ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

কনডেম সেলে ১৩শ’ ফাঁসির আসামি

৬ মাসে অর্ধশত আসামির ফাঁসি

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ৮ আগস্ট ২০১৭

৬ মাসে অর্ধশত আসামির ফাঁসি

শংকর কুমার দে ॥ চলতি বছরের গত ছয় মাসে সারাদেশে অর্ধশতাধিক অপরাধীর মৃত্যুদ- বা ফাঁসির দ-াদেশ দিয়েছে আদালত। এটা বিগত বছরগুলোর তুলনায় নতুন রেকর্ড। দেশের ৬৮টি কারাগারের কনডেম সেলগুলোতে মৃত্যুদ-াদেশপ্রাপ্ত ফাঁসির আসামি রাখা হয়েছে সাড়ে ১৩ শতাধিক। এ বছর সারাদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক অপরাধীর মৃত্যুদ- বা ফাঁসির আদেশপ্রাপ্ত হয়েছে নারায়ণগঞ্জ জেলায়। মৃত্যুদ- বা ফাঁসির আসামিদের অনেকেই ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে রয়েছে কারাগারের কনডেম সেলে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। বর্তমানে ৪ শতাধিক ডেথ রেফারেন্স মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে হাইকোর্টে। মামলার পেপারবুক তৈরিতে দীর্ঘসূত্রতা, পর্যাপ্তসংখ্যক বেঞ্চের অভাব, বিলম্বে শুনানি হওয়া, সরকার ও আসামি পক্ষের আইনজীবীদের উদাসীনতাসহ নানা কারণে বছরের পর বছর ধরে ফাঁসির আসামিরা মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়ে রয়েছে কারাগারের কনডেম সেলের অন্ধপ্রকোষ্ঠে। স্বাধীনতার পর থেকে বিগত ৪৫ বছরে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে ৫ শতাধিক আসামির। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কারা অধিদফতর সূত্রে এ খবর জানা গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কারাগার সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের মে মাসে নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন মামলায় ২৬ জনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছে নারায়ণগঞ্জের আদালত। মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন ও র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ সাত খুনের ৩৫ আসামির মধ্যে ২৬ জনের ফাঁসির আদেশ প্রদান ছাড়াও ৯ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দেয়া হয়েছে। গত মে মাসেই নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াই হাজার থানার চার আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগ হত্যাকা-ের অভিযোগে ২৩ জনের যাবজ্জীবন মৃত্যুদ- বা ফাঁসির আদেশ দিয়েছে নারায়ণগঞ্জ অতিরিক্ত জেলা দায়রা জজ আদালত। ২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচনকালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুইটি মিছিল মুখোমুখি হওয়ার ঘটনায় চার আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীকে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা কুপিয়ে হত্যা করার মামলায় গত মে মাসে তাদের ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, কেবলমাত্র নারায়ণগঞ্জ জেলায় দুইটি ঘটনায় ৪৯ জনের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের ৫ খুনের একমাত্র আসামি মাহফুজেরও ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কারাগার সূত্র জানায়, গত রবিবার বহুল আলোচিত পুরান ঢাকার দর্জির দোকানের কর্মচারী বিশ্বজিত হত্যা মামলায় ২ জনের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখা হয়েছে। গত জুলাই মাসে হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলায় আলোচিত ৪ শিশু হত্যা মামলার রায়ে ৩ জনের ফাঁসি ও দুইজনের সাত বছরের কারাদ-ের আদেশ দিয়েছে সিলেটের আদালত। গত জুন মাসে পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমান হত্যা মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ঐশী রহমানের মৃত্যুদ- বহাল রাখে হাইকোর্ট। গত এপ্রিল মাসে রংপুর শহরে স্কুলছাত্রী মাসুদা আক্তারকে এসিড নিক্ষেপের দায়ে এক আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করার আদেশ দিয়েছে আদালত। সিলেটের আলোচিত শিশু সামিউল আলম রাজন হত্যা