ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

খেজুরের রস

বাঙালীর ঐতিহ্য পাটালি গুড়ের সেই স্বাদ আজ ম্রিয়মাণ...

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২ ডিসেম্বর ২০১৭

বাঙালীর ঐতিহ্য পাটালি গুড়ের সেই স্বাদ আজ ম্রিয়মাণ...

সমুদ্র হক খেজুরের গুড় বা পাটালি গুড়ের সন্দেশের স্বাদই আলাদা। কাঁটাময় শুকনো খড়ি মার্কা গাছের বুক চিড়ে সুমিষ্ট যে রসধারা গভীর যতনে বাঙালীর হাতে উদ্গত হয়ে আসছে তার তুলনা নেই। এই মিষ্ট রস ফুটিয়ে তৈরি করা হয় গুড়। সেই গুড়ে তৈরি হয় কতই না সন্দেশ, পিঠা পায়েস। খেজুরের গুড় দুধে মিশিয়ে তার মধ্যে চিতই পিঠা ছেড়ে রাতভর রেখে সকালে খাওয়ার যে কী স্বাদ, কী আনন্দ তা ভোলাই যায় না! খেজুরের গুড়ের মূল উপাদান খেজুর গাছের রস। তারপর কয়েক ধাপের আয়োজনে তৈরি হয় গুড়। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে বাঙালীর এই চিরকালীন ঐতিহ্য আর অনন্ত গৌরব আজ যেন ¤্রয়িমাণ। কারণ অতীত আর বর্তমানের খেজুর-রসে তৈরি পাটালি গুড়ের স্বাদ ও গন্ধে বিস্তর ফারাক। অন্তত পঞ্চাশোর্ধ বয়সী যে কোন মানুষের জিহ্ যেন ‘আজকালকার’ গুড়ে অতীতের সেই ফ্লেভার খুঁজে পান না। অতীতে খেজুর গুড়ের প্রধান অঞ্চল ছিল দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো। বর্তমানে বিকেন্দ্রীকরণের মতো খেজুর গুড় তৈরি হচ্ছে উত্তরাঞ্চলের বগুড়া, রাজশাহী ও নাটোরসহ অন্যান্য জেলায়। খেজুরের গুড় বলতেই আগে নাম আসত যশোর, খুলনা, মাগুরার। যশোর অঞ্চলে ‘খেজুরা’ নামের একটি এলাকা খেজুর গাছের জন্য বিখ্যাত। বর্তমানে এই এলাকাগুলোতে অনেক খেজুরবাগান কেটে মেহগনি শিশু সেগুন গাছ লাগানো হয়েছে। খেজুরের গাছে বর্তমানে ভাগ বসিয়েছে রাজশাহী অঞ্চল। যশোরের নড়াইল ঝিকরগাছা এলাকায় যে গুড় বানানো হচ্ছে তা আর আগের মতো নেই। এদিকে রাজশাহীর আরানী, বনপাড়া, ঝলমলিয়া বানেশ্বর, পুটিয়া, বাঘা, বড়াইগ্রাম এবং নাটোর জেলার কয়েকটি এলাকায় খেজুরের বাগান গড়ে উঠেছে। এদিকে বগুড়ায় খেজুর গাছের সংখ্যা বেড়েছে। কাহালু দুপচাঁচিয়া নন্দীগ্রাম সোনাতলা শিবগঞ্জ এলাকা এবং পার্শ্ববর্তী জয়পুরহাট জেলাও খেজুর গুড় তৈরির আওতায় এসেছে। বাংলায় গুড় শব্দটির বয়স দেড় হাজার বছর। প্রভাত রঞ্জন সরকারের শব্দ চয়নিকা বইতে আছে, এটি প্রাচীন বৈদিক শব্দ। সংস্কৃতিতে পাটালি গুড়কে বলা হয় গুড়পট্ট। গুড় চন্দ্রিকাও বলা হয়। এই গুড় কথাটি বলা যত সহজ তৈরি করা মোটেও তত সহজ নয়। রসের জন্য প্রথমে