ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

সেমিনারে আমির হোসেন আমু

স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণশক্তি ছিল বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ৬ আগস্ট ২০১৮

স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণশক্তি ছিল বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ চলছে শোকের মাস আগস্ট। জাতীয় জাদুঘরের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে মাসব্যাপী কর্মসূচী। সেই কর্মসূচীর আওতায় রবিবার অনুষ্ঠিত হলো ‘বাঙালির জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম : বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা’ শীর্ষক সেমিনার। বিকেলে জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন শিল্পমন্ত্রী আমীর হোসেন আমু। এ বিষয়ক আলোচনায় অংশ নেন জনকণ্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খান ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য পঙ্কজ দেবনাথ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ। সভাপতিত্ব করেন জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ আব্দুল মান্নান ইলিয়াস। প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিল্পমন্ত্রী আমীর হোসেন আমু বলেন, বঙ্গবন্ধুর পেশ করা ৬ দফা ছিল পাকিস্তানের পেটে লাথি মারার কর্মসূচী। এই ছয় দফা ছিল বিনা যুদ্ধ ও রক্তপাতে দেশ স্বাধীন করার প্রক্রিয়া। পরোক্ষভাবে এটি ছিল বাংলাদেশ স্বাধীনের দাবি। স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণশক্তি ছিল ৬ দফা। এ বিষয়টা পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী মর্মে মর্মে অনুভব করেছিল। তাই পাকিস্তানিরা এই দাবি না মানতে অনড় ছিল। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুও এই দাবি আদায়ে অনড় ছিলেন। শিল্পমন্ত্রীর বক্তব্যে ছয় দফাসহ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অনন্য সাহসী ভূমিকার কথা তুলে। তিনি বলেন, অনেকেই জানেন না যে ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাহোরে ছয় দফা পেশের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গ শার্দুল বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কাছে ছয় দফা এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল যে আইয়ুব অস্ত্রের ভাষায় এই দাবিকে মোকাবিলা করতে চেয়েছিলেন। সেই দিন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, পূর্ববঙ্গ তো বটেই পাকিস্তানের অন্য প্রদেশগুলোও ছয় দফা গ্রহণ করতে পারে। ’৭০-এর নির্বাচনেও বঙ্গবন্ধু অংশ নিয়েছিলেন মূলত দুটি কারণে। ছয় দফার জাতীয় দাবিকে প্রতিষ্ঠা করা এবং বাংলার মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায় করা। অথচ এই দাবি পেশের সময় বামপন্থীরা অনেকেই বলেছিল, এটি নাকি সিআইএর দলিল। পরবর্তীতে প্রমাণিত হয় ছয় দফার পথ ধরেই সুগম হয় স্বাধীনতার পথ। শিল্পমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই শাসকগোষ্ঠীর ধারণা হয়েছিল যে একসময় বাংলাদেশ ভাগ হয়ে যেতে পারে। সে কারণেই তারা এ ভূখন্ডে পাকিস্তানি ভাবধারা চালু করতে ক্রমাগত নানা তৎপরতা চালিয়ে গেছে। তাই শুরু থেকেই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ও বাংলা হরফে উর্দু লেখার প্রয়াস চালায় শাসকগোষ্ঠী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনকে কেন্দ্র করে তৎকালীন পাকিস্তানের গবর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু তার বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে প্রতিবাদ করেন। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ছাত্র ছিলেন। এই প্রতিবাদকে সাংগঠনিক রূপ দেয়ার জন্যই ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করেন। পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ গঠনের পর আরমানিটোলা মাঠের এক জনসভায় ছয় দফারই অনেক বিষয়ে আলোচনা হয়। সেখান থেকেই বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তান বিরোধিতার শুরু। বঙ্গবন্ধু কখনোই পাকিস্তানের কাদা গায়ে মাখতে চাননি। তাই তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিসভায় যোগ দেননি। অন্যদিকে ১৯৬১ সালের আগে থেকেই বঙ্গবন্ধু এই ভূখন্ডের স্বাধীনতার জন্য ভারতের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন। মহারাজ ত্রিলোকনাথের মাধ্যমে তিনি যোগাযোগ স্থাপন করেন। সেই প্রেক্ষাপটে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে