিক বিবেচনা করলে সুপ্রীমকোর্টসহ নি¤œ আদালতে আরও বিচারক নিয়োগ করা প্রয়োজন। ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক বলেছেন, মামলা জট নিরসনের লক্ষ্যে উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ করা প্রয়োজন। ইতোমধ্যে কয়েকজন বিচারপতি অবসরে গেছেন। কয়েক মাসের মধ্যে আরও কয়েকজন বিচারপতি অবসরে যাবেন। সেদিক বিবেচনা করেই বিচারপতি নিয়োগ দেয়া দরকার। এদিকে বিচারপতি নিয়োগে সংবিধান অনুসরণ করার দাবি জানিয়েছে সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী (বার) সমিতি। এ দাবিতে বারের দুটি অংশ একমত হলেও সরকার হাইকোর্টের রায় মানছে না বলে অভিযোগ করেছেন সুপ্রীমকোর্ট বারের সম্পাদক ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন। রাজনৈতিক আনুগত্যের কারণে কাউকে সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতি নিয়োগ করা বাঞ্ছনীয় নয় বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। সুপ্রীমকোর্ট বার সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন বলেছেন, সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগ দেবেন। আর ৯৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপ্রীমকোর্টের কোন বিভাগের বিচারক-সংখ্যা সাময়িকভাবে বাড়ানো উচিত বলে সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হইলে তিনি যথাযথ যোগ্যতাসম্পন্ন এক বা একাধিক ব্যক্তিকে অনধিক দুই বছরের জন্য অতিরিক্ত বিচারক নিযুক্ত করতে পারবেন। ‘কিন্তু আমাদের দেশে রেওয়াজ হচ্ছে ৯৮ অনুসারে দুই বছরের জন্য অতিরিক্ত বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয়। দুই বছর পরে ওনাদের পারফরম্যান্স দেখে প্রধান বিচারপতি সুপারিশ করেন, সে অনুযায়ী ওনাদের কনফার্ম করা হয়। আমিন উদ্দিন বলেন, একজন আইনজীবীর রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ১০ বিচারপতির রায়ে নির্দেশনা রয়েছে। সে নির্দেশনায় স্পষ্ট আছে প্রধান বিচারপতি দেখবেন, যারা দুই বছর অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োজিত আছেন তাদের বিচারিক কার্যক্রম। অন্য কার্যক্রম সরকার দেখবেন। এভাবে কিন্তু হয়ে আসছে। অন্যদিকে সুপ্রীমকোর্ট বার সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন রায়ের আলোকে বিচারক নিয়োগের নীতিমালা প্রণয়ন করে বিচারপতি নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ২০১৭ সালের ২৪ জুলাই কার্যকরী কমিটি এবং একই সালের ২১ আগস্ট সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওইসব সভায় হাইকোর্ট বিভাগের ২০১৭ সালের ১৩ এপ্রিলের রিট মামলার রায় অনুযায়ী নীতিমালা প্রণয়ন করে বিচারপতি নিয়োগ করার দাবি জানানোর সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। অন্যদিকে ২০১৭ সালের ২২ মে সুপ্রীমকোর্টে বিচারপতি নিয়োগ করার জন্য দিকনির্দেশনা বা নীতিমালা প্রণয়নের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করে হাইকোর্ট। বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় প্রকাশ করেন। পরে সেটি ৪৬ পৃষ্ঠায় সুপ্রীমকোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। গত ১৩ এপ্রিল সুপ্রিমকোর্টে বিচারপতি নিয়োগ করার জন্য দিকনির্দেশনা বা নীতিমালা প্রণয়নের বিষয়ে জারি করা রুল খারিজ করে হাইকোর্ট। হাইকোর্ট পূর্ণাঙ্গ রায়ে উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ দেয়ার জন্য সাতটি শর্তসহ পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। সেখানে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে সাতটি সুপারিশ দেয়া হয়েছে। (১) রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি, যেমন- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বাংলাদেশী নাগরিক হতে হবে। (২) মেধাবী, প্রাতিষ্ঠানিক ও উচ্চতর পেশাগত যোগ্যতা সম্পন্ন, সৎ এবং আইনী জ্ঞানসম্পন্ন হতে হবে। (৩) বিচারক হতে আগ্রহী প্রার্থীদের জীবন বৃত্তান্ত সুপ্রীকোর্টের ওয়েবসাইটে দিতে হবে। যাতে প্রধান বিচারপতি প্রার্থীর সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে উপযুক্ত ব্যক্তিকে মনোনয়ন দিতে পারেন। (৪) পেশাগত জীবনে একজন ব্যক্তির অর্জিত দক্ষতা ও পারদর্শিতাকে প্রথমত বিবেচনায় নেয়া উচিত। ভারতের আইন কমিশনের ৮০তম প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী একজন বিচারকের পরিপক্বতা পেশাগত অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে একটি বয়সসীমা ধরা হয়েছে। সেই হিসেবে সুপ্রীমকোর্টের বিচারক মনোনয়নের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ৪৫ বছর হওয়া উচিত। (৫) প্রধান বিচারপতি আপীল বিভাগের নিবন্ধিত আইনজীবীদের অগ্রাধিকার ও সুপারিশ ভিত্তিতে উচ্চ আদালতে বিচারক হিসেবে নিয়োগ দিতে পারবেন। তবে উচ্চ আদালতের বৃহৎ পরিসরে সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে এমন নিবন্ধিত আইনজীবীর ক্ষেত্রে বিবেচনা করা যেতে পারে। (৬) জেলা ও দায়রা জজ আদালতে তিন বছরের কম অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বিচারককে উচ্চ আদালতের বিচারক হিসেবে নিয়োগের জন্য বিবেচনা করা উচিত হবে না। (৭) অধস্তন আদালত থেকে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান যোগ্যতা হওয়া উচিত সততা। তবে মনে রাখা উচিত যে, একজন ব্যক্তি উচ্চ মেধা সম্পন্ন কিন্তু সে সৎ না। সেক্ষেত্রে তাকে যে কোন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেয়া হলে তা হবে এক ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা। সুপারিশকৃত ব্যক্তির মধ্যে দ্বিতীয়ত থাকতে হবে শিক্ষাগত যোগ্যতার সর্বোচ্চ প্রোফাইল, পেশাদারিত্ব, সততা এবং দক্ষতা। প্রসঙ্গত উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে আইন প্রণয়নের কথা আছে সংবিধানে। কিন্তু আইন, দিকনির্দেশনা ও নীতিমালা না হওয়ায় ২০১০ সালের ৩০ মে বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা প্রণয়নের নির্দেশনা চেয়ে ব্যারিস্টার রাগিব রউফ চৌধুরী হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। ২০১০ সালের ৬ জুন হাইকোর্ট সুপ্রীমকোর্টে বিচারক নিয়োগে বাছাই প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা আনতে কেন সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা তৈরি করা হবে না, তা জানাতে রুল জারি করে।
×