ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

উদ্ধার দাবি

সিংহ নদীর গর্জন আর নেই

প্রকাশিত: ০৯:১২, ৯ মার্চ ২০১৯

সিংহ নদীর গর্জন আর নেই

সালাহউদ্দিন মিয়া, কেরানীগঞ্জ, ৮ মার্চ ॥ বুড়িগঙ্গা দখলের পর এবার প্রভাবশালীরা দখল করতে শুরু করেছে কেরানীগঞ্জের সিংহ নদী। অবৈধ দখলের ফলে দিনে দিনে সিংহভাগ মরা নদীতে পরিণত হচ্ছে। বিগত তিন দশকে নদীর বিশ কিলোমিটার জমি দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে শতাধিক ভবন ও মার্কেট। নদীর প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ফসলি জমিতে সেচ ও নৌ চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। সরেজমিনে দেখা গেছে, নদী ক্রমাগত ভরাট করে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে বহুতল ভবন ও মার্কেট। ভূমিদস্যুরা দুই তীর ভরাট করে কামিয়ে নিচ্ছে কালো টাকা। এই অপকর্মে জড়িত উপজেলা ভূমি ও রাজস্ব বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। ভূমিদস্যুর ভুয়া ও জাল কাগজপত্র দেখিয়ে কেউবা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা দেখিয়ে, কেউ বা কোন প্রকার কাগজপত্র না দেখিয়েই দখল করে নিয়েছে সিংহ নদী। অথচ সেকালের লোকজন এ নদী দিয়ে বুড়ীগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদীতে নৌপথে যাতায়াত করত। তা ছাড়া ব্যবসায়ীরা রাজেন্দ্রপুর, বিক্রমপুর, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, যশোর, কুষ্টিয়া, বরিশাল, খুলনা, এমনকি ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষেত্রেও এই নদী ব্যবহার করত। সিংহ নদীটি ধলেশ্বরীর আকশাইল এলাকা দিয়ে রামেরকান্দা, অগ্রখোলা, শিকারীটোলা ও খাড়াকান্দি এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পুনরায় ধলেশ্বরীর সঙ্গে মিশেছে। অপরদিকে নদীটির রামেরকান্দা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বেলনা, আকশাইল ও কলাতিয়া হয়ে বুড়িগঙ্গার সঙ্গে মিশেছে। ভারত বর্ষের সময় এই খরস্রোতা নদী দিয়ে শত শত হাজার মণের ধান-পাট বোঝাই নৌকা পাল তুলে যাতায়াত করত। সিংহের মতো এই নদীর আওয়াজ ছিল। এ জন্য লোকেরা এই নদীকে সিংহ নদী বলে আখ্যায়িত করেছে। এ বিষয়ে আব্দুল্লাহপুর পশ্চিমপাড়ার মাতবর দেওয়ান মতিউর রহমান (৭০) বলেন, ছোট বেলায় এই নদীতে নৌকাবাইচ করেছি। তখন বড় বড় নৌকা পাল তুলে চলত। কে বা কারা নদীটি ভরাট করছে- তা জানি না। আপনারা সরেজমিন তদন্ত করলে জানতে পারবেন। ওই একই এলাকার কৃষক শাজাহান মিয়া বলেন, এই নদীতে অনেক স্রোত ছিল। তখন নৌকায় এপার থেকে ওপার পারি দেয়া খুবই কঠিন ছিল। বর্তমানে ফসলি জমিতে পানি দেয়া যায় না। কারণ নদীর পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দিয়ছে প্রভাবশালীরা। তিনি আরও বলেন, মালিভিটা এলাকায় মাঝ নদীতে বালি ভরাট করে নদীপথে যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছে। নৌকার মাঝি রহিমুদ্দিন বলেন, নদী ভরাটের ফলে নৌকা চালাতে পারছি না। তা ছাড়া মাছ ধরার জাল দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে নৌ যাতায়াত। ফলে মাঝিগিরি ছেড়ে দিয়ে মজুরের কাজ করে সংসার চালাচ্ছি। বাস্তা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোঃ শামসুল হক বলেন, সিংহ নদীর সিংহের মতোই গর্জন ছিল। বাল্যকালে নদী পার হতে ভয় পেতাম। ভূমিদস্যুরা নদীর দুই পাড় দখল করে নিয়েছে। আমরা জানি কেরানীগঞ্জ অচিরেই একটি উন্নত শহরে পরিণত হতে যাচ্ছে। নৌপথে যাতায়াত ও পানি নিষ্কাশনের জন্য সিংহ নদীর দরকার। কিন্তু সিংহ নদীর পানিপ্রবাহ ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারের কাছে অনুরোধ সিংহ নদী উদ্ধারের। এটা জনগণ ও এলাকাবাসীর দাবি। রুহিতপুর এলাকার প্রবীণ সমাজকর্মী মোঃ জালালউদ্দিন (৯৯) বলেন, আমি ছোটকালে স্কুলে যাতায়াত করতাম এই নদী দিয়ে। নদীর দুই তীর ভরাট করেছে প্রভাবশালীরা। ফলে আমরা নদীতে গোসল করতে পারি না। নদী এখন নেই। যদি নদীটি খনন তাহলে আমরা নৌ পথে যাতায়াতের সুবিধা হবে। