ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

নেপালে ইউএস বাংলা উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১১:০০, ২৯ জানুয়ারি ২০১৯

নেপালে ইউএস বাংলা উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নেপালে ইউএস বাংলার উড়োজাহাজ তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করেছে ঢাকার বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। তাদের দাবি, শুধু পাইলটের ভুল নয়, নেপাল এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের (এটিসি) দায়িত্বহীনতার কারণেই ঘটেছিল কাঠমান্ডুতে ইউএস বাংলা উড়োজাহাজের দুর্ঘটনা। উড়োজাহাজটিতে কোন ত্রুটি ছিল না। বেবিচক জানিয়েছে, ওই প্রতিবেদনে তাদের দেয়া বক্তব্য বা তথ্য যদি সংযোজন না করা হয় তবে আইকাওয়ের কাছে প্রতিবাদ জানাবে। গত বছর ১২ মার্চে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে নেপাল। রবিবার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার দায় চাপানো হয় পাইলটের মানসিক অবসাদগ্রস্ত, ধূমপান ও ভুলের ওপর। অন্যদিকে তদন্ত প্রতিবেদনকে একপেশে, অসম্পূর্ণ উল্লেখ করে বেবিচক বলেছে, ঢাকা থেকে পাঠানো কোন তথ্য বা বক্তব্য নেপালের তদন্ত কমিটিতে সংযোজন করা হয়নি। এ সম্পর্কে ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন এম রহমতুল্লাহ বলছেন, নেপালের তদন্তে বলা হচ্ছে পাইলট ককপিটে বসে ধূমপান করছিলেন। এ নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। কারণ, এয়ারক্রাফটে ধূমপান না করার আন্তর্জাতিকভাবে কোন বিধিনিষেধ নেই। তবে টয়লেটে ধূমপান না করার জন্য নির্দেশনা থাকে। সুতরাং এটি দুর্ঘটনার কোন কারণ নয়। এ বিষয়ে সোমবার বেবিচক প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম নাইম হাসান। পাইলট আবিদ সুলতানকে মূলত দায়ী করে ভারত ও নেপালের তদন্ত প্রতিবেদনকে ‘ভিত্তিহীন’ আখ্যা দিয়েছেন তদন্ত দলের সঙ্গে যুক্ত বাংলাদেশী তদন্তকারী ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন এম রহমতুল্লাহ। তিনি এ নিয়ে আরও কিছু কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন। কি আছে ওই তদন্তে ॥ একপেশে ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ককপিটের ভয়েস রেকর্ডার পরীক্ষা করার পর তাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে যে ক্যাপ্টেন বড় ধরনের মানসিক চাপের মধ্যে ছিলেন। প্রায় এক ঘণ্টার ওই ভয়েস রেকর্ডে কো-পাইলট পৃথুলা রশিদের সঙ্গে কথোপকথনে পাইলট আবিদের ‘মানসিক অস্থিরতা এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে তার অসতর্কতার’ বেশ কিছু নমুনা পাওয়া গেছে। ওই যাত্রায় পাইলট আবিদ এক নারী সহকর্মীকে নিয়ে কথা বলছিলেন, যিনি ইউএস-বাংলাতেই কো-পাইলট হিসেবে কাজ করেন, তবে সেদিনের সেই ফ্লাইটে তিনি ছিলেন না। ওই নারী সহকর্মী ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে আবিদের সুনাম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। সে কারণে আবিদ মানসিক অস্থিরতায় ভুগছিলেন। ওই পরিস্থিতিতে অবতরণের আগের ওই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে উড়োজাহাজ চালনার বিধিবদ্ধ নিয়মগুলো অনুসরণ করতে ব্যর্থ হন ফ্লাইটের দুই ক্রু। পরিস্থিতি সম্পর্কে তারা যথেষ্ট সতর্ক অসতর্কতার কারণে পাইলটরা বুঝতে পারেননি, তাদের ড্যাশ ৮-কিউ৪০০ উড়োজাহাজটি নির্ধারিত পথ থেকে কতটা সরে গেছে। এর অর্থ হলো, তারা ঠিকমতো রানওয়ে দেখতে পাচ্ছিলেন না। কমিশনের সদস্য বুদ্ধিসাগর লামিচানে রয়টার্সকে বলেছেন, পাইলট ভেবেছিলেন, তিনি