দরকার গাছি, যারা কোমড়ে মোটা রশি বেঁধে খেজুর গাছের ডগায় উঠে ধারালো কাঁচি দিয়ে কিছু অংশ ছিলে ছেনি দিয়ে ছিদ্র করে রস বের হওয়ার পথ করে দেয়। এরাই গাছের ডগায় কলসি বা ঠিলা আটকে আসে। রাতভর রস ঝরে কলসি ভরে। ভোরে তা নামিয়ে আনা হয়। এই রসেরও রকমফের আছে। রস গাছ থেকে নামিয়ে আনার পর স্টিলে তৈরি চৌকোনা বড় কড়াইয়ে ঢালা হয়। তারপর চুলার নির্দিষ্ট তাপে (কম-বেশি করে) রসকে ঘন করে তোলা হয়। তাপে এই রস প্রথমে শক্ত তরল হয়। রসের শক্ত তরল অংশটি কাঠের তৈরি নির্দিষ্ট মাপের ছাঁচে (আধা কেজি থেকে দুই কেজি) ঢেলে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। তারপর তা বের করে বিক্রির জন্য নেয়া হয়। খেজুরের গুড় তৈরির কয়েক কারিগর জানালেন, প্রতি দশ কেজি রস ফুটিয়ে এক কেজি গুড় মেলে। ঠিকমতো তাপ নিয়ন্ত্রণ না করে রস ফুটিয়ে গুড় বানালে মান ঠিক থাকে না। বেশি ফোটানো হলে গুড়ের রং হয় কালো। ধোঁয়া বেশি হলে ধোঁয়াটে স্বাদ। যিনি গুড় তৈরি করেন তার হাতযশও থাকতে হয়। প্রথম রসের গুড়কে বলা হয় নলেন গুড়। পাটালি গুড়ের সন্দেশের জন্য দরকার দানাদার ঝোলা গুড়। রুটি বা শুকনো খাবারের জন্য ঘন তরল গুড় তৈরি হয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে খেজুর গুড়ের রসগোল্লা তৈরি হয়। হালে এই খেজুরের গুড়ের মধ্যে ভেজাল দিয়ে শুরু হয়েছে জালিয়াতি। খেজুরের গুড়ে চিনির সিরা মিশিয়ে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী মুনাফা লুটছে। বিশেষ কায়দার চিনির সিরা ফিটকিরি ও হাইড্রোজ নামের রাসায়নিক উপাদান মিশিয়ে ওজন বেশি করা হয়। এই গুড় দুধে মেশানোর সঙ্গেই দুধ ছানা হয়ে যায়। এই ভেজাল গুড়ের পিঠা পায়েস তৈরি করতে গিয়ে গৃহিণীরা বেশ বিপাকেই পড়ছেন। ভেজাল গুড়ের মধ্যে আসল গুড় খুঁজে পাওয়াই এখন কঠিন। এর মধ্যেই খেজুরের আসল গুড় খুঁজে নিতে হয়। খোঁজ-খবর করে জানা যায়, খুলনা, যশোর, মাগুরা অঞ্চলের খেজুরের গুড় পাটালি গুড় খুব একটা মেলে না। ফরিদপুরের খেজুরের রসে তৈরি মুচিগুড়ও প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যশোর মাগুরায় যে পাটালি গুড় তৈরি হচ্ছে তা খুব কমই ঢাকার বাজারে যায়। যশোর মাগুরার পাটালি গুড় স্থানীয়ভাবেই বিক্রি হয় বেশি। বগুড়া ও রাজশাহী অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত গুড়ই বেশি যাচ্ছে। ক’জন গুড় বিক্রেতা বললেন, ঢাকাতেও যাচ্ছে এই গুড়। স্বাদে তেমন পার্থক্য নেই। খেজুর রসের গুড় বলে কথা...।
×