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বাবুল মিয়া বলেন, সারাদেশের নদ-নদী দখল করে নিচ্ছে ভূমিদস্যুরা। ঢাকার কাছের কেরানীগঞ্জের জমির মূল্য অনেক বেশি। এ জন্য কেরানীগঞ্জের খাল ও নদীগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে। অতি শীঘ্রই সিংহ নদী আগে যেমন ছিল তা উদ্ধার করার জন্য তৎপর আছি। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেয়া হবে এবং এসিল্যান্ডকে দিয়ে পরিমাপ নির্ধারণ করা হবে। এ বিষয়ে জনগণ যেন আমাদের সাহায্য ও সহযোগিতা করে। দখল ও পরিবেশ যাতে নষ্ট না হতে পারে এ জন্য আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। দখল-দূষণের কবলে নওগাঁর ৬ নদী বিশ্বজিৎ মনি, নওগাঁ থেকে জানান, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে নওগাঁ জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত ৬ টি নদী ইতোমধ্যেই পানিশূন্য হয়ে পড়ছে। শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই পানিশূন্য হয়ে পড়ায় বোরো সেচ নিয়ে শঙ্কিত নদী তীরবর্তী হাজার হাজার কৃষক। অন্যদিকে দখল-দূষণের চলছে প্রতিযোগিতা করে। পানিশূন্য হয়ে পড়ায় বেকার হয়ে পড়েছে জেলার নদীনির্ভর মৎস্যজীবীরা। এলাকাবাসী বলছে, সংরক্ষণ ও পুনঃখনন করা না হলে এ অঞ্চলের নদীগুলো হারিয়ে যাবে কালের গর্ভে। ইতোমধ্যে অধিকাংশ নদীই মরা খালে পরিণত হয়েছে। নওগাঁয় রয়েছে ছোটবড় ৬টি নদী। শুষ্ক মৌসুমের শুরুতে আত্রাই, ছোট যমুনা, তুলসীগঙ্গা, নাগর, শিব, ফকিন্নী, পুনর্ভবা নদ-নদী শুকিয়ে গেছে। এক সময় এসব নদ-নদী ছিল হাজার হাজার মানুষের জীবিকার উৎস। স্রোতস্বিনীর পানি ব্যবহার করে দু’পারের মানুষ ভরে তুলত তাদের ক্ষেতের ফসল। এখন বছরে মাত্র তিন থেকে চার মাস পানি থাকে এসব নদীতে। এর পর ধুধু বালুচর। চলছে এখন দখল-দূষণের প্রতিযোগিতা। স্থানীয়রা বলছেন, আগে এসব নদী অনেক উত্তাল ছিল। নদীতে চলত পালতোলা নৌকা। ব্যবসায়ীরা নৌপথেই তাদের পণ্য বেচাকেনা করত দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। এখন সব কিছুই যেন স্মৃতি। নওগাঁর মৃত প্রায় ৬টি নদী দখল ও দূষণের হাত থেকে রক্ষার দাবিতে সম্প্রতি জেলা মানবাধিকার সংগঠনসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন কর্মসূচী পালন করেছে। জেলা মানবাধিকার সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক চন্দন কুমার দেব বলেন, এখন শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ছোট যমুনা নদীর যে অবস্থা, এটাকে রক্ষা করতে সকলের উদ্যোগ নেয়া দরকার । এদিকে অবৈধ দখল রোধ আর মরা নদী রক্ষায় জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পৌর প্রশাসনের ব্যর্থ চেষ্টা নিয়ে রয়েছে নানা অভিযোগ। দখলদারদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েও ঠেকানো যাচ্ছে না। নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোডের্র নির্বাহী প্রকৌশলী সুধাংশু কুমার সরকার বলেন, নওগাঁর ৬ টি নদী খনন কাজের প্রস্তাবনা প্লানিং কমিশনে দেয়া আছে । প্রায় ১০০ কিলোমিটার নদী ড্রেজিং করার জন্য একটি প্রকল্প ধরা হয়েছে। এদিকে নওগাঁর ছোট যমুনা নদী কালীতলা সুপারিপট্টি, পারনওগাঁ, সুলতানপুরে অবৈধ দখল চলছে। এসব নিয়ে একাধিক মামলা করেও এ দখল থামানো যাচ্ছে না বলে জানালেন নওগাঁ পৌর মেয়র মোঃ নজমুল হক সনি । শুকিয়ে যাওয়া নদীর দু’তীরে দখল রোধে জেলা প্রশাসনের কার্যকর ভূমিকা নেয়া জরুরী। নওগাঁ জেলা প্রশাসক মোঃ মিজানুর রহমান বলেন, নদী দখল-দূষণ রোধে প্রশাসন সচেষ্ট। পরিবেশের বিরূপ প্রভাব মুক্ত রাখতে জেলার নদী গুলো সচল করা গেলে শস্যসমৃদ্ধ হয়ে উঠবে এ অঞ্চল। এমন অভিমত জেলার সচেতন মহলের।
×