উড়োজাহাজটি নির্ধারিত পথে ফিরিয়ে এনে ঠিকমতই অবতরণ করতে পারবেন। কিন্তু তিনি তা পারেননি। রানওয়ে ‘মিস করার’ পর শ-৮ কিউ৪০০ মডেলের উড়োজাহাজটি উড়ছিল খুব নিচে, ত্রিভুবন বিমানবন্দরের উত্তরের পাহাড়ী এলাকার কাছ দিয়ে। শেষ পর্যন্ত পাইলটরা যখন রানওয়ে দেখতে পান, ততক্ষণে তারা অনেক নিচে নেমে এসেছেন, উড়োজাহাজও রানওয়ের মাঝ বরাবর ছিল না। পাইলটের উচিত ছিল তখন না নেমে আবার আকাশে উঠে যাওয়া এবং চক্কর দিয়ে নতুন করে নামার চেষ্টা করা। ভূমি স্পর্শ করার পর ফ্লাইট বিএস-২১১ দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এগিয়ে যায় এবং রানওয়ের বাইরে চলে যায়। এরপর সীমানা বেড়া ভেঙ্গে ঢালু জমি পেরিয়ে অবতরণের স্থান থেকে ৪৪২ মিটার দূরে গিয়ে থামে। সেখানে বিমানটি অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়। এদিকে সোমবার ভারতের নয়াদিল্লীভিত্তিক সংবাদ সংস্থা এশিয়ান নিউজ ইন্টারন্যাশনালের (এএনআই) এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ভয়াবহ এই দুর্ঘটনার তদন্তে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। সেই তদন্ত কমিশন গত রবিবার চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করেছে। তাতে উল্লেখ করা হয়, চলন্ত বিমানের ককপিটে বসেই ধূমপান করছিলেন পাইলট। কিন্তু কমিশনের হাতে আসা তথ্যমতে বিমানটির পাইলট ইন কমান্ড (পিআইসি) ছিলেন একজন ধূমপায়ী। ককপিটে ভয়েস রেকর্ডার (সিভিআর) থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিমান চলাকালীন ককপিটে বসে ধূমপান করছিলেন তিনি। তদন্ত কমিটির ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয়, তদন্ত কমিশন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, বিমানটির নিয়ন্ত্রণকারীর অপারগতা ও ক্রু সদস্যদের পরিস্থিতিগত সচেতনতার অভাবেই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলার বিমান দুর্ঘটনার চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে নেপাল। রবিবার নেপালের পর্যটনমন্ত্রী রবিন্দ্র অধিকারীর কাছে ৪৩ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি জমা দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে বিমানটির পাইলটের মানসিক অসুস্থতার ইতিহাসের দিকে নজর ফেরানো হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির সংবাদমাধ্যম কাঠমান্ডু পোস্ট। তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই গেল বছরের আগস্টের শেষদিকে নেপালী গণমাধ্যম দ্য কাঠমান্ডু পোস্ট এক প্রতিবেদনে একইভাবে দায় চাপানো হয়েছিল আবিদের ওপর। কাঠমান্ডু পোস্টের ওই প্রতিবেদনে তখন উদ্বেগও জানিয়েছিল তদন্ত কমিশন। অথচ পাঁচ মাসের মাথায়ই ভিত্তিহীন ওই প্রতিবেদনের সুরেই কথা বলছে তদন্ত কমিশন। এটিসি সঠিক দায়িত্ব পালন করলে দুর্ঘটনা এড়ানো যেত ॥ এদিকে তদন্ত দলে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে থাকা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) ফ্লাইট অপারেশন কনসালটেন্ট সালাউদ্দিন বলেন, নেপালের তদন্ত কমিটির রিপোর্টে মিথ্যাচার নেই। তবে রিপোর্টে এটিসি (বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ) সম্পর্কে কিছু তথ্য এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এজন্য আমরা কিছু প্রস্তাব তাদের দেব। সেগুলো রিপোর্টে যুক্ত না করা হলে আমরা আইকাওকে (ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন) অভিযোগ করব। ত্রিভুবন বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ সেদিন আরও উদ্যোগী ভূমিকা নিলে হয়ত এ দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। প্রতিবেদনে পাইলট সংক্রান্ত যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে সেগুলো ঠিক আছে, তবে নেপালের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের-এটিসির ভুল সংক্রান্ত বিষয়গুলো উঠে আসেনি। এটিসি বিষয়ে বাংলাদেশ থেকে এ্যামেন্ডমেন্ট দেয়া হয়েছে। সাধারণ এ ধরনের বিমান দুর্ঘটনাকে কোনভাবেই পার্সোনালাইজ করা হয় না বলে উল্লেখ করেন ক্যাপ্টেন রহমতউল্লাহ। তিনি বলেন, নেপালের তদন্ত প্রতিবেদনে যা উঠে এসেছে তা ঠিক আছে। তবে পাইলটকে একপেশে দায়ী করা হয়েছে। কিন্তু এটিসির যে ত্রুটি ছিল এগুলো উঠে আসেনি। পাইলট ল্যান্ড করতে এ্যাপ্রোচ মিস করেছিল। কিন্তু এটিসি পাইলটকে সহায়তা করতে পারত, কিন্তু তারা তা করতে পারেনি। বরং বিমানটি যখন এটিসি টাওয়ারের কাছ দিয়ে গিয়ে বিধ্বস্ত হয় তখন এসিটি টাওয়ারের কর্মকর্তারা টেবিলের নিচে আশ্রয় নেন। তিনি বলেন, নেপালের তদন্তে বলা হচ্ছে পাইলট ককপিটে বসে ধূমপান করছিলেন। এ নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। কারণ, এয়ারক্রাফটে ধূমপান না করার আন্তর্জাতিকভাবে কোন বিধিনিষেধ নেই। তবে টয়লেটে ধূমপান না করার জন্য নির্দেশনা থাকে। সুতরাং এটি দুর্ঘটনার কোন কারণ নয়। ক্যাপ্টেন সালাহ্উদ্দিন এম রহমতউল্লাহ বলেন, ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান একাই বিমানটি পরিচালনা করেছিলেন। একই সঙ্গে তিনি রেডিওতে যোগাযোগ করছিলেন। এটা দোষের কিছু নয়, পাইলট চাইলে এটি করতে পারতেন। পাইলট যখন এ্যাপ্রোচ মিস করেন তখন গ্রাউন্ডে থাকা দুজন পাইলট এটিসিকে অনুরোধ করেন।ইউএস বাংলার পাইলটকে রাডারের মাধ্যমে সহায়তা করার জন্য। কিন্তু এটিসি এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেননি। এটিসি সহায়তা করলে এ দুর্ঘটনা হয়ত হতো না। এ সময় বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম নাঈম হাসান বলেন, অনেক সময় পাইলটরা দিক হারিয়ে ফেলেন। এটা প্রায়ই ঘটে। নেপালে পাহাড়ঘেরা বিমানবন্দর হওয়ায় এ ঝুঁকি বেশি। সেদিন পাইলট দিক হারিয়ে ফেলেছিলেন। পাইলট কোন কারণে এ্যাপ্রোচ মিস করেছেন। তবে তাকে সহায়তা করার দায়িত্ব ছিল এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের। নেপালের এটিসি সেটি করেনি। উড়োজাহাজে কোন ধরনের ত্রুটি ছিল কিনা প্রশ্ন করা হলে বেবিচক চেয়ারম্যান এম নাইম হাসান বলেন, তবে উড়োজাহাজের কোন ত্রুটি পায়নি তদন্ত কমিটি। সেদিন আকাশ সুন্দর, পাইলটও বেশ ভালই ইনস্ট্রাকশন দিচ্ছিল, সেটা তদন্ত রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়েছে। তারপরও দুর্ভাগ্যবশত এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। তিনি বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন বেবিচকের জন্য দুটি, ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের ১১টি এবং নেপালের সিভিল এভিয়েশনের জন্য দুটি সেফটি সংক্রান্ত পরামর্শ দিয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ১২ মার্চ ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বোমবার্ডিয়ার ড্যাশ ৮কিউ৪০০ উড়োজাহাজটি নেপালের কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে অবতরণ করার সময় দুর্ঘটনার শিকার হয়। উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত হন ৫১। এদের মধ্যে ২৮ বাংলাদেশী, ২২ নেপালী ও ১ চীনা নাগরিক ছিলেন। নিহত হন ফ্লাইটের সহকারী পাইলট পৃথুলা রশিদ। আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর মারা যান পাইলট ক্যাপ্টেন আবিদ।
×