মামলায় বিচারিক আদালতের দেয়া ৪ জনের মৃত্যুদ-ের আদেশ গত এপ্রিল মাসে হাইকোর্টে বহাল থাকায় তারাও কারাগারের কনডেম সেলে রয়েছে। গত এপ্রিল মাসেই হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দায়ে কিশোরগঞ্জের মোসলেম প্রধান ও পলাতক সৈয়দ মোঃ হুসাইনকে মৃত্যুদ- দিয়েছে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গত ফেব্রুয়ারি মাসে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার গোবরাতলা ইউনিয়নের মহিপুরে স্কুলছাত্রী কণিকা রানী ঘোষকে প্রকাশ্যে রাস্তায় কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত আব্দুল মালেক নামের একজনকে মৃত্যুদ- প্রদান করেছে আদালত। কারাগার সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ফাঁসির আসামিদের যে কনডেম সেলে রাখা হয় তাকে এক কথায় বলা হয় কারাগারের ভেতর আরেক কারাগার। কনডেম সেলগুলো অপেক্ষাকৃত নির্জন এবং সুরক্ষিত দরজা একটাই কিন্তু কোন জানালা নেই। অন্ধকার প্রকোষ্ঠ। সেখানেই তাদের দিন কাটে। সকাল দুপুর সন্ধ্যা তিন বেলা খাবার দেয়ায় সময় দরজা খুলে তাদের খাবার দেয়া হয়। দেশের ৬৮টি কারাগারের মধ্যে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার এবং ৫৫টি জেলা কারাগারেই রয়েছে ফাঁসির আসামি। উচ্চ আদালতে এদের রায় বহাল থাকলে আইন ও কারাবিধি অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। স্বাধীনতার পর থেকে বিগত ৪৪ বছরে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে সাড়ে ৪ শতাধিক আসামির। স্বরাষ্ট্্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত প্রায় ৯৯ ভাগ আসামি যারা বহুল আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর মামলায় সাজাপ্রাপ্ত তাদের রাখা হয়েছে কাশিমপুর হাইসিকিউরিটিসহ ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগারে। প্রতিনিয়ত অপরাধের নতুন মাত্রা যোগ হওয়ায়- বাড়ছে সবচেয়ে বড় অপরাধ আর সেই অপরাধে বাড়ছে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামির সংখ্যা। খুন, ধর্ষণ, শিশু হত্যা, নারী নির্যাতনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে জঙ্গী তৎপরতা, সন্ত্রাসী কর্মকা-, সাইবার ক্রাইমসহ চাঞ্চল্যকর ঘটনা বেড়ে চলেছে। এ কারণে প্রতি বছরান্তে দেশের কারাগারগুলোয়ও মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামিদের তালিকা দীর্ঘ হর। এছাড়া নিম্ন আদালত ও জজ আদালত থেকে ফাঁসির রায় ঘোষণার পর উচ্চ আদালত, আপীল ডিভিশন এর পর রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন চালাচালি আর অন্য মামলা চলমান থাকায় বছরের পর বছর ধরে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন ফাঁসির দ-প্রাপ্ত আসামিরা। আদালতের রায় অনুযায়ী কারা সংশ্লিষ্ট প্রশাসন যথাসময়ে ফাঁসির রায় কার্যকর করতে বাধ্য। কিন্তু আসামির আবেদনের কারণে রায় সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন হতে আপীল বিভাগে চলে যায়। আপীল বিভাগেও মৃত্যুদ- বহাল থাকলে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদনের সুযোগ থাকে। রাষ্ট্রপতির প্রাণভিক্ষা না দিলে আপীল বিভাগের রায় ঘোষণার সর্বনিম্ন ২১ দিন আর সর্বোচ্চ ২৮ দিনের মধ্যে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে রায় কার্যকর করতে হয়। আইনী প্রক্রিয়ায় নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত হয়ে সর্বোচ্চ ও সর্বশেষ প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন পর্যন্ত দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় বছরের পর বছর কেটে যাচ্ছে। কারাগারের একজন কর্মকর্তা জানান, হত্যাকা-ের ঘটনায় যুক্ত হয়েছে জঙ্গীরা। জঙ্গীদের অনেকের ফাঁসি হলেও এখনও কার্যকর করা হয়নি। যাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে তাদের মধ্যে গত অক্টোবর মাসে সর্বশেষ দুই বিচারক হত্যা মামলায় খুলনা কারাগারে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গী সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) নেতা