ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

পাথর ব্যবহারে রেলওয়েকে নির্দেশ দিলেন মন্ত্রী

পাঁচ মাস পর মধ্যপাড়া খনি থেকে পাথর উত্তোলন ফের শুরু

প্রকাশিত: ১১:১৫, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯

পাঁচ মাস পর মধ্যপাড়া খনি থেকে পাথর উত্তোলন ফের শুরু

স্টাফ রিপোর্টার, দিনাজপুর/ নিজস্ব সংবাদদাতা পার্বতীপুর ॥ যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে পাঁচ মাস ১১ দিন বন্ধ থাকার পর দিনাজপুরের মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডে আবারও পাথর উত্তোলন শুরু হয়েছে। শনিবার সকাল থেকে খনির বন্ধ সকল কার্যক্রম শুরু করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জার্মাানিয়া ট্রাস্ট কনসোর্টিয়াম (জিটিসি)। কাজে যোগদান করেছেন জিটিসির অধীনে কর্মরত খনি শ্রমিকরা। কর্মচাঞ্চল্য ফিরে পেয়েছে পাথর খনি এলাকা। গত ৩ এপ্রিল পাথর উত্তোলন যন্ত্র ক্রিপ্ট মোটর গিয়ারবক্সের প্রিমিয়াম নষ্টের কারণ দেখিয়ে পাথর উত্তোলন বন্ধ রাখে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান জিটিসি। এতে খনির প্রায় ১ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে। শনিবার পাথর উৎপাদন শুরু হওয়ায় কর্মচাঞ্চল্য ফিরে পেয়েছে পাথর খনি এলাকা। মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড (এমজিএমসিএল) বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করে ২০০৭ সালে। প্রথম অবস্থায় খনি থেকে দৈনিক এক হাজার ৫০০ থেকে এক হাজার ৮০০ টন পাথর উত্তোলন করা হতো। পরে তা নেমে আসে ৫০০ টনে। এমন অবস্থায় উৎপাদন বাড়াতে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি ৯২ লাখ টন পাথর উত্তোলনের বিপরীতে ১৭১.৮৬ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি করে খনির উৎপাদন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেয়া হয় বেলারুশের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জার্মানিয়া ট্রাস্ট কনসোর্টিয়ামকে (জিটিসি)। জিটিসি দায়িত্ব নেয়ার পর মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের (এমজিএমসিএল) অবহেলায় একবার বিস্ফোরক না থাকায় এক মাস, এরপর খনির এক কর্মকর্তার অপসারণের দাবিতে চারদিন, আবার যন্ত্রাংশ না থাকায় আড়াই বছর এবং এবার যন্ত্র ক্রিপ্ট মোটর গিয়ারবক্সের প্রিমিয়াম নষ্টের কারণে ৫ মাস ১১ দিন পাথর উৎপাদন বন্ধ থাকে। পাথর খনির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ ফজলুর রহমান জানান, তিনি গত ২১ জুলাই মধ্যপাড়ায় যোগদান করেছেন। এরপর তিনি খনির বন্ধ সকল কার্যক্রম শুরুর চেষ্টা করেন। তিনি জিটিসি’র উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অল্প সময়ের মধ্যে বৈঠকে বসেন এবং দ্রুত কার্যক্রম শুরুর বিষয়েও তাগিদ দেন। বৈঠকের পর জিটিসি দ্রুতগতিতে সকল কার্যক্রম শুরু করায় ৫ মাস ১১ দিন পর খনির চাকা সচল হল। রেলমন্ত্রী মোঃ নুরুল ইসলাম সুজন শনিবার মধ্যপাড়া পাথর খনি পরিদর্শন করেন। খনি পরিদর্শনকালে তিনি দেশীয় সম্পদ ব্যবহারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করেন এবং বাংলাদেশ রেলওয়েকে তাদের চাহিদাপূরণে সর্বপ্রথম মধ্যপাড়া খনির পাথর ব্যবহারের নির্দেশ প্রদান করেন। খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুর রহমান জানান, ইতিপূর্বে এ পর্যন্ত খনির উৎপাদিত মোট ১২ লাখ মেট্রিক টন ব্যালাস্ট বিক্রয় করা হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ের কাছে সরাসরি প্রায় ২ লাখ মেট্রিক টন এবং অন্য সংস্থার মাধ্যমে আরও প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন ব্যালাস্ট বিক্রয় করা হয়েছে। মধ্যপাড়া খনির উৎপাদিত ব্যালাস্ট পাথর রেলওয়ের পার্বতীপুর-লালমনিরহাট রেললাইন প্রকল্পে, নাটোর-ঈশ্বরদী-পাবনা-সিরাজগঞ্জ-বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমপাড় রেললাইন, মধুখালি-ফরিদপুর-রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া রেললাইন প্রকল্প, কুষ্টিয়া-চুয়াডাঙ্গা-দর্শনা-রেললাইন প্রকল্প, ঈশ্বরদী-কুষ্টিয়া-যশোর-খুলনা-রেললাইন সংস্কার প্রকল্প, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ-জামালপুর-রেললাইন সংস্কার প্রকল্পে ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়াও রেলওয়ের বিভিন্ন সংস্কার কাজে মধ্যপাড়া খনির ব্যালাস্ট পাথর ব্যবহৃত হয়েছে। কোম্পানির প্রধান অফিসে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন রেল সচিব, রেলওয়ের ডিজিসহ রেলওয়ের উর্ধতন কর্মকর্তাবৃন্দ এবং কোম্পানির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা। দেশের একমাত্র ভূ-গর্ভস্থ খনি হতে শিলা উৎপাদনে জার্মানিয়া ট্রাস্ট কনসোর্টিয়াম নামে একটি কোম্পানির সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ তারিখ হতে জিটিসি ইতিপূর্বে নির্মিত ৫টি স্টোভ হতে উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করে। ঠিকাদার ইতোমধ্যে ছয়টি নতুন স্টোভ উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন করেছে। সেখান থেকে প্রতিদিন ৩ শিফটে ৪০০০ মে. টন শিলা উত্তোলন করছে। চুক্তির পর হতে এ পর্যন্ত জিটিসি প্রায় ৩০ লাখ টন শিলা উৎপাদন করেছে। গত ৩ এপ্রিল রাত ৯:৩০টায় স্কিপ ওয়াইন্ডিং ক্রিপ মোটরের পিনিয়াম ভেঙ্গে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে যায় মধ্যপাড়া পাথর খনি হতে শিলা উৎপাদন। ভেঙ্গে যাওয়া মোটরের পিনিয়াম চীন থেকে আমদানি করায় পুনরায় শুরু হচ্ছে খনি হতে শিলা উৎপাদন। কোরীয় বিশেষজ্ঞের কারিগরি সহায়তায় প্রতিদিন এক শিফটে ৬০০-৮০০ মেট্রিক টন উৎপাদন হতো। খনি থেকে প্রতিদিন তিন শিফটে ৫,৫০০ মেট্রিক টন পাথর উত্তোলন এবং নতুন স্টোভ উন্নয়নের জন্য মাইন ম্যানেজমেন্ট চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। জার্মানিয়া-ট্রাস্ট কনসোর্টিয়াম (জিটিসি) এর মধ্যে ২ সেপ্টেম্বর ২০১৩ তারিখে ৬ বছরের জন্য বৈদেশিক ও স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ১৪০০ কোটি টাকা মূল্যমানের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি মতে ঠিকাদার ১২টি নতুন স্টোভ উন্নয়ন ও ৯২ লাখ মেট্রিক টন পাথর উত্তোলন করবে। বাংলাদেশ ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতর (জিএসবি) কর্তৃক ১৯৭৪ সালে দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার মধ্যপাড়া এলাকায় ভূ-গর্ভের ১২৮-১৩৬ মি. গভীরতায় গ্রানাইট পাথর আবিষ্কৃত হয়। ১৯৭৬-৭৭ সালে কানাডার পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মধ্যপাড়ায় একটি ভূ-গর্ভস্থ খনি বাস্তবায়ন কারিগরি ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক বলে সুপারিশ করে। ১৯৮৮-৮৯ সালে নিপ্পন কোই জাপান কর্তৃক পাথরের বাজার সমীক্ষা সম্পন্ন করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ এবং উত্তর কোরীয় সরকারের মধ্যে অর্থনৈতিক, কারিগরি, বৈজ্ঞানিক ও বাণিজ্যিক বিষয়ে একটি দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। উক্ত সমঝোতা স্মারকের ধারাবাহিকতায় মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ কর্পোরেশন (পেট্রোবাংলা) এবং উত্তর কোরীয় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মেসার্স কোরিয়া সাউথ-সাউথ কো-অপারেশন কর্পোরেশন (নামনাম) এর মধ্যে ২৭ মার্চ ১৯৯৪ তারিখে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট এর আওতায় একটি টার্ন কী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মেসার্স নামনাম সেপ্টেম্বর ১৯৯৪ সাল হতে প্রকল্পের কাজ শুরু করে। উত্তর কোরীয় ঠিকাদার ২৫ মে ২০০৭ সালে খনিটি মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড (এমজিএমসিএল)-এর কাছে হস্তান্তর করে। কঠিন শিলা খনির পাথর হতে উন্নতমানের গ্রানাইট স্লাব তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুর রহমান জানান, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী গ্রানাইট স্লাব তৈরি করার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য পেট্রোবাংলার অর্থায়নে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে। স্টাডি রিপোর্ট পাওয়ার পরে এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। মধ্যপাড়া খনি হতে শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৪০ লাখ টন শিলা উত্তোলন করা হয়েছে। যার বিপরীতে প্রায় ৩৬ লাখ টন শিলা বিক্রয় করা হয়েছে।
×