আশ্রয় নেয়া, লড়াইয়ের সময় ট্রেনিং নেয়াসহ যুদ্ধ পরিচালনার নানা বিষয় তিনি আগেই ঠিক করে গিয়েছিলেন। শিল্পমন্ত্রী আরও বলেন, বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু বাঙালীর যে অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন সেটাকেই এগিয়ে নিচ্ছেন শেখ হাসিনা। সেই কাজের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের মর্যাদা পেয়েছে, আকাশে ভেসেছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০৪০ সালের আগেই উন্নত দেশে পরিণত হবে বাংলাদেশ। আলোচনায় জনকণ্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খান বলেন, ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দিয়েই বাঙালীর সংগ্রামের শুরু। এই জাতি কখনই কারো কাছে নতি স্বীকার করেনি। এ কারণে ব্রিটিশরা বাঙালীদেরই তাদের প্রথম শত্রু মনে করেছে। কারণ এই জাতির মধ্যে সব সময়ই স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা ছিল। সাতচল্লিশে দেশ ভাগের মাধ্যমে খন্ডিত একটি স্বাধীনতা গচিয়ে দেয় ব্রিটিশরা। তখন বাংলা ভাগ অনেকেই মেনে নেননি। সাতচল্লিশের পর পাকিস্তান নামের যে রাষ্ট্রটি গঠিত হয় তা ছিল কৃত্রিম। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে ছিল ১১০০ মাইলের দূরত্ব। অন্যদিকে সাতচল্লিশের আগে থেকেই বাঙালী জাতির মধ্যে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা ছিল। সেই প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর মতো তরুণ নেতারা তখন ঢাকায় চলে আসেন। তারা তখন একটা বিষয়ে জোর দিচ্ছিল, সেটা হচ্ছে পূর্ব বাংলা কিভাবে পরিচালিত হবে। সেই পথরেখায় প্রথমে যুব সংগঠন ও পরে আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। উল্টোদিকে পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থা কখনই গণতান্ত্রিক ছিল না। বাংলার সম্পদ কিভাবে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করবেÑএটাই ছিল পাকিস্তানের মূল উদ্দেশ্য। বাঙালীকে শোষণ ও নির্যাতন করা ছাড়া তাদের কোন লক্ষ্য ছিল না। তাই পূর্ব ও পশ্চিম ভাগ হওয়াটাই ছিল ভবিতব্য। দুই অংশের একসঙ্গে টিকে থাকার কোন ভিত্তিই ছিল না। এই প্রেক্ষাপটে এদেশের মানুষের অনুধাবন ও স্বাধীনতার আকাক্সক্ষার রূপায়নের মাধ্যমে মহানায়কে পরিণত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে তোয়াব খান বলেন, এই ছয় দফার ঘোষণার মাধ্যমেই বাঙালীর স্বাধীনতার বীজ রোপণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছয় দফা প্রণয়ন নিয়ে অনেক অপ্রাসঙ্গিক কথা চালু রয়েছে। একেকজন এটিকে একেকভাবে বলেন। আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরীর আওয়াজ নামের পত্রিকার মাধ্যমে প্রথম ছয় দফা সর্বসাধারণের কাছে প্রকাশিত হয়। তখনই মানুষ জানতে পারে ছয় দফার মূল বিষয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সোপান হচ্ছে ছয় দফা। ছয় দফাই পরবর্তীতে এক দফায় পরিণত হয়ে রূপান্তরিত হয় মুক্তিযুদ্ধে। মূল লক্ষ্য ছিল অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ। পরবর্তীতে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে যুক্ত হয় কলঙ্করেখা। এই কলঙ্ক রেখাটি মুছে পবিত্র দায়িত্বটি সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিনির্মাণ করতে হবে তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা। মূল প্রবন্ধে ড. হারুন-অর-রশিদ বলেন, ছয় দফা ছিল বাঙালীর মুক্তির সনদ। এটি বাঙালীর জাতীয় মুক্তির ম্যাগনাকার্টা নামেও অভিহিত। ৬ দফা কর্মসূচী পশ্চিম পাকিস্তানী শাসন-শোষণ থেকে বাঙালীর স্বাধীনতা অর্জনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। এ কর্মসূচীর মাত্র ৫ বছরের মধ্যে সংগঠিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। বাঙালীর মুক্তির প্রশ্নে ৬-দফাই যে সঠিক কর্মসূচী সে সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধুর প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস ছিল। ছেষট্টির ৭ জুন ছিল বাঙালীর জাতীয় মুক্তির ইতিহাসে একটি টার্নিং পয়েন্টÑস্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শেষ সংগ্রামের সূচনা। বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা কর্মসূচী পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামোর অস্তিত্বমূলে কুঠার আঘাত হানে, স্ফুরণ ঘটায় বাঙালীর জাতিসত্তার। অনুষ্ঠানের শুরুতে বঙ্গবন্ধুসহ ১৫ আগস্ট হত্যাকা-ের স্বাীকার শহীদদের স্মরণে নীরবতা পালন করা হয়।
×