আসামি আসাদুল ইসলাম ওরফে আরিফের। ২০০৫ সালের ১৪ নবেম্বর সকালে ঝালকাঠি জেলা জজ আদালতে যাওয়ার পথে দুই বিচারককে বহনকারী মাইক্রোবাসে বোমা হামলা করে জ্যেষ্ঠ বিচারক জগন্নাথ পাঁড়ে ও সোহেল আহমেদকে হত্যা করে জঙ্গীরা। এর আগে দুই বিচারক হত্যা মামলার ফাঁসির রায়ে জএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, শায়খ আব্দুর রহমানের ভাই আতাউর রহমান সানি, জামাতা আবদুল আউয়াল, ইফতেখার হোসেন মামুন, খালেদ সাইফুল্লাহ ওরফে ফারুকের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। এ ছাড়াও দেশে প্রথমবারে মতো কার্যকর করা হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায়। যুদ্ধাপরাধীর অপরাধে ফাঁসির দ-প্রাপ্ত ছয় যুদ্ধাপরাধীর। এর আগে গত মে মাসে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে দেশের শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীকে। তাকে নিয়ে ছয় যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। অপর যে ছয় যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয় তারা হচ্ছে, বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরী, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, জামায়াতেরই অপর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত যেসব আলোচিত ব্যক্তি মৃত্যুদ-ে দ-িত হওয়ার পর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছেÑ ডাঃ ইকবাল হোসেন, সাংবাদিক নিজামউদ্দিনের কন্যা শারমিন রীমা হত্যার আসামি মনির হোসেন, কুখ্যাত সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদার, জঙ্গী নেতা বাংলাভাই, আতাউর রহমান সানী, ডেইজি হত্যা মামলার আসামি হাসান, সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পাঁচ আসামি লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, লে. কর্নেল (বরখাস্ত) একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার), মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি) ও মেজর (বরখাস্ত) বজলুল হুদা। রংপুর জেলা কারাগারে ইয়াসমিন হত্যা মামলার আসামি এএসআই মইনুল হক ও আবদুস সাত্তার, দিনাজপুরে ইয়াসমিন হত্যা মামলার আরেক আসামি পিকআপ ভ্যানচালক অমৃত লাল বর্মণ প্রমুখ। কারা অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, দেশের কারাগারগুলোতে যে সাড়ে ১৩ শতাধিক জন ফাঁসির আসামি রয়েছেন তাদের সকলের ফাঁসি কার্যকর হবে না। কারণ উচ্চ আদালতে অনেকেই আপীল করেছেন। উচ্চ আদালত থেকে কেউ কেউ খালাস পেয়ে যান। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নি¤œ আদালতের রায়ই উচ্চ আদালতে বহাল থাকে। উচ্চ আদালতে এদের রায় বহাল থাকলে আইন ও কারাবিধি অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। উচ্চ আদালতের একাধিক সিনিয়র আইনজীবীর সঙ্গে আলাপ হলে তারা জানান, অনেকগুলো মামলা দুই পক্ষের নানা আপত্তির কারণে শুনানি হচ্ছে না। আর মামলার পেপারবুক তৈরিতে দীর্ঘসূত্রতা এবং হত্যার ঘটনা বেড়ে যাওয়াই উচ্চ আদালতে ডেথ রেফারেন্সের মামলার চাপ বাড়ছে। ২০০৫ সাল থেকে বা তার পরে ফাঁসির আদেশ হয়েছে এমন অনেকেই আট থেকে ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কনডেম সেলে আটক রয়েছে। দেশের উচ্চ আদালতে ডেথ রেফারেন্স মামলার এ জট সৃষ্টির পেছনে মামলা নিষ্পত্তিতে কমসংখ্যক বেঞ্চ থাকা এবং পেপার বুক তৈরির ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতাই দায়ী। এজন্য একজন আসামির ফাঁসি হওয়ার পরে তাকে দীর্ঘদিন কনডেম সেলে থাকতে হয়। মানবাধিকার কমিশনের একজন কর্মকর্তা বলেন, ফাঁসির আসামির আপীল করতে কয়েক মাস সময় লেগে যায়। আবার আপীল মঞ্জুর হলে আপীলের নিষ্পত্তি হতে বছরের পর বছর সময় লাগে। আসামিকে ৮ থেকে ১০ বছর হয়তো কনডেম সেলে থাকতে হচ্ছে। এর চেয়ে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন আর হতে পারে না। এ ধরনের বিলম্বকে দুর্ভাগ্যজনক, সংবিধান ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী বলে মানবাধিকার কর্মকর্তার দাবি।
×